আত্মমাঝে বিশ্বকায়া, জাগাও তাকে ভালোবেসে অকস্মাৎ এক বেদনা ঘনিয়ে এসেছে আমাদের আকাশে। তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না কোনো, তা থাকবার কথাও নয়। তবু পার্থিব বাস্তবতা এই, আমাদের শিল্পভূগোল থেকে চলচ্চিত্রচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদকে ছিন্ন করে নিয়ে গেছে কাল। যে যাত্রায় তাঁর অন্তর্ধান সেই একই পথ পাড়ি দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। তাদের সঙ্গী হয়েছেন আরো তিনজন।
যে যায়, তার সর্বস্বটুকুই তো খোয়ায়। প্রতিটি প্রয়াণের সাথেই আকাশ ভারি হয় দীর্ঘশ্বাসে, পৃথিবীর জল খানিকটা বেড়েও তো যায় অগণিত মানুষের ক্রন্দনে! তাঁদের সবার অকাল প্রস্থান চিরকালীন এক শোকচিহ্ন হয়ে থাকবে আমাদের মনে, যারা জীবিত এখনো।
দুই.
চলচ্চিত্রের প্রতি একজন অনুরক্ত হিসেবে তারেক মাসুদের কাজের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। প্রায় কৈশোরউত্তীর্ণকালে তাঁর মুক্তির গান চলচ্চিত্রটির মধ্য দিয়ে পরিচয়ের সূত্রপাত। আজ অবধি রানওয়েতে এসে সেটি স্থিত হয়েছে।
কিন্তু কাগজের ফুল নিয়ে ওড়ার সুযোগটুকু আর পাওয়া গেল না। ১৩ আগস্ট তিনি পাড়ি জমালেন চিরঘুমের দেশে, কালো পিচঢালা নির্দয় পথে ঘাতক যান তাকে বিচ্ছিন্ন করে নিল। তারেক মাসুদের মাটির ময়নাটি আশ্রয় নিল মাটির ঘরে।
ভীষণ বড় ওই মানুষটির সাথে কয়েকবার টেলিফোন আলাপ ছাড়া সরাসরি যোগাযোগ হয় নি কখনো। নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ প্রতি বছর বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে।
ওই উৎসবের এক আসরে তিনি উদ্বোধক হতে সম্মত হয়েছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর সাথে যোগাযোগের ভার পড়ে আমার ওপর। আর এ কারণেই ওই প্রাণবন্ত মানুষটির সাথে আলাপের অর্থাৎ সংযোগের সূচ্যগ্র অভিজ্ঞতাটুকু আমার সঞ্চয়ে রয়ে গেছে। আকস্মিক ব্যস্ততার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের আয়োজনে সশরীরে অংশ নিতে পারেন নি। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন আমাদের সমগ্র আয়োজনের শুভার্থী হয়েই।
বিনয়ী ওই মানুষটি কতভাবে, কত সংকোচে যে তাঁর ওই অপারগতা প্রকাশ করেছেন! অঙ্গীকার করেছিলেন, কোনো একদিন যাবেন নিশ্চয় আমাদের নেত্রকোণায়। তিনি রেখেছেন তাঁর দেয়া কথা, আজ ঠিকই তো তিনি নেত্রের কোণে জল হয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন!
তবু সরাসরি সংযোগের বাতাবরণ ভেদ করে তাঁর সাথে ভিন্ন যোগাযোগ ছিল। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমার মতো অগণিত মানুষের সাথেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। সেই সম্বন্ধ তো শিল্পের, স্বার্থরহিত যথাযোগ্য সম্বন্ধ।
তিন.
তারেক মাসুদের আত্মজৈবনিক আখ্যানের শিল্পরূপ মাটির ময়না।
আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের চিত্ররূপ এই চলচ্চিত্রটি। সীমার মধ্য দিয়ে অসীমের ব্যাপ্তির মতোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগের কয়েক বছরকে তিনি সেলুলয়েড ভার্সনে তুলে ধরেন। কতিপয় চরিত্রের দোলাচলে আর নির্বাচিত দৃশ্যবিন্যাসে বিশাল এই জনপদের ঐতিহ্য, ধর্ম, পারিবারিক ব্যবস্থা, প্রকৃতি, রাজনীতি আর ভৌগলিক চারিত্র্য যেন বা উঠে আসে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু সেই উঠে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তারেকের গন্তব্য, তিনি দর্শকের ভেতরে নানা ভাবনার, নানা জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছেন। এতে করে পরিণত মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে যেন বা।
চলচ্চিত্রটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, সেই প্রশ্নগুলোর মধ্যে ইতি-নেতির দ্বন্দ্বও রয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর নেই। প্রকৃতঅর্থে নির্মাতা তারেক কোনো উত্তর দিতে চান নি। কেননা তাঁর উপস্থাপনা কৌশলের ভেতরেই রয়েছে উত্তরের খোঁজ। শিল্পে এই গুপ্ত কিংবা খানিক আভাস অথবা রহস্যময়তাই জিয়নকাঠি।
নয়তো সব দৈনন্দিন।
চার.
