লিখতে মজা লাগে :P রায়হান হতাশ চোখে এদিক উদিক তাকাচ্ছে। সব সময় ভীড় লেগে থাকা ব্যস্ত মোড়টায় এখন একটাও রিক্সা নাই। দুপুর দেড়টার মত বাজে বোধ হয়, খাঁখাঁ রোদ সব ঝলসে দিচ্ছে। সে যাবে মালিবাগ, ছোট খালার বাসায়। মা কি শুঁটকি না কি রান্না করেছে,পৌঁছে দিতে হবে।
সেখান থেকে শাজাহানপুরে একটা টিউশনি আছে। তার বিরক্ত লাগা শুরু করলো,দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক যখনই হেঁটে সামনের মোড় পর্যন্ত যাবে কিনা ভাবছে, তখনই একটা ঝকঝকে গাড়ি একদম তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সে ভালই চমকে উঠলো। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো,গাড়িটাকে খেয়াল করেনি।
গাড়ির কালো কাঁচ নামা শুরু করে, একটা ফর্সা গোল মুখ উঁকি দেয়,বেশির ভাগটাই বিশাল সানগ্লাসে ঢাকা। রায়হানের মনে হয়,চেহারায় মাছিমাছি ভাব নিয়ে আসে এই সানগ্লাস গুলো।
''হাই রায়হান,কোথায় যাচ্ছ?" রায়হান চিনতে পারে, মৌ, তাদের ক্লাসে অল্প কয়েকজন অতি ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়ে আছে,সে তাদের একজন। এদের সাথে কথা বলতে বা মিশতে পারে না রায়হান,তার কেমন অস্বস্তি হয়। এরা কেমন যেন অন্য কোন ভূবনে বসবাস করে,তাদের আড্ডার বেশির ভাগ টপিকেই সে কন্ট্রিবিউট করার মত কিছু পায়না।
তবে আনস্মার্ট নয় সে,সপ্রতিভ ভাবেই হেসে জবাব দেয়,"আরে,মৌ,তুমি? এই তো,একটু মালিবাগের দিকে যাচ্ছিলাম" "তাই নাকি? আসো,আমি ঐ দিকেই যাচ্ছি"
মনের ভিতর কেমন জানি দোটানায় পরে যায় রায়হান,অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে যায়,"না না,ঠিক আছে,আমি নিজেই যেতে পারবো..." "আরে কিসের না,আসোতো..." বলতে বলতে গাড়ির দরজা খুলে দেয় মেয়েটা। বেশ অনিচ্ছুক একটা ভাব নিয়েই গাড়িতে উঠে রায়হান।
গাড়ির ভেতর আরাম দায়ক শীতলতা, হালকা একটা সুবাস। ড্রাইভার আলগা একটা মনযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। বেশ একটা দুরত্ব নিয়ে বসেছে সে, মেয়েদের সঙ্গে সে ঠিক অভ্যস্ত নয়।
''তারপর,কেল্টু সাহেব,কত পার্সেন্ট শেষ করলেন সিলেবাস?" একটু টিটকারির সুরেই জিজ্ঞেস করে যেন মেয়েটা,জবাবে একটু হাসে রায়হান। "আর লেখাপড়া...ক্লাস,ল্যাব,টিউশানি,ঘুম, টাইম কোথায় বল? "তাই,না?..." হঠাৎ নাক কুঁচকে ফেলে মৌ, ''এটা কি?'' রায়হান খেয়াল করে,মা'র দেয়া তরকারির বাটি ওয়ালা ব্যাগটা থেকে হালকা একটা কটু গন্ধ ভেসে আসছে..."ইজ দ্যাট শুঁটকি?" "ইয়ে,মনে হয়,মা দিয়েছেন, ছোট খালার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি..." "ও,আচ্ছা"...একটা মেকি হাসি দিয়ে মেয়েটা চুপ হয়ে যায়। রায়হান স্পষ্ট মেয়েটার মুখে বিদ্রুপের ছায়া দেখতে পায়। সে আর কিছু বলার মত খুঁজে পায় না।
বেশ কিছুক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙ্গে আবার মৌ, "নেক্সট মান্থে রিভার ক্রুইজে যাচ্ছ তো?" রায়হান একটু ইতস্ত করে বলে,"দেখি, ইচ্ছাতো আছে..." আসল ঘটনা হলো, ফি জমা দেয়ার ডেট শেষ হয়ে যাবার আগে তার হাতে টাকা আসার সম্ভাবনা খুব কম,কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না।
টপিক ঘুরানোর জন্য সে বলে,"লাস্ট উইকে তোমাদের প্রেজেন্টশন টা দারুন হয়েছিলো..." মৌ একটু হেসে ফেলে,"আরে বাদ দাও,সব কাজ তো আমান আর সিফাতই করলো...আমি ছিলাম আরকি গ্রুপে" রায়হান মনে মনে হাসে,কথা গুলো বিনয়ের সুরে বললেও,এটাই সত্যি...ড্রাইভার গাড়ি থামায় তখন,মালবাগ মোড়ে পৌঁছে গেছে তারা।
গাড়ি থেকে নেমে রোদে যেন পুড়ে যায় রায়হান, বিদায় জানিয়ে রওনা দিতে যাবে, তখনি মৌ পিছন থেকে ডাকে আবার তাকে, "ইয়ে,তোমার সাথে তো কথাই হয়না ক্লাসে,তোমার ফেসবুক আইডিটা জানা হয় নি,কি নামে আছো?" কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে রায়হান মেয়েটার দামী মেকাপে ঢাকা মুখটার দিকে। তারপর একটু হেসে বলে,"আমি ফেসবুকে নেই,মৌ। "
ঢাকার পিচ ঢালা রাস্তায় এক নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বুক টানটান করে হেঁটে যায়। তার ঘামে ভেজা পিঠের দিকে চকচকে এসি গাড়ির ভেতর থেকে এক ধনীর দুলালী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
ঐ আরাম দায়ক শীতলতায় রায়হানদের মানায় না, তারা বরং খোলা আকাশের নিচে ঝকঝকে রোদে পুড়ে আরো খাঁটি সোনা হয়।
[সারাটা জীবন মধ্যবিত্ত সমাজের হাসিকান্না ভয়ঙ্গকর বাস্তব ভাবে নিজের লিখায় চত্রিত করেছেন হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকিতে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার এই অণুগল্পটা প্রিয় লেখককে উৎসর্গ করলাম] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।