আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাজউদ্দিন কী উপেক্ষিতই থাকবেন?

গাজীপুর দর্পণ তাজউদ্দিন আহমদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ লেখা ছাপতে আগ্রহী বিধায় আমাকে কিছু লেখার অনুরোধ করেছেন। আমি লেখতে গিয়ে মনে করেছি যে লেখাটি ছাপতে দিচ্ছি তা বর্তমানে আমাদের সমাজের অসহনশীলতার নমুনা অত বেশি বিগড়ে গেছে যে সময় সময় আমাকে কিংবা পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতা করতে হতে পারে। যদিও তাজউদ্দিনের দেশে তথ্য অধিকার আইন পাশ হয়েচে এবং কে কতটুকু তথ্য কোথা থেকে পেয়েছেন তা নিজেরাই যাচাই করলে ভাল হবে। স্থানীয় পরিচয়ে একই জন্মভুমিতে কাপাসিয়ায় আমি জন্মেছি বলে গর্বিত বোধ করি। আমার পূর্বে তাজউদ্দিন আহমেদ কাপাসিয়ায় জন্মগ্রহণ করে ধন্য করে গেছেন এই জাতিকে।

আমার একটি রাজনৈতিক পরিচয় থাকাও একটি সমস্যা আর দশজনের মত বিশেষ করে আমি যাদের মুল্যায়ন পার্টি বলে ঠাট্রা করি। কারণ দীর্ঘ জনম ধরে শুনে আসছি তাজউদ্দিনের কী মুল্যায়ন হয়েছে আমাদের দেশে? আমি বিস্তারিত বিষয়টি এই লেখায় লেখতে না চাইলেও অনেকে বলতে চান তাজউদ্দিন আমাদের দেশে উপেক্ষিত হয়ে আছেন। এই কথা সত্য নয় এমন সাক্ষ্য কাঠগড়ায় দাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা নিতান্ত বোকামী। যদি তাই না হবে তাহলে কেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার পরও তার জন্য কিছুই হতে পারে না। এমনকি তার জেলায়ও অনেকের নামে অনেক কিছু হয় তার নামে হয় না।

এই দেশে সম্প্রতি কত রকমের গবেষণা দেখা যায় তার হিসাব কিতাব নাই। যারা এসব গবেষণা করে কি যে তাদের পরিচয় তা ভাবতেও ভয়ংকর আতংক মনে হয়। তারপরও থেমে নেই শুভ বুদ্ধির মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি ’বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’ নামে একটি গবেষণামূলখ গ্রন্থ লিখেছেন তাজউদ্দিনকে ঘিরে। আরো পূর্বে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম. আর. মল্লিক একই রকম একটি গবেষণা উপস্থাপন করেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে।

মুনতাসীর মামুনও গবেষণা করেছেন ’তাজউদ্দিন যেভাব তাজউদ্দিন হয়ে উঠেছেন’ তবে কার এজেন্ডা নিয়ে তা ভাবনায় ফেলে দেয়। তিনি বলতে চান তাজউদ্দিনের পারিবারিক রক্ষণশীলতা, তার মৌলভী পিতার গন্ডী, মক্তবের পড়াশুনা আর ডায়রীতে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির জল আইল উপচিয়ে পড়ার বর্ণণা তাজউদ্দিনকে সামন্তকালের গন্ডীতে আটকে রাখে, আর এই যন্ত্রণা নিতান্ত উপেক্ষিত করার চেষ্টা। তারা কখনো দেখেননি তাজউদ্দিন কিভাবে প্রাইমারী শিক্ষা শেষে তিনজন বৃটিশ বিরোধী নির্বাসিত বিপ্লবীর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। রাজেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্তী, বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধায়, মণীন্দ্র শ্রীমানী এই তিন জনের নিকট থেকে তিনি পড়ে ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিভিন্ন মনীষীদের জীবন কাহিনী। যা তার চিন্তার জগতে খুলে দিয়েছিল এক নতুন দিগন্ত।

