ভালবাসি মা-মাটি-দেশ। স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর সকাল। এক নতুন সূর্যোদয়ের।
চিরাচরিত আপোষহীন, চিরবিদ্রোহি এই জাতি স্বাধীনতার পরই যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তারা মেনে নেয়ার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি চালু করে।
আপোষহীন এক জনগোষ্ঠী নিজেদের অসাধারণ চরিত্রের বিপরীতে গিয়ে আপোষ করতে শুরু করে। চিরবিদ্রোহি এই জাতি সহসাই ভুলে বসে বিদ্রোহ। আর এই সুযোগেই এ দেশে নেমে আসতে থাকে নানা দুর্যোগ।
এ দেশবাসীর ঘারে চেপে বসে নানা অশুভ শক্তি। দেশদ্রোহীর গায়ে লাগে দেশপ্রেমিকের তকমা।
সুর্যসন্তানের (মুক্তিযোদ্ধা) ভাগ্যে জোটে না একমুঠো অন্ন, মেলেনা বাসস্থান। সে তখন উদবাস্ত। রাজাকার রাতারাতি ফুলেফেপে ওঠা রাঘব বোয়াল। যখন এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সারথিরা একে অন্যের ঘোর শত্রু। পরাজিত শক্তি বাস্তবায়ন করে চলেছে তাদের নীল নকশা।
মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত। সাধারণ মানুষ খুঁজছে পরিত্রাণের পথ। আর ঠিক সে সময়েই শাহবাগের বুক চিরে বেড়িয়ে এলো একদল আলোর দিশারী। অন্ধকার হাতরে চলা এ জাতি সহসাই যেন খুঁজে পেল পরিত্রাণের পথ।
ছাত্র শিক্ষক পেশাজীবীদের মধ্য থেকে এক দল ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ যারা জোনাকি পোকার মত আপন সলতের মৃদু আলোয় ধরিত্রীকে আলোকিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে শেষ পর্যন্ত জ্বলে যায়, তারা ব্লগার।
যাদের হাত ধরেই আজ সর্বসাধারনের এই ঘুরে দাড়ানো। দিনে দিনে প্রকট হয়ে ওঠা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে। আঃ কাদের মোল্লাকে তার মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের নামে প্রাপ্য সাজা না দেয়াকে উপলক্ষ করে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও এর পেছনে অনেকগুলো এলিমেন্ট সক্রিয়।
যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল- রাজনীতিবিদদের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন।
এ ক্ষোভ রাজনীতিবিদদের প্রতি, তাদের-
• বল্গাহিন দুর্নীতি,
• জেদ-একগুঁয়েমি,
• আদর্শহীন রাজনীতি,
• শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য রাজনীতি,
• জনগণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার।
• দুই পরিবারের হাতে দেশ জিম্মি হয়ে পরা।
• রাজনীতিকে পেশিশক্তি নির্ভর করে তোলা।
• আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকেও নির্লজ্জ অস্বীকার।
• নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে নিজেদের নিয়ে পরে থাকা।
• সর্বোপরি স্বীকৃত রাজাকারদের ক্রমাগত সরকারি আনুকূল্য প্রদান।
যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, করে তুলেছে প্রভূত ক্ষমতাশালীও। এমনকি তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়ার মত ধৃষ্টতাও বর্তমান রাজনীতিবীদগনই দেখিয়েছেন। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সামান্যতম দায়বদ্ধতা থাকলেও তারা এটা করতে পারতেন না।
স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মের থেকে চিন্তায়-চেতনায়-বিশ্বাসে অনেকটাই এগিয়ে। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যে স্থানটিতে সেটি হল, চরম আবেগকে ঝেরে ফেলে তারা নিজেদের এক যুক্তিনির্ভর প্রজন্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
• যারা দেশকে নিয়ে ভাবে।
• যারা সহজে প্রতারিত হয় না।
