আমরা শুধু আপন মানুষ খুঁজি, আপন মানুষদের খুঁজতে হয় না, তারা পাশেই থাকে !! গভীর রাত। গভীর ঘুমে মানুষ। দূরপাল্লার বাসে যারা যাত্রী তারাও থাকেন ঘুমে। ট্রেনের শত শত যাত্রী তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউ হয়তো হেলে পড়ছেন পাশের জনের ওপর।
কেউ ধাক্কা খেয়ে চোখ খুলে আবার ঢলে পড়ছেন। ঝক ঝকা ঝক শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে ট্রেন চলছেই।
ট্রেনটির নাম ‘উদয়ন’।
রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে ভোরে তার সিলেট আসার কথা। সেই ট্রেনে আছেন শত শত যাত্রী।
হরতালের কারণে ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা আরো বেড়েছে। কারণ, সাধারণত পিকেটাররা ট্রেন থামিয়ে ভাংচুর করবে না- এমনটিই ধারণা।
ট্রেনটির চালক এবং এর পাঁচশতাধিক যাত্রী তখনও জানতেন না তাদের জীবন কতটা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
রাত সাড়ে ৩ টা। বাংলানিউজের সংবাদ দেয়া শুরু হবে যখন যা ঘটে তা তখন।
এমন প্রস্তুতিইে বাসায় আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরে বের হতে হবে হরতালের সংবাদ কভার করতে। বালিশের পাশে রাখা আছে মোবাইল ফোন।
ঘড়ির কাটায় যখন ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট। তখন একটি কল এলো আমার মোবাইলে।
ঘুম ভেঙ্গে সাথে সাথে ফোনটি তুলে কানে ধরলাম। ও প্রান্তে থেকে একজন বললেন, ‘‘আমি অমুক বলছি, কুলাউড়া থেকে। ’’ আমি বললাম জি বলুন তিনি বললেন, ‘‘কিছু দৃর্বত্তদল হরতালের স্লোগান দিয়ে বরমচাল-কুলাউড়া এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। একটু পরে এ লাইন দিয়ে উদয়ন আসবে ঢাকা থেকে। ’’
এবার আমি বললাম ‘আপনি সত্যিই বলছেন তো’’।
তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে বের হয়ে দৃষ্কৃতিকারীদের রেল উপড়ে ফেলার ঘটনাটি দেখেছেন, তাই নিশ্চিত’’।
এবার আমি বললাম ‘‘আপনার মোবাইল ফোন হাতে রাখুন আমি আপনাকে ফোন দিচ্ছি- বলেই লাইন কেটে দিলাম।
তখন ঘড়ির কাটায় ৩ টা ১৭ মিনিট হবে।
ক্ষণিক মহূর্তে অনেক ভাবনা এলো। এই ইন্টারসিটি রেলে আমিও একসময় যাত্রা করেছি।
হয়তো শত শত রেল যাত্রীর মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর যদি তারপর এভাবে দূর্ঘটনায় পড়ি। তাৎক্ষণিক গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো।
এরকম একটি বড় দূর্ঘটনার সংবাদ আমি প্রথম করবো। এটা আমার কৃতিত্ব হতে পারে।
হয়তো কারো বাহবা পেতে পারি। কিন্তু এই বাহবা তেমন কিছুই নয়। যেখানে শত শত মানুষের জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন। এখানে মানবিকতার প্রশ্ন। এখানে আমার মানুষ ধর্মের প্রশ্ন।
এই ট্রেনে হয়তো আমার মতো অসংখ্য তরুণ আছে যাদের জন্য বাসায় তাদের মা না ঘুমিয়ে জেগে আছেন ছেলে বাসায় ফেরার পর ঘুমাবেন বলে; হয়তো আমার আদরের ছোট ভাই বোনের মতো অসংখ্য শিশু আছে যারা দেশের আগামীর প্রজন্ম।
এমন চিন্তা করে নিউজের কথা একধরণের ভুলেই গেলাম। আমার কাছে তখন শতশত মানুষের জীবন বাঁচানোর অজানা তাগিদ।
