বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে চতুর্থ সংশোধনী এক বিষ্ময়কর ঘটনা। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। আর সম্ভবত এর লক্ষ গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের উপায় হিসেবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করা।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের জন্য সংবিধান রচনা করা হয় এবং যে চেতনার আলোকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে সে গুলোকে রাষ্ট্রের মূলনীতি বলে স্বীকার করা হয়।
এগুলো হলো- বাঙালি জাতিয়তাবাত, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ একটি বুর্জুয়া ও সাম্প্রদায়িক দল থেকে জন্ম লাভ করলেও দলটি বিভিন্ন সময়ে এর আদর্শ ও নীতিতে যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধন করে। যেমন ১৯৫৫ সালে দলটি এর সাম্প্রদায়িক পরিচয় থেকে বের হয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। আবার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে সমাজতান্ত্রীক অর্থনীতিকে অন্যতম লক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। এই পরিবর্তন গুলো ছিলো যুগোপযোগী ও মূল জনস্রতের আসা আকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতি।
স্বাধীনতার পর জনগনের আসা আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু হয় কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সমাজতন্ত্র নিয়ে। সমাজতন্ত্র প্রয়োজন এ নিয়ে কোন বিতর্ক না থাকলেও কিভাবে সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা হবে এই নিয়ে ব্যপক বিতর্কের সুত্রপাত হয়। এখানে উল্লেখ্য সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের পথ সাধারনত দু’টি, প্রথমটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংসদীয় গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তিনি বিশ্বাস করতেন মিশ্র অর্থনীতির মাধ্যমেই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটানো সম্ভব। তাই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের প্রথম বিকল্পটি (শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রবর্তন) যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন।
কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এমন কিছু সমস্যার উদ্ভব ঘটে যা শাসনতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে এবং সামাজিক বিশৃংখলার জন্ম দেয়। আর এর প্রথমটিই হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের কৌশল সম্পর্কে। ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে ইসলাম বিরোধী বলে এর বিরোধীতা করে। পক্ষান্তরে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলো একে অপর্যাপ্ত বলে মানতে অস্বীকার করে। ক্ষমতাশীল আওয়ামীলীগ দলও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরে।
আওয়ামীলীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের একটি বড় অংশ পর্যায়ক্রমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ভিন্ন রাজনৈতিক দল(জাসদ) গঠন করে। এরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে আগ্রহী এবং বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। চীনপন্থী বামদল গুলো ( যার বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল) যেমন বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি(লেনিনবাদী), বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ(ভাসানী), শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদীদল প্রভৃতি মনে করত যে বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না; তারা ঘোষনা করে নির্বাচন সাধারন মানুষকে ঠকানোর ফন্দি ছাড়া আর কিছু নয়। তারা যুক্তি দেখায় সংবিধানে বিদেশী পুঁজি বাজেয়াপ্ত, সামন্তবাদ উচ্ছেদ, ব্যক্তিমালিকানা রহিতের কথা বলা হয় নি; জনগনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান প্রভৃতির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় নি। সুতরাং এ সংবিধান গ্রহনযোগ্য নয়।
সমাজতন্ত্র নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি শুধু বিতর্কের জন্ম দেয় নি বরং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রিরা সস্বস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তারা শ্রেনীশত্রু ক্ষতমের নামে পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমন, শিল্প প্রতিষ্ঠান-ব্যাংক-খামার লুট প্রভৃতি কাজে লিপ্ত হয়। এই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী ডান ও বাম শক্তিগুলো বিশৃংখলা ও অরাজকতার মাধ্যমে ক্ষমতাশীল সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানী কিছুটা লাঘব করতে উদ্যমী হয়ে উঠে। ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগষ্ট এই দুই মাসেই উগ্রপন্থীরা ১৩টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ১৮টি বাজার আক্রমন করে ১৪০টি আগ্নায়াস্ত্র, ৬৬৮০টি গোলাবারুদ ও ২৬ জন রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে। এমন কি প্রকাশ্য দিবালোকে ঈদের সমাবেশে ১ জন সংসদ সদস্যসহ ৪ জন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