• চাপিয়ে দেয়া কোন কিছুই যারা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
স্বাধীনচেতা এই প্রজন্মই পালটে দিবে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই এ দেশকে তুলে দিবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের হাতে।
আর প্রতিহত করবে তাদের স্খলনও। আজকের এই আন্দোলন শুধুমাত্র রাজাকারদের ফাঁসির দাবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ জাগরণ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করবে নিসন্দেহে। চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ এমনকি সামাজিক যে অসঙ্গতি, যে অস্থিরতা সর্বত্র বিরাজ করছে পথ দেখাবে সেখান থেকে উত্তরণেরও। প্রজন্ম চত্বর থেকেই যার শুরু।
এতদিন ধরে এ দেশের সাধারণ মানুষ যে, একজন ভাষানী অথবা বঙ্গবন্ধুর পথ চেয়ে বসেছিল তারা আজ তাঁদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে এই অকুতোভয় তারুণ্যের মাঝে। দ্বিধান্বিত জ্যেষ্ঠ প্রজন্মকে পথ দেখিয়েছে তাদেরই উত্তরসূরিরা! এ লজ্জার নয়, এ আনন্দের। আর তাই বয়োজ্যেষ্ঠরা এসে সাগ্রহে শামিল হয়েছে এই আন্দোলনে। স্বাধীনতা উত্তর একটি দেশে, দেশ গড়ার যে আন্দোলন। এ দেশে তা বারংবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে পরাজিত শক্তির সুচতুর কুট কৌশলে।
আর তাদের সহযোগিতা করেছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। যারা এখনো সমান সক্রিয়।
সব মুক্তিযোদ্ধা যে চিরদিন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না। কখনো কখনো পর্দার অন্তরালে কারো কারো মুখটিই যে হয়ে উঠে ভয়ংকর দেশদ্রোহী। সে চিত্রও এ দেশের মানুষ কম দেখেনি।
সে জন্যে এ দেশের মানুষ লজ্জিত হয়েছে, ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর কায়মনোবাক্যে শ্রষ্ঠার কাছে আকুতি জানিয়েছে কোন এক সূর্য সন্তানের আগমনের। আজ যখন সেই সূর্য সন্তানেরা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। তখন পঙ্গপালের মত ছুটে এসেছে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই।
তারা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সাহস যুগিয়েছে, আশীর্বাদ করেছে সর্বান্তকরণে। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিচ্ছে না শমাবেশস্থলে আসা যাত্রীর কাছ থেকে। সাধারণ মানুষ খাবার সরবরাহ করছে পরিচয় গোপন রেখে। একাত্মতা ঘোষণা করছে সব শ্রেণী পেশার মানুষ।
আজ সব পথ এসে মিশেছে এই প্রজন্ম চত্বরে । এ যেন একাত্তরের নতুন সংস্করণ। এখানে কোন দল নেই, মত নেই, নেই ভেদাভেদ কোন। এখানে টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে আনা হয় না। যারা আসেন তারা এদের জন্য অর্থ খরচ করে ধন্য হন।
এতদিন এ দেশের মানুষ যে ডাকের অপেক্ষায় ছিল আজ সে ডাকে তাই তাদের সাড়াও অভাবনীয়। শুধু তাই নয়; এই ডাক, এই পথ নির্দেশনা; প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানে থেকে সফল করারও অক্লান্ত চেষ্টায় রত। এখানে কোন দেনা-পাওনার হিসেব নেই। এখানে কোন আকুতি নেই। এখানে দাবী।
আর সে দাবী প্রাণের দাবী। ঋণ শোধের দাবী, সকল ভুলের প্রায়শ্চিত্তের দাবী। এ দাবী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণের। এ দাবী এ দেশকে শত্রু মুক্ত করার। আজ এক কথায় যাকে আমরা বলছি মানবতা বিরোধী অপরাধীদের সুষ্ঠ বিচারের দাবী।
আজ প্রজন্ম চত্বরের তরুণদের সাথে একাত্ম হয়ে জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে প্রতিবাদী মঞ্চ। একটানা প্রতিবাদের এ ঝড় বদলে দিয়েছে রাজনীতির জটিল সব সমীকরণ। থামিয়ে দিয়েছে জামাত-শিবিরের অযাচিত উল্লম্ফন।