৩ টা ২০ মিনিটে ফোন দিলাম সিলেট রেলস্টেশনের জিআরপি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে। বাংলানিউজে নিউজ করতে গিয়ে তার সঙ্গে অসংখ্যবার কথা হয়েছে।
সেই সুবাদে আমার নাম্বারটি তার মোবাইলে সেইভ করা আছে।
উনিও তখন ঘুমাননি। প্রথম কলের পরই আমার ফোন ধরে কেন ফোন দিয়েছি জানতে চাইলেন। তাকে তড়িঘড়ি করি জানালাম ঘটনাটি। উনিও চিন্তিত হয়ে সাথে সাথে কুলাউড়া জিআরপি পুলিশের ওসি স্বপন বড়–য়াকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালেন।
আমিও স্বপন বড়–য়ার নাম্বার তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে ফোন দিলাম। স্বপন বড়–য়া ছুটে গেলেন স্টেশনে । স্টেশন মাস্টার তাকে জানালো ‘‘না তো এরকম কোনো সংবাদ পাই নি। তাহলে খোঁজ নিতে হবে। ’’
এবার আমার মোবাইলে ফোন এলো স্বপন বড়–য়ার।
ফোন করে উনি বললেন, ‘দেখুন এরকম অনেক ভুয়া ফোন আসতে পারে। কেউ ভুয়া সংবাদ দিয়ে পুলিশকে হয়ারানীও করতে পারে। ’’
আমি তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম ‘‘দেখুন অনেক মানুষ জীবনমৃত্যুর সম্পর্ক। আপনারা দ্রুত কিছু করুন। ’’
এবার তিনি বললেন, ‘‘আপনি যে স্পটের কথা বলছেন সেখানে যেতে অনেক সময় লাগবে।
আমাদের ট্রলিও নেই। তাই টর্চ হাতে করে লোক পাঠাচ্ছি। ’’
আমি তখন বিছানা ছেড়ে চেয়ার টেবিলে এসে বসে গেলাম। খুবই চিন্তিত।
কিছু সময় পর আবার ফোন দিলাম স্বপন বড়–য়াকে।
তিনি বললেন, ‘‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি। আপনাকেও জানাবো। একই সঙ্গে ট্রেনটিকে খুবই আস্তে চালিয়ে আসতে বলা হয়, কারণ সত্যিই যদি এরকম হয় তাহলেতো শত শত প্রাণ যাবে। কারণ এই রোডে ট্রেন দ্রুত গতিতে চলে। ট্রেনটি এখন খুব ধীরে আসছে।
যাতে দূর্ঘটনা এড়ানো যায়। ’’
এর মধ্যে ‘‘গভীর রাতে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছে হরতাল সমর্থনকারীরা’’- আমার সোর্সের বরাত দিয়ে একটি নিউজ লিখে ফেললাম।
৩ টা বেজে ৪৭ মিনিটে অফিসে নিউজটি ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়ে নিউজরুমে ফোন করি। ফোন ধরে নিউজটি মেইলে এসেছে বলে আমাকে নিশ্চিত করা হয়।
এরপর ভোর রাত সাড়ে ৪ টায় স্বপন বড়–য়াকে ফোন দেয়া মাত্রই তিনি বললেন, ‘‘মাত্র দুই মিনিট আগে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ ৬ টি বগি লাইনচ্যূত।
ট্রেনটি আস্তে আসতে বলায় বড় ধরণের প্রাণহানি থেকে বাঁচা গেছে। তবে যাত্রীরা সামান্য আহত হয়েছেন। পরে ফোন দিচ্ছি। উদ্ধার কাজে যাচ্ছি বলেই লাইন কেটে দেন তিনি। ’’
সাথে সাথে ট্রেন লাইনচ্যুত নামে একটি নিউজ স্বপন বড়–য়ার বরাত দিয়ে লিখে ফেলি।
রাত ৪ টা ৫৪ মিনিটে নিউজটি অফিসে পাঠিয়ে ফোন দেই। ও প্রাপ্ত থেকে বলা হয় ‘মেইল এসেছে’।
এর মাধ্যমে এ ঘটনা প্রথম বাংলানিউজ ব্রেক করে। যা অন্যান্য মিডিয়া অনেক পরে বাংলানিউজের মাধ্যমে জানতে পেরে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে নিউজ করে।