একটি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রাত্যহিক কর্মকৃত্য দিয়ে মাটির ময়না চলচ্চিত্রটির যাত্রারম্ভ। শীতের কোনো এক ভোরে শিক্ষার্থীদের ওজু ও শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অতীতচারি কৌশলে এগিয়ে যায় এর কাহিনী পরম্পরা। এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আনু নামের এক কিশোরকে কেন্দ্র করে এর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়। আমরা দেখতে পাই, একই সকালে মাদ্রাসায় পাঠগ্রহণরত আনু আর তারই পরিবারের খানিক বৃত্তান্ত।
আনুর মা আয়েশার পিঠা তৈরির দৃশ্য আমাদের এই ভূগোলের শীতকালীন বিশেষ খাদ্যাভ্যাসের ঐতিহ্যটি উঠে আসে। গ্রামীণ এক সম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠলেও ধর্মীয় কুহকবিভ্রমগ্রস্ত আনুর পিতা কাজী মাজহারুল ইসলাম তাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেয়। আনুর বোন আসমা কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে। আনুর বাবা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কাজী সাহেব নিজেই চিকিৎসা করছেন। মেয়ের জ্বর না কমার অভিযোগ শুনে কাজী সাহেব এর জন্য আসমার বাইরে ঘোরাঘুরিকেই দায়ী করেন।
মেয়েকে নিয়ে কথোপকথনের এক পর্যায়ে আয়েশা ঘরের আধো অন্ধকার তাড়াতে জানালা খুলে দেয়। বাইরে বিপুলা সবুজ প্রকৃতি। প্রাণের স্ফূরণ ও বিকাশ যে প্রকৃতিতে তারই এক আহ্বান যেন বা এই ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যময় দৃশ্য। মেয়ে আসমার সঙ্গী হীনতা ও ছেলে আনুকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়ে তাকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার অনুযোগ করে আয়েশা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মুহূর্তে একটি বাইরে থেকে সেই জানালার ওপর একটি ক্লোজ শট স্থির হয়ে থাকে। ঘরের ভেতরে থাকা কাজী সাহেব উঠে এসে আস্তে করে জানালার সামনে দাঁড়ান।
ক্যামেরা খানিক টিলড আপ হয়ে স্থির হয়। কারাগারের মতো রডের বিন্যাসে নির্মিত ওই জানালায় বহুদিন ধরে চর্চিত সংস্কারের মতো মাকড়শার জাল ঝুলে আছে। জানালাটি বন্ধ করে দিয়ে কাজী সাহেব ধর্মান্ধতার গহ্বরেই যেন বা নিজেকে লুপ্ত করেন। কাজী চরিত্রটি আপাত নিরীহ এই দৃশ্যের অবতারণায় এক লহমায় সমগ্রসহ অঙ্কিত হয়ে যায়। পরক্ষণেই মাদ্রাসার নিরেট দেয়ালের দৃশ্য, আনকাট ট্রলি ঠেলে আনুর চুল কর্তনের মুহূর্তে এসে ঠেকে।
কিন্তু ধর্মীয় এই শিক্ষায়তনের কঠোরতা কঠিন দেয়ালগাত্র দর্শনে দর্শকের ভেতর প্রবিষ্ট হয়। আনুর চুলে কাচি চালাতে চালাতে ক্ষৌরকার ধর্মীয় ও শ্রেণীগত বিভাজনের পাঠ দান করেন।
মাদ্রাসার এই নিস্তরঙ্গ জীবনে আনুর একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে রোকন নামের অপর এক কিশোর। এই গণ্ডীবদ্ধতা রোকনকে ক্রমে অসুস্থ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলে মাদ্রাসার মালখানায় বন্দি করা হয় তাকে।
আনুকে মাদ্রাসায় পাঠানোর কার্যকারণ উদঘাটিত হয় খানিক পরে। আমরা দেখতে পাই, কাজীর ছোটভাই মিলনের সাথে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ দেখে ফেরার পর এই নির্দোষ বিনোদনটিকে ‘হিন্দুয়ানী’ আখ্যা দিয়ে আনুকে ‘রক্ষার’ নামে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন কাজী সাহেব। মিলন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত।
উদ্ভট ভৌগলিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটির উদ্ভব। এই অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর হাজার মাইল ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তান।