কিন্তু কথা হল আরব বসন্তের ন্যায় বাঙ্গালীর এই যে নবজাগরণ। আমাদের নেতা নেত্রীরা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কতটা সক্ষম? কোন কোন দল হয়ত এই আন্দোলনের ফলে লাভবান হবে।
কেউবা ক্ষতিগ্রস্ত। এটা নির্ভর করবে সেই দলের নিজস্ব আদর্শের উপর। যে আদর্শ তরুণ প্রজন্মের এই চাওয়ার সাথে একীভূত হয়ে চলতে সক্ষম তারা স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবে। যারা উল্টোমুখি স্রোতে চলতে চাইবে তারাও তাঁর উপযুক্ত জবাব পাবে। তবে এটাও ঠিক, যারা এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবে তারা ভুল করবেন।
যার প্রমাণ মাহবুবুল আলম হানিফের প্রতি বোতল নিক্ষেপ, সাহারাকে না বলে দেয়া, আফসারুল আমিনকে বক্তৃতা দিতে না দেয়া। এমনকি তোফায়েল আহমেদকে বক্তৃতা দিতে না দেয়া। তারুণ্যের শক্তি যে কতটা, তা তাদের এই সাহসী কার্যকলাপেই প্রমাণ করে। এ দেশের পাঁচ কোটী তরুণ সহসাই পালটে দিতে পারে গতানুগতিক ধারাকে। যার স্বাক্ষর তারা রেখেছেন প্রজন্ম চত্বরে।
আমরা বার বার বলে এসেছি লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির এ দেশে কোন প্রয়োজন নেই। আজ এই যে নব জাগরণ একে কোন ছাত্র রাজনীতির ফসল বলবেন? যারা ব্লগার, যারা ফেসবুক বা অনলাইন এক্টিভিষ্ট, তারা প্রত্যেকে ঘৃণাভড়ে প্রত্যাখ্যান করে, চলমান ছাত্ররাজনীতির নামে চলা আদর্শহীন অপরাজনীতিকে। অথচ এই আন্দোলনকারীদের বড় অংশই ছাত্র। যারা প্রমাণ করেছে সত্যের জন্য যে আন্দোলন, দেশ মাতৃকার জন্য যে আন্দোলন তা সফল করতে পেছনে বিশেষ কোন শক্তির আশ্রয় বা প্রশ্রয়ের প্রয়োজন হয়না। বরং অদৃশ্য শক্তিই এক সময় জনতার আন্দোলনের পিঠে ছুরি চালাতে উদ্যত হয়।
চেষ্টা করে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে, আন্দোলনকে আশ্রয় করে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের। আজকের তারুণ্য পূর্বেই সে পাঠ নিয়েছে। আর তাই তারা খুব সচেতনভাবেই দূরে রাখতে চেয়েছে রাজনীতিবিদদের। কারণ একটাই, রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থাহীনতা। যা তাদেরই সৃষ্ট।
এত বড় জনসমাগম অথচ একটি লাঠি পর্যন্ত নেই কারো হাতে। মানুষ কোলের শিশুকে নিয়ে নির্ভয়ে এসে যোগ দিচ্ছেন এই প্রতিবাদে। এই তরুণরা কি শেখালেন আমাদের নেতৃবৃন্দকে? তারা কি আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণে সমর্থ হয়েছেন? ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। তবে, এতকিছুর পরেও বিএনপি নেতাদের বক্তব্য শুনলে বিএনপিকে একটি বিভ্রান্ত দল বলেই মনে হয়। যারা মোটেই যুক্তিনির্ভর নয়।
আর আওয়ামীলীগের এই যে ফায়দা লোটার প্রবণতা। এটাও খুব একটা সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। তেমনই সুবিবেচনার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সুবিধাবাদি এরশাদ। যদিও আপোষের তির্যক বানটি আওয়ামীলীগের প্রতিই নিক্ষিপ্ত তথাপিও আখেরে হয়ত তারাই লাভবান হবে। কেননা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে তারাই।
যা একসময় ছিল কল্পনাতীত।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই শেষ নয়। তরুণদের এই জ্বলে ওঠা একবারের জন্য নয় এরা বারবার জ্বলে উঠবে। এবার এ আগুনে জ্বলছে মানবতা বিরোধী অপরাধীরা। এরপরে ভস্মীভূত হবার পালা সকল দুর্নীতিবাজদের।
