আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙ্গালীর পাঠাভ্যাস

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই বাঙ্গালীর কি পাঠাভ্যাস আছে? থাকলেও বা সেটা কতটুকু? বুদ্ধির মাধ্যমে যারা জীবিকা অর্জন করে, জীবিকার তাগিদে তাদের বই পড়তে হয় বা পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হয়; না হলে তাদের চলেনা; তাদের কথা নয়। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, জনসাধারনের মধ্যে পাঠাভ্যাস আছে কি না; থাকলেই বা সেটা কতটুকু? প্রথমেই আসি ছাত্রদের কথায়, গুটিকতকবাদে ছাত্রদের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়া বাদে, অন্য কোন বইয়ের মলাটও চোখ মেলে দেখতে চায় না। প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়াও আবার সীমিত থাকে কতিপয় নোট মুখস্থ করার মধ্যে। তাদের অন্তিম লক্ষ্য, নোট মুখস্থ্ করে, পরীক্ষা দিয়ে; ভাল মানের একটি সার্টিফিকেট জোগাড় করা। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাও এমন যে, পাঠ্যপুস্তক অভিনিবেশ সহকারে পড়ে ভাল মানের সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না, যেটা কেবল মাত্র সম্ভব নোট মুখস্থ করে।

নোট মুখস্থ করে, পরীক্ষায় পাস করাকে, নকল করে পাস করার সমতুল্য মনে হয়, কারন তাতে করে; তারা বিদ্যাকে নিজের করে পায়না। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক লেখা পড়া শেষ করে তারা বসে চাকুরির পরীক্ষায়। সেখানে সাধারণ জ্ঞান নামক এক আজব বস্তুকে আলুভর্তা করে; বাংলা ও ইংরেজীর ভাতের সাথে মিশিয়ে , উদর পূর্তি করে, পরীক্ষার খাতায় ঠিকমতো বমি করে দিতে পারলেই, প্রথম শ্রেণীর, দ্বিতীয় শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা! আর সাথে থাকতে হয় মামা, খালু, চাচা, ফুপাদের সাত রকমের ব্যাঞ্জন – আর কোন সমস্যা নেই। মাঝে মাঝে আবার দুঃসম্পর্কীয় মামা খালুদের পকেট তেজ-পাতা দিয়ে ভরে দিতে হয় এই যা! তারপর অষ্ট্রেলিয়ান গাভীর মত নাদুসনুদুস বউ ক্রয় করা ও নিজেই অনেক কিছুর এবং অন্য অনেকের মামা খালু হয়ে যাওয়া এবং গাবলা গোবলা কিছু ছেলে মেয়ের জনক হওয়া –এইতো। এর মধ্যে পাঠাভ্যাসের লেশমাত্র নেই বা থাকতে পারেনা।

আর আমাদের দেশটি যেন সামনের দিকে এক পাও এগিয়ে না যেতে পারে বরঞ্চ আরো একশ পা পিছিয়ে যায় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি করাই এদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আর কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাতে কলমে শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র শিক্ষা। এসমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখা পড়ার নামে হাতে কলমে কিছু দক্ষতা অর্জন করে এবং এর মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে দেখা যায়, ধর্ম ও বিজ্ঞানের অবস্থান দুই মেরুতে হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিষ্টার এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেও পর্যন্ত ধর্মীয় বিশ্বাসে অনুগত এবং কুসংস্কারে পরিপূর্ণ থাকতে দেখা যায়। তারা শুধু সাক্ষর জ্ঞান লাভ করে, তাদের সাথে অক্ষর জ্ঞানশুন্যদের; মননশীলতা, যুক্তি ও বিবেক বোধ এবং চিন্তার জগতে তেমন কোন পার্থক্যই লক্ষ্য করা যায়না।

পার্থক্যের জায়গাগুলো সীমিত থাকে কথা বলার সময় শুদ্ধ ভাষার ব্যাবহার, ভাল পোশাক পরা, ভালো জায়গায় থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে, কেবল মাত্র যদি অক্ষর জ্ঞানশুন্যরা হয় নিম্নবিত্ত। আবার এই অক্ষরজ্ঞানশূন্যরা যদি উচ্চবিত্তের বা উচ্চমধ্যবিত্তের হয় তাহলে সাক্ষর জ্ঞানওয়ালাদের সাথে কোন ধরনের পার্থক্যই থাকেনা। বরঞ্চ অক্ষরজ্ঞান শুন্য নিম্নবিত্ত লোকজন অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশী শিক্ষিত হয়ে থাকে। কারন তারা নির্মম জীবনের পাতা উল্টিয়ে জীবন, জগত ও সমাজ সমন্ধে অনেক জ্ঞান অর্জন করে। জীবনের পাতা থেকে পাঠ করার অভ্যাস এদের আছে।