এদিকে আমি বিষয়টি বড় ঘটনা হওয়ায় ৫ টা ২৪ মিনিটে বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর ভাইকে এসএমএস করে জানাই।
সাথে সাথে উনি ফিরতি এসএমসে পাঠান আমার কাছে। ‘ওকে ’ লিখা এই এসএমএস আমাকে লিখেন তিনি। খুব আশ্চর্য হতে হয় বিশ্বের মিডিয়ায় এটি খুবই ব্যতিক্রম যে, এতো রাতেও সজাগ আছেন এডিটর ইন চিফ। শুধু সজাগই নন তার ‘ওকে’ লিখা এসএমএসে নিউজ দ্রুত পাঠাতে একধরণের তাগিদও ছিলো। যা আমি অনুভব করলাম।
বুঝলাম আমার এসএমএস পেয়ে হয়তো তিনি ইতোমধ্যে নিউজ রুমের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন। বাংলাদেশে একরম এডিটর ইন চিফ পাওয়া আর কতজন সাংবাদিকে ভাগ্যে জুটেছে জানিনা।
তবে বলবো, আলমগীর ভাই এর কাছ থেকে এরকম রিপ্লে এটি নতুন কোনো কিছু নয়। আরও অনেকদিন গভীর রাতেও এসএমএস করলে সাথে সাথে রিপ্লে এসেছে তার কাছ থেকে। বাংলাদেশে অনলাইন জার্নালিজমের শুধু পথিকৃৎ নন তিনি।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টালের সদা সক্রিয় নিউজ রুম চালুর পথিকৃৎ।
এবার আসি বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ভাইয়ের কথায়। মনে আছে, বাংলানিউজে ২০১১ সালের জুন মাসে আমার যখন নিয়োগ হয়েছিলো তখন মেনন ভাই একটি কথা বলেছিলেন, ‘‘সাব্বির, বাংলানিউজে কাজ সব সময়। বাংলানিউজের সাংবাদিকদের ঘুম নেই’’।
তাৎক্ষণিক আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম আর মনে মনে ভেবেছিলাম ‘তাহলে কি আমি রাতে আর ঘুমাতে পারব না’’।
পরক্ষণেই তিনি বললেন, ‘ঘুমানো যাবে তবে সে ঘুমও যেনো জেগে জেগে ঘুমানোর মতো হয়। ’’
মঙ্গলবারের ঘটনাটি সেরকমই। আমি ঘুমিয়েছিলাম ঠিকই । কিন্ত জেগে ঘুমানোর মতো।
আজ আমার এতোই আনন্দ লাগছে।
অতীতে কোনো নিউজ করে আমি এতো আনন্দ পাইনি। সত্যিই তো এতো মানুষের জীবন মরণ ছিলো এখানে জড়িত।
আমি বিষয়টি প্রথম জেনে প্রথমেই পুলিশকে জানানোর কারণে ট্রেনটি আস্তে আস্তে আসতে বলা হয়। আর এজন্য ট্রেন বড় দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায়। বেঁচে যায় অনেকগুলো প্রাণ।
ভোরে জিআরপি সিলেট রেল স্টেশনের ওসি ও কুলাউড়ার জিআরপি পুলিশের ওসি দু’জনই ফোন করে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন, বললেন ‘‘ আপনার তথ্য পেয়ে ট্রেনটি আস্তে আসতে বলায় আজ বড় দূর্ঘটনা থেকে বাঁচলো একটি ট্রেন। বাঁচলো অনেকগুলো জীবন’’।
কারণ ২০ ফুট রেল লাইন উপড়ে ফেলায় এ দূর্ঘটনায় প্রাণহানি কত বেশি হতো তা সহজে অনমানও করা যাবে না।
১২ ঘন্টা পর মঙ্গলবার বিকেলে ট্রেন উদ্ধার ও রেললাইন মেরামত করে যোগাযোগ স্বাভাবিক করা হয়। আর আমি আমার ছোট্টা সাংবাদিকতা জীবনে একটি বড় তৃপ্তি লাভ করলাম।
এই অনুভূতি গুলো আমার প্রিয় এডিটর ইন চিফ এবং হেড অব নিউজের কাছে শেয়ার করলাম। ধন্যবাদ।
লিখেছেন আমার খুব কাছের বন্ধু ও সাংবাদিক
সাবিবর আহমেদ
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সিলেট। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।