দেশের সকল দুর্নীতিবাজ এবং যারা তাদের রক্ষক তারাও কি গোলাম আযমের ন্যায় আজ আতংকিত নন? যদি না হন তাহলে বলব তৈরি হয়ে যান এরপরেই আপনাদের পালা। তারুণ্যের এই জাগরণ দিন বদলের। সোনার বাংলাদেশ গড়ার। তাই অনেককেই এবার সাবধান হতে হবে। বাংলার মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন গতানুগতিকে নিমিষে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন ধারার জন্ম দেয়।
আর সেই জোয়ারে ভেসে যায় সব অনাচার। ইতিহাস সে সাক্ষ্যই প্রদান করে।
বেশ কিছুদিন ধরে নানা মাধ্যমে বলা হচ্ছিল বর্তমান নেতৃবৃন্দ নতুন প্রজন্মকে ধারণ করতে পারছেন না বা ধারণ করতে চাইছেন না। এবার নিশ্চয়ই তাদের বোধোদয় হবে। এ দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী ৫২, ৬৯, ৭১ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রজন্মকে করেছে মহিমান্বিত।
তাদের সর্বাত্মক ত্যাগ, নিষ্ঠা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা গর্বিত বাংলাদেশী। তাদের সে ঋণ এ জাতি চিরদিনই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। অথচ তাদের উপস্থিতি স্বত্বেও আমাদের নেতৃবৃন্দ আদর্শহীন এক অপরাজনীতির চর্চা শুরু করেছেন। যা উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল সচেতন মহলকে। সেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করতেই তারুন্যের এই জেগে ওঠা।
আজ যারা এই আন্দোলনের প্রাণ। তাদের কাছে আমাদের আকুল আবেদন মানবতা বিরোধীদের ফাঁসির দাবি মিটে গেলেই আপনারা সরে আসবেন না। আজ যে যুদ্ধের সূচনা হল তা অব্যাহত থাকুক সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে, অনবরত অনাদিকালব্যাপি। পালটাবে দাবী, পালটাবে মিছিলের মানুষ। শুধু নিভবে না প্রজ্বলিত এই শিখা, অনির্বাণ হয়ে তা জলতে থাকবে প্রজন্ম চত্বরে।
সে আলোয় কেটে যাবে ঘোর অমানিশা।
চিরাচরিত আপোষহীন, চিরবিদ্রোহি এই জাতি স্বাধীনতার পরই যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তারা মেনে নেয়ার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি চালু করে। আপোষহীন এক জনগোষ্ঠী নিজেদের অসাধারণ চরিত্রের বিপরীতে গিয়ে আপোষ করতে শুরু করে। চিরবিদ্রোহি এই জাতি সহসাই ভুলে বসে বিদ্রোহ।
আর এই সুযোগেই এ দেশে নেমে আসতে থাকে নানা দুর্যোগ।
এ দেশবাসীর ঘারে চেপে বসে নানা অশুভ শক্তি। দেশদ্রোহীর গায়ে লাগে দেশপ্রেমিকের তকমা। সুর্যসন্তানের (মুক্তিযোদ্ধা) ভাগ্যে জোটে না একমুঠো অন্ন, মেলেনা বাসস্থান। সে তখন উদবাস্ত।
রাজাকার রাতারাতি ফুলেফেপে ওঠা রাঘব বোয়াল। যখন এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সারথিরা একে অন্যের ঘোর শত্রু। পরাজিত শক্তি বাস্তবায়ন করে চলেছে তাদের নীল নকশা। মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত। সাধারণ মানুষ খুঁজছে পরিত্রাণের পথ।
আর ঠিক সে সময়েই শাহবাগের বুক চিরে বেড়িয়ে এলো একদল আলোর দিশারী। অন্ধকার হাতরে চলা এ জাতি সহসাই যেন খুঁজে পেল পরিত্রাণের পথ।
ছাত্র শিক্ষক পেশাজীবীদের মধ্য থেকে এক দল ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ যারা জোনাকি পোকার মত আপন সলতের মৃদু আলোয় ধরিত্রীকে আলোকিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে শেষ পর্যন্ত জ্বলে যায়, তারা ব্লগার। যাদের হাত ধরেই আজ সর্বসাধারনের এই ঘুরে দাড়ানো। দিনে দিনে প্রকট হয়ে ওঠা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে।