আমি উচ্চশিক্ষা লাভের প্রত্যাশায় কিছুদিন রাশিয়া ফেডারেশনের রাজধানী মস্কোতে অবস্থান করেছিলাম। সেখানকার ও বাংলাদেশের পাঠাভ্যাস সংক্রান্ত চিত্র ও তার ফলাফলের প্রতি-তুলনা করলে বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে বলে আমার মনে হয়। মস্কোতে আমি দেখেছি, ওখানকার পরিবহন বাস ও মেট্রো রেলগুলোতে প্রায় প্রত্যেক যাত্রীর হাতে বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ধরা থাকে। ওদের মনযোগ পুরো মাত্রায় নিবিষ্ট থাকে, ওগুলোর পাতায় পাতায়। মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় না যে, ওরা ট্রেনে বা বাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছে; বোধ হয় কোন লাইব্রেরীর ডেস্কে বসে সাহিত্য, সমাজ, দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও বিজ্ঞান চর্চা করছে।

ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, জ্ঞানতৃষ্ণায় ওরা যেন ছটফট করছে এবং আকন্ঠ পান করে যাচ্ছে জ্ঞানসুধা রস এবং পরিনামে আরো বেশী করে আরো বেশী করে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে। একদিনের একটা ঘটনা বলি, যাতে বিষয়টা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে উঠবে । মেট্রো রেলে যাতায়তের সময় দেখি, ষ্টেশনের এক কোনে দাঁড়িয়ে একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে; তার পায়ের কাছে একটি টুপি রাখা, সেখানে লোকজন রুবল(রাশিয়ান মুদ্রা) ফেলছে, তার বাম হাতে ধরা একটি কার্ড, যেখানে লেখা ‘পামাগাত মিনিয়া’ (আমাকে সাহায্য করুন) এবং ডান হাতে ধরা একটি বই। হাজার কোলাহলের মাঝখানেও লোকটি বই পড়ে যাচ্ছে । টুপিতে কতগুলো রুবল জমা হচ্ছে, সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।

বাংলাদেশের কোন জায়গায় এরকম দৃশ্য, আমরা সম্ভবত কল্পনাতেও আনতে পারবনা। মস্কোতে থাকাকালীন সময়ে আমি একটি ই-বুক রিডার কিনে সেখানে কিছু বাঙ্গলা ই-বুক ইন্সটল করে নিই। এবং রাশানদের দেখা দেখি, বাস ও মেট্রো রেলের সিটে বসে মনঃযোগ সহকারে পড়তে থাকি। অনেক রাশান আমাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়ে উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পড়ো, এটা কোন ভাষায় লেখা? উত্তরে আমি বলেছি, আমার মাতৃভাষা বাংলায় লেখা একটা উপন্যাস পড়ছি। তাদের কেউ কেউ আমার পিঠ চাপরে দিয়েছে, অনেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, দুই একজন যেতে যেতে বার বার আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে।

আমি তাদের এরকম উষ্ণ আচরনে মুগ্ধ হয়েছি, উৎসাহিত বোধ করেছি এবং লাভ করেছি অনুপ্রেরনা। মস্কোর এধরনের চিত্রের প্রতিতুলনায়, বাংলাদেশের কোন চিত্রের বর্ণনা করার প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। কারন এ সমন্ধে আপনাদের জানার পরিমান আমার জানার চেয়ে কোন পরিমানে নূন্য নয়। এখানে শুধু আমার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করব। মস্কো থেকে ফেরার কিছুদিন পরে, আমি বাসে চেপে খিলক্ষেত থেকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম।