বিপ্লবীরাই তৈরী করেন তার চেতনায় শোষন বৈষম্যহীন সমাজ ভাবনার। তিনিই হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার মহান নেতা। তারই বর্ণনা, তাজউদ্দিনকে একবার ৪/৫ দিন পাওয়া যাচ্ছে না। লিলির (জহুরা তাজউদ্দিন) তথ্য মতে বঙ্গবন্ধু আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ নারায়নগঞ্জে খোঁজ নিতে গেলেন সামাজিক স্কুলে ( সর্বশেষ এই প্রতিষ্ঠানটি মোজাফফর ন্যাপের অধীনে ছিল, এখানেই রাজনৈতিক প্রশিক্ষন হতো বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলের)। তাকে সেখানেই পাওয়া গেল।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিনের সাথে দেখা করেননি। কেবল সেরনিয়াবাত দুর থেকে দেখে এলেন। কারণ তাজউদ্দিন সেখানে সেক্রেটারিয়েট কাজ করছিলেন একটি কমিউনিস্ট গ্রুপের। এখানেই তার বামপন্থার পরিচয় জোটে। আর এই ম্যাচিউরিটির কারণে তিনি বাকশালের ট্রেনে উঠেননি।

বাকশাল ট্রার্ণ করার পূর্বেই তিনি পদত্যাগ করেন মন্ত্রিসভা থেকে। যারা বাকশাল গঠন করেছেন তারাই বাকশাল ত্যাগ করেছেন এমনকি এখনো তারাই বাকশালকে পাপ মনে করেন। এছাড়া বাকশালে যোগদানকারী রাজনৈতিক ফ্রন্টের একাধিক অংশ বাকশাল গঠনকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে তাজউদ্দিন কিভাবে বুঝতে পেরেছিলেন বাকশালের পরিণতি তা নিয়ে গবেষণা না করে যারা তকে সামন্তবাদীর খাচায় আটকে রাখতে চান তারা এখনো ভুল বুঝতে পারেনি। কামাল হোসেন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৫৬ সালে ছয় দফা দাবি প্রকাশ করেন, এর আগের বছরেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন।

যত দিন আওয়ামী লীগের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, তত দিন তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দল গণআজাদি লীগ ছাড়েননি। এই বইয়ের লেখক লিখছেন, ‘যা হোক, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়) ঢাকা জেলার সম্পাদক, ১৯৫৫ সালে সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, ১৯৬৪ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। ’ আর এখানেই মুনতাসীর মামুন গংদের ভাগড়া বেধে গেছে। তাজউদ্দীন নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিগুলোর মধ্যে তিন খণ্ড আপাতত প্রকাশ করেছেন ( প্রকাশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ডায়রীগুলি রক্ষিত ছিল কমিউনিস্ট নেতা বদরউদ্দিন উমর এর নিকট ) তাঁর সুযোগ্য কন্যা সিমিন হোসেন রিমি।

দুঃখের বিষয়, তাঁর ডায়েরির শেষ খণ্ড, যেটি তিনি জেলে বসে লিখছিলেন, সেটি তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আর পাওয়া যায়নি। তিনি কেন কৃষকের কথা ভেবে ডায়রী লিখেছেন কামাল হোসেন তা দেখিয়ে দিয়েছেন বাজেট বক্তৃতা ( বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত প্রথম বাজেট ) থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত্ব করে ’এ দেশের মানুষের কষ্টের কাল শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে। জাতিকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। প্রয়োজনে একটু কম খেয়ে এবং একটু কম পরেও আগামী দিনগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলতে হবে। বড়লোকেরা খাবে, পরবে আর দরিদ্ররা কৃচ্ছ্রসাধন করবে, তা হতে পারে না।

সবাইকেই কৃচ্ছ্রসাধনা ভাগাভাগি করে নিতে হবে। ’ কিছুই না হওয়ার দৌড় থেকে বেরিয়ে তাজউদ্দিন প্রেমীদের উদ্যোগে তার নামে একটি ওয়েবসাইট চালু হয়েছে। বিভিন্ন ব্লগ সাইট হয়ে উঠছে পরিপূর্ণ। কিন্তু ওইসব রিসোর্স বেশির ভাগই ইংরেজিতে হওয়ায় এবং কথিত ডিজিটাল বলতে যদি কেবল টেবিলে একখানা কম্পিউটার সাজিয়ে রাখা বুঝায় তবে তবে তাজউদ্দিনের মুল্যায়ন করা খুবই মুশকিল। তাজউদ্দিন নিজে নিজেকে কেমন পরিচয়ে পরিচিত করে তুলেছেন তা প্রমাণ করার জন্য উপস্থাপন করা হলো মতামতসহ একটি অসাধারণ বক্তব্য।

ইতিহাস বড় অদ্ভুত । তার খাতায় খুব বড় করে লেখা থাকে কোন ঘটনার ফলাফল কিন্তু কখন কখন আস্তে করে ঝাপসা হয়ে আসে সেই ফলাফলের পিছনে ভূমিকা রাখা কোন গূরুত্বপূর্ণ আরেকটি ছোট ঘটনা । আমরা আস্তে আস্তে ভুলে যাই সেই ছোট ঘটনাকে । আর তাই ইতিহাসের পাতায় অবহেলায় আরো ঝাপসা হয়ে আসে তা । সেই রকম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঝাপসা হয়ে আসা একটি ঘটনা হল শিলিগুড়ি কনফারেন্স ।

আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার সময় অনেক কিছুই লেখি । লেখি আমাদের গণহত্যার কথা, আমাদের যোদ্ধাদের কথা, সেই যুদ্ধে দেশি বিদেশি অনেক রকম প্রভাবের কথা কিন্তু সেই ভাবে লেখা হয় না একটি সম্মেলনের কথা, সেই সম্মেলনে ছোটখাট এক নেতার দূরদর্শী এক ভাষণের কথা যা হয়ত তার পূর্বসূরী নেতার মত সেই অর্থে জ্বালাময়ী নয় কিন্তু বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ বাকিদের জন্য সেই ভাষণ ছিল বাতিঘরের মতই দিকনির্দেশক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের একাংশের কাছ থেকে দাবি উঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে যে কোন মূল্যে মুক্ত করে আনার , যে কোন মূল্যে । এমনকি এই দাবি শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে চাই না স্বাধীনতা চাই এমন হঠকারী বির্তকে রূপ নেয় । এছাড়া এই সময় পর্যাপ্ত ভারী অস্ত্র এর অভাবে বড় কোন অভিযান চালাতে না পারার কারনে মুক্তিবাহিনীতে একরকম হতাশা দেখা দেয় ।

এই দুই অযাচিত ঘটনা মুজিবনগর সরকার এর ভিতর ও বাইরে অস্থিরতার জন্ম দেয়। এইসময় মুজিবনগর সরকার এই আত্মঘাতী বির্তক নিরসনের জন্য ভারত সরকারের পরামর্শে তৎকালীন ৭০’এর নির্বাচনে নির্বাচিত সকল পূর্ব পাকিস্তানি এমপি এবং এমএনএ’দের এক সম্মেলনের আহ্বান করে। সম্মেলনের আয়োজনের দ্বায়িত্ব পড়ে কুমিল্লার কাজী জহিরুল কায়উম এর উপর এবং ভারতের প থেকে সমন্বয়কারী হিসেবে দ্বায়িত্ব পান ডিপি ধর (ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ রাজনৈতিক সচিব) । এই ব্যক্তিদ্বয় সম্মেলনের স্থান ঠিক করেন শিলিগুড়ি। এইসময় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনির কাছে নির্দেশ দেওয়া হয় যে কোন মূল্যে এমপি এবং এমএনএ দের কাছে এই সম্মেলনের সংবাদ পৌছে দিতে এবং তাদের নিরাপদে ভারতে যাতায়তের ব্যবস্থা করতে।

এমন কি এই নির্দেশও দেওয়া হয় যে কেউ যেতে অনিচ্ছুক হলে দরকার হলে তাকে জোর করে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। এই সম্মেলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে চাই এই স্লোগানের দাপটে নজরুল ইসলাম কিংবা ওসমানীর মত ব্যক্তিত্ব বক্তৃতা দেওয়ার সাহস করতে পারেননি। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ মঞ্চে উঠে সহজ ভাষায় যেই যুক্তি উপস্থাপন করেন তা ছিল আমাদের সেই কুয়াশাচ্ছন্ন সময়ে দারুন এক পথানির্দেশক। শিলিগুড়ি সম্মেলনের সেই ছোটখাট মানুষটা যেই বক্তব্য দিয়েছিলেন তাই আমাদের যুদ্ধের ইতিহাসের বাকি পথের শেষ ল ঠিক করে দেয়। আসুন আজ আমরা দেখি কেমন ছিল সেই ভাষণটা: (শিলিগুড়ী সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমেদের ভাষণ) “আমরা স্বাধীনতা চাই।

স্বাধীনতা পেলেই বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মাঝে পাব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি খোদা না করুন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে, তাইলে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েও স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে অমর ও চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তিনি একটি নতুন জাতির জনক হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত হবেন। ব্যক্তি মুজিব, ব্যক্তি নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান কেউ হয়ত বেঁচে থাকবেন না। একদিন না একদিন আমাদের সকলকেই মরতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকেও মরতে হবে। আমরা চিরদিন কেউ বেঁচে থাকব না। আল্লাহর পিয়ারা দোস্ত, আমাদের নবী(সঃ) ও চিরদিন বেঁচে থাকেন নি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় আজ পরম শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তেমনি, আমরা যদি বাঙ্গালীকে একটি জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, আমরা যদি বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক আরেকটি রাষ্ট্রের মানচিত্র স্থাপন করতে পারি, তাইলে সেই স্বাধীন জাতি এবং নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রভাত সূর্যের মত উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।