আঃ কাদের মোল্লাকে তার মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের নামে প্রাপ্য সাজা না দেয়াকে উপলক্ষ করে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও এর পেছনে অনেকগুলো এলিমেন্ট সক্রিয়।
যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল- রাজনীতিবিদদের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন।
এ ক্ষোভ রাজনীতিবিদদের প্রতি, তাদের-
• বল্গাহিন দুর্নীতি,
• জেদ-একগুঁয়েমি,
• আদর্শহীন রাজনীতি,
• শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য রাজনীতি,
• জনগণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার।
• দুই পরিবারের হাতে দেশ জিম্মি হয়ে পরা।
• রাজনীতিকে পেশিশক্তি নির্ভর করে তোলা।
• আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকেও নির্লজ্জ অস্বীকার।
• নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে নিজেদের নিয়ে পরে থাকা।
• সর্বোপরি স্বীকৃত রাজাকারদের ক্রমাগত সরকারি আনুকূল্য প্রদান। যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, করে তুলেছে প্রভূত ক্ষমতাশালীও। এমনকি তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়ার মত ধৃষ্টতাও বর্তমান রাজনীতিবীদগনই দেখিয়েছেন।
দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সামান্যতম দায়বদ্ধতা থাকলেও তারা এটা করতে পারতেন না।
স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মের থেকে চিন্তায়-চেতনায়-বিশ্বাসে অনেকটাই এগিয়ে। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যে স্থানটিতে সেটি হল, চরম আবেগকে ঝেরে ফেলে তারা নিজেদের এক যুক্তিনির্ভর প্রজন্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
• যারা দেশকে নিয়ে ভাবে।
• যারা সহজে প্রতারিত হয় না।
• চাপিয়ে দেয়া কোন কিছুই যারা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
স্বাধীনচেতা এই প্রজন্মই পালটে দিবে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই এ দেশকে তুলে দিবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের হাতে। আর প্রতিহত করবে তাদের স্খলনও। আজকের এই আন্দোলন শুধুমাত্র রাজাকারদের ফাঁসির দাবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
এ জাগরণ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করবে নিসন্দেহে। চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ এমনকি সামাজিক যে অসঙ্গতি, যে অস্থিরতা সর্বত্র বিরাজ করছে পথ দেখাবে সেখান থেকে উত্তরণেরও। প্রজন্ম চত্বর থেকেই যার শুরু।
এতদিন ধরে এ দেশের সাধারণ মানুষ যে, একজন ভাষানী অথবা বঙ্গবন্ধুর পথ চেয়ে বসেছিল তারা আজ তাঁদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে এই অকুতোভয় তারুণ্যের মাঝে। দ্বিধান্বিত জ্যেষ্ঠ প্রজন্মকে পথ দেখিয়েছে তাদেরই উত্তরসূরিরা! এ লজ্জার নয়, এ আনন্দের।
আর তাই বয়োজ্যেষ্ঠরা এসে সাগ্রহে শামিল হয়েছে এই আন্দোলনে। স্বাধীনতা উত্তর একটি দেশে, দেশ গড়ার যে আন্দোলন। এ দেশে তা বারংবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে পরাজিত শক্তির সুচতুর কুট কৌশলে। আর তাদের সহযোগিতা করেছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। যারা এখনো সমান সক্রিয়।
সব মুক্তিযোদ্ধা যে চিরদিন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না। কখনো কখনো পর্দার অন্তরালে কারো কারো মুখটিই যে হয়ে উঠে ভয়ংকর দেশদ্রোহী। সে চিত্রও এ দেশের মানুষ কম দেখেনি। সে জন্যে এ দেশের মানুষ লজ্জিত হয়েছে, ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর কায়মনোবাক্যে শ্রষ্ঠার কাছে আকুতি জানিয়েছে কোন এক সূর্য সন্তানের আগমনের।