আমার হাতে একটি বই ধরা ছিল, এবং মস্কোর রেশ কিছুটা থেকে যাওয়ার ফলে- সিটে বসে পড়ছিলাম। আমার পাশের সিটটি খালি পড়ে ছিল, কিছুক্ষন পরে একটি শুস্ক মুখের লোক এসে আমার পাশের সিটটি অধিকার করে বসল। এবং লোকটি হঠাৎ করে কোন ধরনের ভদ্রতার বালাই না দেখিয়ে; আমার নিকট থেকে বইটি, একরকম ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত গতিতে বইয়ের পাতা উল্টাতে শুরু করে। আমি সবিস্ময়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকি । পাতা উল্টানো শেষ করে, সে বইটি আমার কোলের উপর ছুড়ে মারে।

আমি খুব বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করি; আপনি বইটির মধ্যে যা খুঁজলেন সেটি কি পেয়েছেন? তখন সে তার মুখের গম্ভীর ভাবটি বজায় রেখে বলল, দেখলাম; বইটির মধ্যে ইসলাম বিরোধী কোন কিছু লেখা আছে কিনা। আমার মনে হল সে যদি, বইটির মধ্যে ইসলাম বিরোধী কোন কিছুর অস্তিত্ব টের পেত, তাহলে সে সম্ভবত আমাকে ছিড়ে ফেলত। যা হোক বইটির মধ্যে ইসলাম ধর্ম বিরোধী কোন কিছু লেখা না থাকার কারনে আমি ছিড়ে যাওয়া থেকে রেহাই পেলাম। বলে রাখা ভাল বইটি ছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা বইয়ের অনুবাদ, ’কেন আমি ধর্মে বিশ্বাস করিনা’। এখন আসি ফলাফলের প্রতি তুলনায়।

মস্কোতে অবস্থান কালে আমি সেখানে কোন ধরনের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী, নারী –পুরুষ বৈষম্যের প্রকট রূপ, এবং সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাইনি। আরেকটি বিষয় হল তারা সকল ধরনের প্রতিকূলতাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। এবং উচ্চকিত, উদার, উজ্জ্বল, সজীব এবং প্রানবন্ত ভাব সবার মাঝে অঙ্কিত; এবং নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছ সামনের দিকে। এখন বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাই, এখানে দেখি ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার, সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসবের ভারে আমাদের দেশের মানুষ চলবে তো দূরের কথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছেনা।

রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবকে অনেক পিছনে ফেলে, বিশ্বে যখন তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে এবং এর প্রভাবে আগামী কাল সকালে বিশ্ব ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সঠিক করে বলা যাচ্ছেনা; ঠিক এমনি সময়ে আমাদের দেশের জনগন রোগ-ব্যাধিতে, তাবিজ-কবজ, মাদুলী, গাছের শিকড় শরীরে বহন করে চলেছে। এখনো আমরা ভূত-প্রেতের ভয়ে, রাত্রি বেলায়; বাশঝাড়, বট-গাছ, শশ্মান ইত্যাদির সামনে দিয়ে যেতে ভয় পাই। ভাবতে বড়ই অদ্ভূত লাগে যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ যখন, মহাকাশ চষে বেড়াচ্ছে; আমাদের দেশের মানুষ তখন অতি পরিচিত জায়গায়ও রাত্রির অন্ধকারে, অনেক সময় দিনের বেলায়ও জীন ও ভূতের ভয়ে যেতে পারেনা। আমাদের দেশের মানুষ সবসময় রহস্যময় ও অতিপ্রাকৃত শক্তির ভয়ে আছন্ন হয়ে থাকে এবং সবকিছুতে তাকে দায়ী মনে করে, তার উপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে থাকে। আর আমার দেশের ভন্ড রাজনীতিবিদরা এটাকে ব্যাবহার করে, তাদের সকল অপকর্মকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে এবং এটাকে পুঁজি করে বার বার সিংহাসনে বসে তাদের শোষণের পথ রাখে পরিষ্কার।

আর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ও এই সুযোগে তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগীতায় আমাদের দেশের জনগনকে দলিত মথিত করে, নিঃশেষ করে ফেলে। এমতাবস্থায় বাঙ্গালীর পাঠাভ্যাস অর্জন করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া আশু কর্তব্য বলে আমার মনে হয়। জড় পদার্থের মত বসে না থেকে আমাদের পুরো দুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়াতে হবে মনের সকল দরজা জানালা খুলে দিয়ে। মনের সকল কালিমা, গ্লানি মুছে ফেলে আমাদেরকে সকল শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে, মাথা উচিয়ে দাঁড়াতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।