এসব আইন শৃংখলা বিরোধী কাজে আব্দুল হক ও তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি ও সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। এই দল গুলো আন্তর্জাতিক চক্রের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের চক্রান্তেও লিপ্ত হয়। তোয়াহা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টর সাথে পত্র যোগাযোগ করত এবং পত্রে জুলফিকার আলীকে ‘আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করত।
দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি যখন এমন নাজুক অবস্থায় দাড়ায় তখন সরকার এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে (যার একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয় হয়েছে) প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব।
অন্যদিকে ৯ মাস বিধ্বংসী যুদ্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিশাল ক্ষতি ( জাতিসংঘের এক হিসাবে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাধন হয় তা দ্রুত কেটে ওঠা তখনকার সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া দেশের ভঙ্গুর অবকাঠামোকে সচল করা, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি সহ প্রায় ৩ কোটি গৃহহীন মানুষকে পূনর্বাসিত করা যেকোন নতুন দেশের সরকারের জন্যই এক পর্বত প্রমাণ কাজ। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর আইন শৃংখলার অবনতির সাথে সাথে দূর্নীতি-কালোবাজারী-চোরাচালান সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পূজিপতিদের মুনাফাখোরী সিন্ডিকেটের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মুল্যবৃদ্ধি পেতে থাকে। এরসাথে যোগ হয় প্রাকৃতিক দূর্যোগ(প্রথমে খড়া ও পরে প্রলয়ংকারী বন্যা)।
যার ফলে জাতীয় উৎপাদন মারাত্নক ভাবে হ্রাস পায়। আবার এ সময়ে বিশ্ববাজারেও মন্দা দেখা দেয়। এসব কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়ার উপক্রম হয় ও ১৯৭৪ সালে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে। বাংলার আপামর জনসাধারণ যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল সে আশা হতাশায় রূপান্তরিত হতে থাকে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ সমস্যার কোন দ্রুত সমাধান ছিলনা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলের বিশ্বাস ও অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারেনা। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে রুশপন্থী ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টি ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ছিলনা। এই দল গুলো হয় বিদ্যমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে নয় তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চুড়ান্ত সংগ্রামের অংশ হিসেবে সাময়িক অংশগ্রহণ করেছে।
উপরে আলোচিত পরিস্থিতির কারনে যখন বাংলাদেশ এক কঠিন সমস্যায় নিমজ্জিত, যখন আওয়ামীলীগ এক ব্যর্থ সরকারের দ্বারপ্রান্তে তখন জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু হিসেবে শেখ মুজিব এই ব্যর্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই সমস্যার সমাধান জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়।
তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মত বাংলার সকল শ্রেণী-পেশা’র মানুষকে আবার একটি মাত্র প্লাটফর্মে আনার স্বীদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এরকম পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তার নীতি আদর্শে আরো একবার পরিবর্তন ঘটিয়ে পর্যায়ক্রমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ থেকে সরে এসে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ বেছে নেন। যা ছিল বিষ্ময়কর ভাবে একটি সাহসী পদক্ষেপ।
তবে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বা অন্যকোন নির্দিষ্ট কারনে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনেছিলেন এমন কোন চরম স্বীদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার মত ঐতিহাসিক উপাদান এখনো আমাদের হাতে নেই। ভবিষ্যতে এর সুরাহা হবে এমন ধারনাও কষ্টকর।
কারন তাঁর প্রণীত বাকশাল শাসন ব্যবস্থা পূর্ণাংগ ভাবে গঠিত হওয়ার আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়। যেহেতু এটা ছিল একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা (যার প্রবর্তনের কারণ এর পূর্ববর্তি ব্যবস্থার ব্যর্থতা) তাই সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ না থাকলে সেটির উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে স্বীদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায় অসম্ভব।
তবে বঙ্গবন্ধুর দূর্ভাগ্য তিনি যেহেতু চতুর্থ সংশোধনীর সফলতা দেখাতে পারেন নি (সে যে কারনেই হোক) তাই তার বিরোধীরা ( এবং সম্ভবত ইতিহাসও) এটাকে গণতন্ত্রের হত্যা বলেই প্রচার করবে এবং তার অনুসারিদের এর বিরোধীতা করার মত যুক্তিযুক্ত বক্তব্য প্রয়োগ করা কঠিন হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।