আজ যখন সেই সূর্য সন্তানেরা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উদাত্ত আহবান জানিয়েছে। তখন পঙ্গপালের মত ছুটে এসেছে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই। তারা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সাহস যুগিয়েছে, আশীর্বাদ করেছে সর্বান্তকরণে।
রিকশাওয়ালা ভাড়া নিচ্ছে না শমাবেশস্থলে আসা যাত্রীর কাছ থেকে। সাধারণ মানুষ খাবার সরবরাহ করছে পরিচয় গোপন রেখে। একাত্মতা ঘোষণা করছে সব শ্রেণী পেশার মানুষ। আজ সব পথ এসে মিশেছে এই প্রজন্ম চত্বরে । এ যেন একাত্তরের নতুন সংস্করণ।
এখানে কোন দল নেই, মত নেই, নেই ভেদাভেদ কোন। এখানে টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে আনা হয় না। যারা আসেন তারা এদের জন্য অর্থ খরচ করে ধন্য হন।
এতদিন এ দেশের মানুষ যে ডাকের অপেক্ষায় ছিল আজ সে ডাকে তাই তাদের সাড়াও অভাবনীয়। শুধু তাই নয়; এই ডাক, এই পথ নির্দেশনা; প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানে থেকে সফল করারও অক্লান্ত চেষ্টায় রত।
এখানে কোন দেনা-পাওনার হিসেব নেই। এখানে কোন আকুতি নেই। এখানে দাবী। আর সে দাবী প্রাণের দাবী। ঋণ শোধের দাবী, সকল ভুলের প্রায়শ্চিত্তের দাবী।
এ দাবী সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণের। এ দাবী এ দেশকে শত্রু মুক্ত করার। আজ এক কথায় যাকে আমরা বলছি মানবতা বিরোধী অপরাধীদের সুষ্ঠ বিচারের দাবী।
আজ প্রজন্ম চত্বরের তরুণদের সাথে একাত্ম হয়ে জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে প্রতিবাদী মঞ্চ। একটানা প্রতিবাদের এ ঝড় বদলে দিয়েছে রাজনীতির জটিল সব সমীকরণ।
থামিয়ে দিয়েছে জামাত-শিবিরের অযাচিত উল্লম্ফন।
কিন্তু কথা হল আরব বসন্তের ন্যায় বাঙ্গালীর এই যে নবজাগরণ। আমাদের নেতা নেত্রীরা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কতটা সক্ষম? কোন কোন দল হয়ত এই আন্দোলনের ফলে লাভবান হবে। কেউবা ক্ষতিগ্রস্ত। এটা নির্ভর করবে সেই দলের নিজস্ব আদর্শের উপর।
যে আদর্শ তরুণ প্রজন্মের এই চাওয়ার সাথে একীভূত হয়ে চলতে সক্ষম তারা স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হবে। যারা উল্টোমুখি স্রোতে চলতে চাইবে তারাও তাঁর উপযুক্ত জবাব পাবে। তবে এটাও ঠিক, যারা এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবে তারা ভুল করবেন। যার প্রমাণ মাহবুবুল আলম হানিফের প্রতি বোতল নিক্ষেপ, সাহারাকে না বলে দেয়া, আফসারুল আমিনকে বক্তৃতা দিতে না দেয়া। এমনকি তোফায়েল আহমেদকে বক্তৃতা দিতে না দেয়া।
তারুণ্যের শক্তি যে কতটা, তা তাদের এই সাহসী কার্যকলাপেই প্রমাণ করে। এ দেশের পাঁচ কোটী তরুণ সহসাই পালটে দিতে পারে গতানুগতিক ধারাকে। যার স্বাক্ষর তারা রেখেছেন প্রজন্ম চত্বরে।
আমরা বার বার বলে এসেছি লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির এ দেশে কোন প্রয়োজন নেই। আজ এই যে নব জাগরণ একে কোন ছাত্র রাজনীতির ফসল বলবেন? যারা ব্লগার, যারা ফেসবুক বা অনলাইন এক্টিভিষ্ট, তারা প্রত্যেকে ঘৃণাভড়ে প্রত্যাখ্যান করে, চলমান ছাত্ররাজনীতির নামে চলা আদর্শহীন অপরাজনীতিকে।
অথচ এই আন্দোলনকারীদের বড় অংশই ছাত্র। যারা প্রমাণ করেছে সত্যের জন্য যে আন্দোলন, দেশ মাতৃকার জন্য যে আন্দোলন তা সফল করতে পেছনে বিশেষ কোন শক্তির আশ্রয় বা প্রশ্রয়ের প্রয়োজন হয়না। বরং অদৃশ্য শক্তিই এক সময় জনতার আন্দোলনের পিঠে ছুরি চালাতে উদ্যত হয়। চেষ্টা করে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে, আন্দোলনকে আশ্রয় করে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের। আজকের তারুণ্য পূর্বেই সে পাঠ নিয়েছে।
