আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুকূপ

যাযাবর নানাবাড়িতে যাওয়া হয় না আজ প্রায় ১০ বছর। অথচ একসময় বছরে অন্তত একবার না গেলে কেমন যেন অতৃপ্তি থেকে যেত। বেশির ভাগ সময় ঈদের ছুটিতে আমরা সব মামাত খালাত ভাই-বোনেরা একসাথে হতাম। ঝাকে ঝাকে মৌমাছির মত আমাদের সব ভাই-বোনেদের কোলাহলে সারা বাড়ি থাকত মুখরিত। স্কুল নেই,পড়ালেখার ঝামেলা নেই, আর মা-খালারাও নিজেদেরকে পেয়ে আমাদের দিকে নজর দেয়ার সময় পেত না।

সেই সুযোগে আমরা মাঠে-ঘাটে,বনে-বাদরে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেরাতাম। কখনও জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা,কখনও নদীতে ঝাপাঝাপি,আবার কখনও বৃষ্টিতে ভিজে তাঁরাকান্দির সার কারখানা দেখতে যাওয়া, সবি চলত দুর্বার গতিতে। একবার বন্যার সময় নানাবাড়িতে ছিলাম। আমার তখন ১০/১১ বছর বয়স। বাড়ির চারিদিকে শুধু পানি আর পানি।

কোনও কিছু কিনতে চাইলে যেতে হোত বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে সোঁনামুই বাজারে। পানিতে চলার তখন একমাত্র বাহন ভেলা(কলাগাছ দিয়ে তৈরি একপ্রকার নৌযান)। আমার সৃতিশক্তি খুব বেশি ভাল না তারপরও এই সৃতিটুকু আমার মস্তিষ্কে একদম অক্ষত অবস্থায় আছে। একদিনের ঘটনা, আমার মামাত বোন আছমা আমার চেয়ে প্রায় দুই বছরের বড়, ওকে বলা হল বাজার থেকে সাবান আনার জন্য। ও যখন ভেলা নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তখন আমিও বায়না ধরলাম ওর সাথে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে নিবে না। অনেক চাপাচাপির পরেও যখন ও রাজি হল না তখন আমি অনেকটা ব্যথিত মনে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার এই অসহায় অবস্থা লক্ষ করে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট আরেক মামাত বোন বুদ্ধি দিল আরেকটি ভেলা নিয়ে আছমার পিছু নেয়ার। নিজেকে সাহসী প্রমান করার এই সুযোগ আমি হাতছারা করলাম না। আসেপাশে কাওকে না দেখে আমি আর আকলিমা ভেলা নিয়ে রওয়ানা দিলাম।

আছমা প্রথমে আমাদের লক্ষ্য করেনি, যখন করেছে তখন আমরা বাড়ি থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি। আমাদের দেখে ও রীতিমত হতভম্ব। বার বার হাত ইশারা করে বাড়িতে ফিরে যেতে বলল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমরা যখন ফিরছিই না তখন আছমা ভেলা নিয়ে উল্টো আমাদের দিকেই রওয়ানা দিল।

আছমার ভেলা যখন আমাদের ভেলার খুব কাছাকাছি তখন আচমকা আমি পা পিছলে পানিতে পরে গেলাম। পানির নিচের সেই মুহুর্তটুকু আমার এখনও মনে আছে, চারিদিকে শুধু সাদা আর সাদা, নিঃশাষ নিতে পারছিলাম না। নিঃশাষ নেয়ার জন্য হা করতেই মুখে গল গল করে সব পানি ডুকে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই পায়ের তলায় আছমার হাতের স্পর্শ পেলাম।

আছমা সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে উপরের দিকে ঠেলে দিল। আর আমি দুই সেকেন্ডের জন্য পানির উপরে ভেসে উঠলাম। ভেলা তখন আমার হাতের নাগালের সামান্য দুরে। আকলিমা ভেলা নিয়ে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছিল। আবার ডুবে গেলাম।

তবে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় আমি ভেলা ধরে ফেলি। আমি মরছিলাম পানিতে ডুবে আর আছমা মরছিল আমাকে বাঁচাতে গিয়ে। আল্লাহর অশেষ রহমতে শেষ পর্যন্ত আমরা দুইজনেই বেঁচে ফিরি। আমার এই লেখা সেই অসীম সাহসী মামাত বোনকে উদ্দেশ্য করে যার কল্যাণে আজও এই অসম্ভব সুন্দর পৃথীবির সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।