তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা কাবার গিলাফের চেয়েও দামী
কাঠের শক্ত চেয়ারে বসে থাকেন বৃদ্ধ মানুষটি। গাড়ীতে করে সাহেব আসা যাওয়ার কালে কাঁপা হাতে খুলে দেন লোহার প্রকাণ্ড গেটখানা। বয়সের ভারে নুব্জ্য শরীর নিয়ে ঝাড়ু দেন সাহেবের বাড়ীর আঙ্গিনা, বাগান আর রাস্তা। ক্লান্তি আর দুঃখের ছাপ লেগে থাকে চোখেমুখে।
তার সাহেব বড় ‘ধার্মিক’ মানুষ।
নিয়মিত নামায পড়েন। প্রতিবছর ওমরা করেন। মাঝে মাঝে লম্বা জামাও গায়ে দেন। তবে নিজ আলীশান বাড়ীর দারোয়ান-মালীর খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। তিনি ভাবেন, ধনী-গবীবের এই তারতম্য খোদারই সৃষ্টি।
এখানে তার কিছুই করার নেই। তাছাড়া এসব ‘সাধারণ’ লোকদের প্রতি সদয় হলে এরা মাথায় চড়ে বসে। ’
অবশ্য কখনো খোঁজ নিলে জানতেন, ‘তার এই দীনহীন দারোয়ানটি আট সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তার নিস্পাপ ছেলেটি প্রায়ই মা-বোনদের সাথে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে রাত কাটায়। কিশোরী মেয়েটি দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে এখন অচল।
হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে খরচের অংক শুনে বেচারার কপালে ঘাম এসে গিয়েছিল। আর ওমুখো হওয়ার সাহস করেনি। শেষে কবিরাজের ঝাড়-ফুঁক আর জড়িবুটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ঈদের দিনটিতে ছেলেমেয়েদের হাতে ভাল-মন্দ কিছুই তুলে দিতে পারেনি। বৃষ্টির দিনে ঘরের জীর্ণ চাল চুইয়ে..........।
’ আরো কত কী!
একটু চোখ খুলে তাকালেই আমাদের আশে পাশে এমন অনেক চৌধুরী আর দারোয়ানের দেখা মিলবে।
আরেক চৌধুরীর কথা শুনা যাক।
পৃথীবির সবচে মহান ঘর কাবা শরীফে গেলাফ পরানোর রেওয়াজ ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই চলে আসছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুবারক সময়েও এ রেওয়াজ ছিল। পরবর্তীতে বাইতুল্লাহর এ মহান খেদমত প্রত্যেক খলীফা স্বয়ং আঞ্জাম দিতেন।
বিষয়টি ফরজ ওয়াজিব না হলেও বরকতময় এ কাজে সবাই শরীক হতেন।
সে হিসেবে ওমর বিন আঃ আজীজ রহ. খলীফা হওয়ার পর কাবা শরীফের সম্মানিত খাদেমগণ নতুন গেলাফের আবেদন জানিয়ে তাঁর কাছে পত্র পাঠালেন।
খুলাফায়ে রাশেদীন এর অনুপম প্রতিচ্ছবি, মহান সাধক ও সংস্কারক খলীফা তাদের আবেদনের উত্তরে লিখে পাঠালেন, ‘আমি ক্ষুধাকাতর মানুষের জন্য এ অর্থ খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাইতুল্লাহর চেয়ে তারাই এর বেশী হকদার।
(হিলয়াতুল আউলিয়া)
দু’চার কাঠা জমির সাধারন মালিক নয়, প্রায় অর্ধজাহানের ‘খলীফা’ ছিলেন তিনি।
কোন নেক কাজ কখন করতে হবে, তা তিনি ভাল করেই জানতেন।
ইতিহাসের চিরউজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান মুহাদ্দিছ, ফকীহ ও মুজাহিদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এর নাম কে না শুনেছে! প্রতি একবছর পর পর তিনি হজ্ব করতেন। সাথে থাকত শাগরেদ-ভক্তের বিশাল কাফেলা।
একবার হজ্বের সফরে ছোট্ট একগ্রামে তাঁর কাফেলা থামলো। সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিল।
তিনি হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের একপ্রান্তে চলে এলেন। আশেপাশে মানুষের সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ দেখলেন, শীর্ণ এক কুটির থেকে বোরকা পরা এক মহিলা বের হল। চারদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে চুপিচুপি এগিয়ে গেল কাছের আস্তাঁকুড়ের দিকে। তারপর ময়লা ঘেঁটে মরা একটি পাখি পেয়ে ক্ষিপ্রহাতে সেটিকে কাপড়ে লুকিয়ে দ্রুতপায়ে ফিরে এল!
