ইউনিভার্সিটি জীবনের তিন বছর শেষ করে চার বছরে পা দিলাম, কিন্তু আজকের আগে কখনো 'ডি ইউ' বিখ্যাত লাল বাসগুলোতে চরা হয়নি। আজকে আমার ভাইয়ের বদৌলতে এই অভিজ্ঞতাটা হল, আর বুঝলাম, জীবনের এক বিশাল মজা থেকে এতদিন নিজেকে বঞ্চিত করেছিলাম। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটা ছাড়াই যদি আমার ভার্সিটি জীবনটা শেষ হয়ে যেত, তাহলে এই আফসোস করার মত সুযোগও মনে হয় পেতাম না।
আমার গন্তব্য ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট । মিরপুর হয়ে আসতে হবে এখানে, সময়টা একটু বেশি লেগে গেছে ঠিক, কিন্তু ভীষণ মজায় মুহূর্তগুলো কেটে গেছে, বুঝতেই পারিনি।
বিশাল রাস্তা আর ঢাকার ট্রেডমার্ক জ্যাম পার হয়ে যখন বাসার কাছে এসে পৌঁছুলাম, ততক্ষণে দেড়ঘণ্টার মত সময় চলে গিয়েছে। আশ্চর্য, টেরই পাইনি একদম।
কার্জন হলের সামনে থেকেই তো প্রতিদিন এই টকটকে লাল রঙের বাসগুলো ছাড়ে। তাই জায়গা পেতে হলেও ওখান থেকেই বাস ধরতে হবে। কিন্তু আমরা বাসে উঠলাম টিএসসি এর সামনে থেকে, তাই যা হওয়ার তাই হল, "no seat vacant."যাই হোক, মিথ্যা বলবনা, প্রথমে খুব হতাশ হয়েছিলাম, এত বিশাল রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে চিন্তা করে।
পরিচিত দুই একজনের সাথে দেখাও হয়ে গেল, যাদের সাথে শুধু হয়তোবা ফেসবুকেই কথা হয়, এছাড়া দিনের পর দিন দেখা কথা কিচ্ছু হয়না। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, প্রায় একিসাথেই যাতায়াত, অথচ কখনো দেখা হয়নি এর আগে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত লাগল নিজের কাছে।
যা হওয়ার তাই। জায়গা পেলামনা, আমার ভাইটাও না।
তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রওনা দেয়া। বাসটা দ্বিতল, জায়গাও প্রচুর, কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে সমর্থন করে এত বড় বাসটাতে তিল ধারণের জায়গা নেই। পড়ার বইতে পড়েছি, ছোট্ট একটু জায়গায় অনেকগুলো মানুষ থাকলে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয়, তা অক্সিজেনের অভাব বা অন্য কোন কারণে হয়না, হয় তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার জন্য। আজকে তা ব্যবহারিকভাবে আবিষ্কার করলাম। আবহাওয়াটা তেমন গুমোট ছিলনা, তবু মনে হচ্ছিল আর্দ্রতার জন্যই দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
ঝুলতে ঝুলতে রওনা দিয়েছি, দোতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়িটাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার ভাইটা একদম দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে , ওর সাথে কথা বলার কোন সুযোগ হচ্ছেনা। আমি আর আরেকটা মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়ানো, অনেকটা চিরে চ্যাপ্টা অবস্থা, বাস ব্রেক করলেই একজন আরেকজনের গায়ের উপর পড়ে যাচ্ছি। তবে এই পাশাপাশি দাঁড়ানোটাই আমাদের ঠিক মত দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করছে। সিঁড়ির একেবারে কাছে দাঁড়ানোতে কোন স্টপেজ আসলেই সবচেয়ে বেশি ভুগছি আমি, বারবার একবার এইপাশে, আরেকবার ওইপাশে করে জায়গা করে দিচ্ছি বের হওয়ার জন্য।
তবে এটাও ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খারাপ লাগা ব্যাপারটা চলে গেল, আর এজন্য ধন্যবাদ দেব বাসে ওঠা কতগুলো অপরিচিত মুখকে, পুরা সময়টা যারা নিজেদের কথাবার্তায় আমাকে নির্মল আনন্দ দিয়ে গেছে , তারা নিজেরাও সেটা জানেনা। আর বুঝতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আসলে কতটা মহা ট্যালেন্টেড। কত রকম কথাবার্তা যে কানে আসল, হেন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া হয়নি। কখনো কমিউনিজম, কখনো ডান বাম রাজনীতি, আবার হঠাৎ করে আলোচনা ঘুরে যায় ৭১ এর দিকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোকামি, বার্সেলোনার খেলা পর্যালোচনা,ক্ষণে ক্ষণে বিষয় বদলাতে থাকে।
নানা মুনির নানা মত, আলোচনা চলতেই থাকে। সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, ওদের কথাবার্তার গভীরতা দেখে মাঝে মাঝে হাসি পাচ্ছিল, আবার মাঝে মাঝে অবাক লাগছিল। এই অদ্ভুত আলোচনার নীরব দর্শক হয়ে ছিলাম আমি আর আরেকটি মেয়ে ,যে নিজেও কিনা আমার মত ঝুলতে ঝুলতে পুরো রাস্তাটা আসল।
একসময় পথ ফুরিয়ে আসে, একে একে কানায় কানায় ভরা বাসটার মানুষগুলো নিজের নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে থাকে। একটা ব্যাপার যেটা না বললেই নয়, আমার খুব ভাল লেগেছে।
দেখলাম, পরিচিত হোক অপরিচিত হোক একজন আরেকজনকে নিশ্চিন্ত মনে নিজের পোটলা খানা ধরিয়ে দিচ্ছে, নামার সময় শুধু একটা আওয়াজ দিয়ে নিয়ে নেমে যাওয়া। পাবলিক বাসগুলোতে চরতে চরতে এমনটা চিন্তাই করতে পারিনা। এই নির্ভরতা ভাল লাগল খুব।
সবচেয়ে শেষের গন্তব্যতা ছিল আমার। ততক্ষণে পুরো বাসটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
ভাইটার সাথে গল্প করতে করতে বাকি রাস্তাটুকুও পার হয়ে আসলাম। এই দাঁড়িয়ে নিয়ে আসা, অসুবিধায় ফেলে দেয়া এসবের জন্য আমার কাছে দুঃখিত বলল অনেকবার করে। কিন্তু আসল কথাটা হল, আমি আসলে এই "জার্নি বাই বাস" উপভোগ করেছি। ভীষণ।
তাই ধন্যবাদ জানাব আমার কাজিন ভাইটাকে, আমাকে ধরে বাসে উঠানোর জন্য।
নাহয় এমন মজার আর অদ্ভুত অনুভূতি আমার কখনই পাওয়া হতোনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।