এই দুয়ে মিলে ‘পাকিস্তান’। অখণ্ড ভারত হিন্দু ও মুসলিম এই দুই ‘জাতি’ তে বিভক্ত হয়ে তিনখণ্ডে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা এই অঞ্চলকে দেশ হিসেবে নয়, নিজেদের উপনিবেশ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ফলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মী ও রাজনৈতিক প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ জারি রাখে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন তা ক্রমশ এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সামগ্রিক মুক্তি আন্দোলনের সূচনা ঘটায়।
এ ভূখণ্ডের মানুষ ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় ভাষা ও ঐতিহ্যভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে। কিন্তু তারমধ্যেও কতিপয় ধর্মান্ধ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে বহাল রাখার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। কাজীকে আমরা দেখতে পাই সেই পাকিস্তানপন্থীদের সারিতে। পাকিস্তানিদের প্রতি তার বিশ্বাস এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, অন্তিম দৃশ্যে দেখা যায়, হানাদার বাহিনীর হামলায় ভস্মীভূত ঘরের ভেতরে ধর্মগ্রন্থের পুড়ে যাওয়া খণ্ডিত পৃষ্ঠা হাতে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের প্রতি অবিশ্বাস আনতে পারে না সে। তাকে খানিক বিস্মিত দেখায় শুধু।
এ সময়েও যখন পাকিপ্রেমীদের চাক্ষুস করি, তখন আমাদের চোখে তারেকের সৃষ্ট কাজীর অবয়ব ভেসে ওঠে। সেই দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, আয়েশা ছেলেসন্তান আনুকে নিয়ে পালাতে থাকে বেঁচে থাকার তাগিদে, নতুন জীবনের সন্ধানে। এখানেই চলচ্চিত্রটির আপাত সমাপ্তি ঘটে। আপাত এইঅর্থে যে, আমাদের ভেতরে তখন নতুন মুক্তির গান শুরু হয়। এ ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম দৃশ্যগুলো তারেকের মুক্তির গানে তাল ঠুকেছে।
যেন বা মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়া আনুই এককালে মাদ্্রাসা পড়–য়া তারেক মাসুদ। মুক্তির গান তবে কি মাটির ময়নার সিক্যুয়াল! ঠিক নিশ্চিত নই। কিন্তু ঐতিহ্যনিষ্ঠ তারেকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনমুখীনতা সেদিকেই তো আলো ফেলে, যুদ্ধের বিভীষিকাময়কালে সীমান্ত ঘুরে ঘুরে সুরেসঙ্গীতে মুক্তিকামী মানুষের মনে উদ্দীপনা যোগানো দলের অভিযান, সে তো তারেকেরও গন্তব্য।
আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রশংসিত মাটির ময়না বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক আসর বলে পরিচিত কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্যে এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বড় সম্মান।
পাঁচ.
কারো সাথে আত্মার নৈকট্য অনুভবই আত্মীয় করে তোলে। রক্তসম্পর্করহিত এই অকালপ্রয়াত মানুষটির সাথে রুচি বিশ্বাসে অন্তরঙ্গতা অনুভব করেছে অগণিত মানুষ। তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রিয় থেকে প্রিয়তর। তাঁর এই আকস্মিক অনাকাক্সিক্ষত অন্তর্ধানে সর্বব্যাপ্ত শোক তাই সহজাত।
কর্ম, ঐতিহ্যনিষ্ঠা আর দক্ষতা ইত্যকার অসামান্য গুণে অনন্য এক শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
আমাদের সৎপ্রবৃত্তিজাত দৃশ্যমাধ্যম তাঁকে পাশ কাটিয়ে সম্মুখপানে ধাবিত হবে না কোনোদিন। জানি, জীবন একদিন ফুরাবে, তার তরী ভেসে হারাবে অনন্তের স্রোতে। তবু সময় পুরোবার আগে যেজন রাখে মাথা প্রাজ্ঞ মৃত্যুর কোলে, তার জন্য জাগে শোক। যেজন চুকিয়ে দেয় জীবনের পাঠ, সেজন নির্ভার। আর আমরা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছি যারা, ক্রমশ পুড়ে যেতে থাকি নীলাভ্র দহনে।
তাতে নোনা জলের শুশ্র“ষা নাই, কেবল ভেতরে চেপে বসে বেদনার হিমালয়।
‘তারেক মাসুদ’ নামে আমাদের হৃদয়ে চিরকালীন আসন পাতা হলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।