আমরা যখন বাংলাদেশ ছেড়ে যার যার পথে ভারত চলে আসি, তখন কিন্তু জানতম না বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন, না শহীদ হয়েছেন। ভারতে এসে দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমিও জানতাম না সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী কিংবা হেনা সাহেব (কামরুজ্জামান) জীবিত আছেন কিনা। আমি নিজেও বাঁচতে পারব এ কথাটি একবারও ভাবতে পারিনি। এখানে আসার পর যতন পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঘোষনা না করেছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কাছে বন্দী আছেন, ততন পর্যন্ত আমি মনে করতে পারিনি তিনি জীবিত আছেন। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, মেশিনগানের গোলাগুলির মধ্যে বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই একথা ভেবে এবং সম্ভবত মেনে নিয়েই তো আমরা নিজ নিজ প্রাণ নিয়ে চলে এসেছি।

বঙ্গবন্ধু মুজিবের ছায়া হয়ে তার পাশে আজীবন রাজনীতি করেছি, জেলে থেকেছি। তিনি আমাদের শিা দিয়েছেন দেশের জন্য জীবন দিতে। তিনি নিজেও বারবার বাংলার পথে প্রান্তরে বলেছেন, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য জীবন দিতে তিনি কুন্ঠিত নন। আজ যদি বঙ্গবন্ধু মুজিবের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাই, তাহলে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যেই আমরা পাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিছুতেই পাকিস্তানিদের কাছে তার নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করবেন না, আত্মসমর্পন করবেন না এবং করতে পারেন না।

এটাই আমার প্রথম ও শেষ বিশ্বাস। বাংলাদেশ যদি আজ এত রক্তের বিনিময়েও স্বাধীন না হয়, তাহলে বাংলাদেশ চিরদিনের জন্য পাকিস্তানি দখলদারদের দাস ও গোলাম হয়ে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানীর মর্যাদাও বাঙ্গালী কোনদিন আর পাকিস্তানীদের কাছে পাবে না। প্রভুভক্ত প্রাণীর মত আমরা যতই আনুগত্যের লেজ নাড়ি না কেন, পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের আর বিশ্বাস করবে না, বিশ্বাস করার কোন প্রশ্নই উঠে না। আর এই অধিক্তৃ পূর্ব পাকিস্তানে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রেসেডিন্ট হয়েও আসেন, তবু তিনি হবেন পাকিস্তানের গোলামীর জিঞ্জির পরান এক গোলাম মুজিব।

বাংলাদেশের জনগণ কোনদিন সেই গোলাম শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলে গ্রহন করবে না, মেনে নিবে না। আমার স্থির বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর পাকিস্তানীদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। বাঙ্গালী জাতির গলায় গোলামীর জিঞ্জির পরিয়ে দেবার পরিবর্তে তিনি নিজে বরং ফাঁসীর রজ্জু গলায় তুলে নেবেন হাসিমুখে। এটাই আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এটাই আমার ঈমান।

এ মূহর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া, আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আর কোন বিকল্প নেই। বাঙ্গালীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আর কোন অস্তিত্ব নেই, আর পরিচয় নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন না।

গোলামের পরিচয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসবেন না কোন দিন। জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করব। পরাধীন দেশের মাটিতে আমার লাশও যাতে ফিরে না যায় সে জন্য জীবিতদের কাছে আর্জি রেখে যাই। আমার শেষকথা, যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমরা বাংলার মাটিকে দখলদার মুক্ত করব। বাংলার মুক্ত মাটিতে মুক্ত মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমারা ফিরিয়ে আনব।

মুজিব স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসবেন এবং তাকে আমরা জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনব ইনশাল্লাহ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রাণ রার জন্য বিশ্ব মানবতার কাছে আমরা আকুল আবেদন জানাচ্ছি”। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের এই আবেগময়ী ভাষণের পর জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে শিলিগুড়ি কনফারেন্স গর্জে উঠেছিল। এভাবেই নিষ্পত্তি হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি বিভ্রান্তিমূলক ও আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রের। ( ভাষণ সংগ্রহ একাত্তরের রনাঙ্গন অকথিত কিছু কথা, লেখক: নজরুল ইসলাম) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.