আর তাই তারা খুব সচেতনভাবেই দূরে রাখতে চেয়েছে রাজনীতিবিদদের। কারণ একটাই, রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থাহীনতা। যা তাদেরই সৃষ্ট।
এত বড় জনসমাগম অথচ একটি লাঠি পর্যন্ত নেই কারো হাতে। মানুষ কোলের শিশুকে নিয়ে নির্ভয়ে এসে যোগ দিচ্ছেন এই প্রতিবাদে।
এই তরুণরা কি শেখালেন আমাদের নেতৃবৃন্দকে? তারা কি আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণে সমর্থ হয়েছেন? ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। তবে, এতকিছুর পরেও বিএনপি নেতাদের বক্তব্য শুনলে বিএনপিকে একটি বিভ্রান্ত দল বলেই মনে হয়। যারা মোটেই যুক্তিনির্ভর নয়। আর আওয়ামীলীগের এই যে ফায়দা লোটার প্রবণতা। এটাও খুব একটা সুবুদ্ধির পরিচায়ক নয়।
তেমনই সুবিবেচনার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সুবিধাবাদি এরশাদ। যদিও আপোষের তির্যক বানটি আওয়ামীলীগের প্রতিই নিক্ষিপ্ত তথাপিও আখেরে হয়ত তারাই লাভবান হবে। কেননা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে তারাই। যা একসময় ছিল কল্পনাতীত।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই শেষ নয়।
তরুণদের এই জ্বলে ওঠা একবারের জন্য নয় এরা বারবার জ্বলে উঠবে। এবার এ আগুনে জ্বলছে মানবতা বিরোধী অপরাধীরা। এরপরে ভস্মীভূত হবার পালা সকল দুর্নীতিবাজদের। দেশের সকল দুর্নীতিবাজ এবং যারা তাদের রক্ষক তারাও কি গোলাম আযমের ন্যায় আজ আতংকিত নন? যদি না হন তাহলে বলব তৈরি হয়ে যান এরপরেই আপনাদের পালা। তারুণ্যের এই জাগরণ দিন বদলের।
সোনার বাংলাদেশ গড়ার। তাই অনেককেই এবার সাবধান হতে হবে। বাংলার মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন গতানুগতিকে নিমিষে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন ধারার জন্ম দেয়। আর সেই জোয়ারে ভেসে যায় সব অনাচার। ইতিহাস সে সাক্ষ্যই প্রদান করে।
বেশ কিছুদিন ধরে নানা মাধ্যমে বলা হচ্ছিল বর্তমান নেতৃবৃন্দ নতুন প্রজন্মকে ধারণ করতে পারছেন না বা ধারণ করতে চাইছেন না। এবার নিশ্চয়ই তাদের বোধোদয় হবে। এ দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী ৫২, ৬৯, ৭১ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রজন্মকে করেছে মহিমান্বিত। তাদের সর্বাত্মক ত্যাগ, নিষ্ঠা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা গর্বিত বাংলাদেশী। তাদের সে ঋণ এ জাতি চিরদিনই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
অথচ তাদের উপস্থিতি স্বত্বেও আমাদের নেতৃবৃন্দ আদর্শহীন এক অপরাজনীতির চর্চা শুরু করেছেন। যা উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল সচেতন মহলকে। সেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করতেই তারুন্যের এই জেগে ওঠা।
আজ যারা এই আন্দোলনের প্রাণ। তাদের কাছে আমাদের আকুল আবেদন মানবতা বিরোধীদের ফাঁসির দাবি মিটে গেলেই আপনারা সরে আসবেন না।
আজ যে যুদ্ধের সূচনা হল তা অব্যাহত থাকুক সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে, অনবরত অনাদিকালব্যাপি। পালটাবে দাবী, পালটাবে মিছিলের মানুষ। শুধু নিভবে না প্রজ্বলিত এই শিখা, অনির্বাণ হয়ে তা জলতে থাকবে প্রজন্ম চত্বরে। সে আলোয় কেটে যাবে ঘোর অমানিশা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।