কি ভয়ানক ব্যাপার!! মরাপ্রাণী খাওয়া যে হারাম, এ মহিলা কি তা জানেনা! তিনি কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
তারপর ধীরপায়ে গিয়ে মহিলার দরজায় করাঘাত করলেন।
খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, ‘দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত অসহায় মহিলাটিকে অনন্যোপায় হয়েই এ কাজ করতে হচ্ছে! কিছুদিন ধরে তার এবং তার অচল ভাইটির পেটের জ্বালা নিবারণের এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই!’
অশ্র“সজল চোখে তিনি কাফেলার কাছে ফিরে গেলেন। খাদেমকে বললেন-
ঃ রাহাখরচ কত এনেছো?
ঃ একহাজার স্বর্ণমুদ্রা।
ঃ বিশটি গুনে রেখে বাকিটা আমার হাতে দাও!
খাদেম তা-ই করলো। তিনি থলেটা নিয়ে সেই অসহায় মহিলার হাতে তুলে দিলেন।
তারপর এসে খাদেমকে বললেন, ‘এ বছর আমাদের জন্য হজ্বের চেয়ে এটাই উত্তম!’ বাড়ী ফিরে চলো। বিশ দিনারে ফিরে যাওয়ার খরচ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ!!
সূত্র ঃ- হা কাযা ফাহিমাস্সাহাবাহ
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন বস্ত্রহীন মুসলমানকে কাপড় পরায়, আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন। আর কোন ক্ষুধার্ত মুসলমানকে যে খাওয়ায়, আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। ’ (আবু দাউদ)
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ক্ষুধার্ত মুসলমানকে খাওয়ানো আল্লাহ পাকের ক্ষমা ওয়াজিবকারী একটি আমল। (বায়হাকী-শুআ’ব)
প্রিয় পাঠক! আল্লাহ পাক আপনাদেরকে সাচ্ছন্দ্যে রাখুন! আমরা যারা ‘চৌধুরী’ নই, থলেভর্তি পয়সাকড়ি যাদের নেই, আমরাও কিন্ত পারি মহান এ নেক কাজে শরীক হতে!
কে বলেছে দান করতে হলে কাড়ি কাড়ি পয়সা লাগে?!
আমাদের পুরোনো কাপড়গুলো ফেলে না রেখে অভাবীদের হাতে পৌঁছাবার পরিকল্পনা করে ফেলি।
এখন শীতের মৌসুম। বাড়ী যাওয়ার সময় এলাকার গরীব দুঃখীর জন্য দু’একটি কাপড় (হোক না পুরাতন) সংগ্রহ করার সাধ্য আশা করি সবারই থাকে।
দু হাজার নয়, দুই শ’ও নয়, মাত্র দু টাকার ছোট্ট এক প্যাকেট বিস্কুট হলেও অভুক্ত কোনো দুস্থের হাতে তুলে দিতে পারি। পাত্র বুঝে দু-চারটি ভাল কথা শুনিয়ে তার মুখ থেকেই ভাল হয়ে চলার অঙ্গিকার আদায় করি। আল্লাহ চাহে তো, স্বার্থপরতার এই অন্ধকার দুনিয়ায় এ সামান্য সহমর্মিতাও ওদের আহত মনে গভীর দাগ কাটবে।
আর তাই একদিন হয়ে দাঁড়াবে আমাদের অনাবিল পুণ্যময় সমাজের ভিত্তি প্রস্তর।
আর হ্যাঁ, চৌধুরী সাহেব! আপনার অন্তত একটি ওমরার খরচ দিয়ে হলেও বেচারা ‘দারোয়ানে’র অসহায় পরিবারটি যদি দাঁড় করিয়ে দিতেন, তাহলে এর পুণ্য এমন ওমরার চেয়ে ইনশাআল্লাহ কম হত না। আপনি হয়তো জানেন না, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহানুভব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘(অসহায়) বিধবা ও মিসকিনের জন্য দৌড়ঝাঁপকারী (নফল) নামায ও রোযা আদায়কারীর মত!’ (ইবনে মাজাহ, মুসলিম। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।