শুক্রবার বিকালে উদ্ধারের পরপরই তাকে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়েই ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ১৯ বছর বয়সী এই তরুণী আশঙ্কামুক্ত।
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ধ্বংসস্তূপে কারো সন্ধান পেয়ে জীবিত বের করে আনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা আর প্রার্থনায় সাভারের রানা প্লাজা মুহূর্তের মধ্যে হয়ে পড়ে লোকে লোকরণ্য। এর আগে জীবিত পেয়েও শাহীনা আক্তারকে উদ্ধারের ব্যর্থতার কথা মনে রেখে এক ঘণ্টার মধ্যেই এবার অভিযান শেষ করলেন উদ্ধারকর্মীরা।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সেনাবাহিনীর মেজর মোয়াজ্জেম জানান, ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্বিতীয় তলা ও বেইজমেন্টের মাঝের অংশের কংক্রিটের স্তূপ সরানোর সময় গোঙানির শব্দ পান তারা।
সঙ্গে সঙ্গে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার বন্ধ করে আটকে থাকা মানুষটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। জানতে পারেন, ১৭ দিন ধরে ভেতরে আটকা পড়ে থাকা মেয়েটির নাম রেশমা।
রেশমার বাবার নাম আনসার আলী। ঘোড়াঘাট উপজেলার কাঠিগাতি এলাকায় তাদের বাড়ি।
ধসের সময় তিন তলায় নিউ ওয়েভ বটমস কারখানায় কাপড়ের স্তূপে চাপা পড়েছিলেন তিনি।
এ খবর পেয়েই সাভার সেনানিবাসের জিওসিসহ উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে ছুটে যান। রেশমার জন্য খাবার, পানি ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স ও স্ট্রেচারও নিয়ে আসা হয় সেখানে।
বিকাল ৪টা ২৬ মিনিটে রেশমাকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসা হলে উপস্থিত সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
অনেকেই এ ঘটনাকে উল্লেখ করেন অবিস্মরণীয় বলে।
অ্যাম্বুলেন্সে করে রেশমাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ... অনেক কষ্ট করে লাঠি দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে চিপা দিয়ে নিচে নামছি। অনেক চিৎকার করেছি... কেউ শুনতে পায়নি।
”
মেজর মোয়াজ্জেম জানান, বেজমেন্ট খোঁড়ার সময় হঠাৎ ওয়ারেন্ট অফিসার রাজ্জাক একটি পাইপ নাড়াতে দেখতে পান। গর্ত দিয়ে কাছে গেলে রেশমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
পরে ওয়রেন্ট অফিসার রাজ্জাক জানান, একটি গর্ত করা হলে সেখান দিয়ে তিনি দেখতে পান কেউ একজন একটি ছোট পাইপ নাড়ছে। তিনি আওয়াজ দিলে মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠে, “স্যার আমাকে বাঁচান।
এ সময় ওই সেনাসদস্য কোনো খাবার বা পানি আছে খেয়েছে কি না জানতে চাইলে রেশমা জানান, মেঝেয় পড়ে থাকা পানি ও তার সহকর্মীদের ফেলে যাওয়া খাবারে ১৫ দিন পর্যন্ত চলেছেন।
তবে গত দু’দিন তিনি অভুক্ত অবস্থায় আছেন। এরপর তাকে গর্ত দিয়ে পানি ও খাবার দেয়া হয়। উদ্ধারের পর রেশমা সম্পূর্ণ অক্ষত থাকলেও তাকে দুর্বল দেখাচ্ছিল।
মেয়ের সন্ধান পাওয়ার খবরে সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে লাশের জন্য অপেক্ষারত মা জোবেদা খাতুন তাৎক্ষণিকভাবেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।
সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর হাসপাতালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জোবেদা বলেন, ভবন ধসের মাসেই রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমসে রেশমা কাজ নিয়েছিল।
সাভার বাজার রোডের মনসুরুল আলম নুরুর বাড়িতে তারা ভাড়া থাকতেন। স্বামী সবুজ মিয়ার সঙ্গে আড়াই বছর আগে ওই বাসায় ওঠলেও বছরখানেক আগে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর থেকে রেশমা ওই বাসায় একাই থাকতেন।
গত ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন নয় তলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড, রেড ক্রিসেন্টসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।
সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল জীবিত কাউকে উদ্ধার করা হয়েছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে। রাতে শাহীনা আক্তার নামে এক নারীকে জীবিত পাওয়া গেলেও জীবিত উদ্ধার করা যায়নি তাকে। লোহা কাটার মেশিনের স্ফূলিঙ্গ থেকে আগুন লেগে গুরুতর আহত হন উদ্ধারকর্মী এজাজ উদ্দিন কায়কোবাদ, যিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
উদ্ধার কার্যক্রম শুরুর ১১০ ঘণ্টা পর ওইদিনই জীবিত কাউকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরুর ঘোষণা দেন অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী।
সেদিন পর্যন্ত ৩৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অভিযান শুরুর পর শুক্রবার নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধারের খবর শুনে হেলিকপ্টারে সাভারে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে হাসপাতালে পৌঁছে তিনি চিকিৎসকদের কাছে রেশমার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন এবং রেশমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় চিকিৎসাধীন রেশমা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে তাকে দেখা গেছে।
১৭ দিন ধরে অন্ধকার ধ্বংসস্তূপে ‘অসীম প্রাণশক্তি নিয়ে’ টিকে থাকা রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি রানা প্লাজার কংক্রিটের স্তূপের নিচে আর কেউ জীবিত থাকলে তাদেরও উদ্ধার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
দীর্ঘ সময় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে বেঁচে ফিরে শুধু বিস্ময়েরই জন্ম দেননি, বেঁচে থাকার সংগ্রামের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন রেশমা। রেশমা বেগমের চেয়ে বেশি সময় এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে মাত্র দুই জনকে।
এর মধ্যে একজন পাকিস্তানের নাকাশা বিবি, যিনি পঁচা খাবার আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন ৬৩ দিন। অন্যজন হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক। ২৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল।
পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের পানি খেয়ে ইভান্স বেঁচে ছিলেন।
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে রেশমা বেগমের জীবিত উদ্ধারের ঘটনাটি প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রধান শিরোনাম হয়েছে শুক্রবার।
বিকাল ৪টা ২৬ মিনিটে রেশমাকে নিরাপদে বের করে আনার পরপরই বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে ওঠে বাংলাদেশি এই তরুণীর টিকে থাকার সংগ্রাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।