চাঁদের দিকে হাত বাড়ালে তার আলো কিছুটা লেগে যায় চিত্তে
আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধে যাননি, কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাসহ ভারতে যাওয়ার পথের শরণার্থীদের খাবার দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। সেবা করেছেন। সারাদিন নদীপথে পাক-বাহিনী ঢুকতে পারে বলে নদীর উত্তর তীরের চরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাংকার খুঁড়েছেন। বালুর বস্তা সাজিয়ে দিয়েছেন।
পাক-বাহিনীর অবস্থান জানতে বিভিন্ন স্থান থেকে খবর এনে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। এর বেশী কোন পরিচয় তার কাছে বড় ছিল না। তাই পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হওয়ার সময় তিনি খুঁজে খুঁজে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্তি করতে সহায়তা করেছেন, যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ না পড়ে।
যদিও তিনি নিজেই দেখেছেন অনেকে যুদ্ধে না গিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে পালিয়ে থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন ! যারা বিভিন্ন সময়ে বানিয়ে বানিয়ে অনেক সম্মুখ সমরের গল্প করে সার্টিফিকেটের মান বাড়ায়!
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী মুক্তাঞ্চল ছিল। ধরলা নদীবেষ্টিত এই অঞ্চলে পাক-সেনাবাহিনী প্রবেশ করার কোন সুযোগ পায়নি। অবিভক্ত ভূ-খন্ড নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী থেকে পাকবাহিনী ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আবার নদীপথেও প্রবেশ করার সাহস পায়নি। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় আমাদের বাড়িটা ছিল শরণার্থীদের জিরিয়ে নেয়ার একটা আশ্রয়।
সব কথাই আমার বাবার মুখে শোনা।
আমার সন্তান সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে আমাকে বলে, ‘আমার দাদা মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গেছেন, আর আমার বাবা ছোট থাকায় মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি। আমার নানা কেন একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেননি। শুনেছি কতজন তো এমন সার্টিফিকেট নিয়ে আজ রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা নিচ্ছে, আমার অনেক সহপাঠী আজ এমন সুযোগ পেল, আর আমি ভাল রেজাল্ট করেও তা পারছি না’।
কথা ঘুরিয়ে আমার জবাব দিতে হলো এভাবে, ‘ভাল রেজাল্ট করা ও ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা মানেই ভাল মানুষ হওয়া নয়।
ভাল মানুষ হও, সব পেয়ে যাবে’। সে আমার কথা কতটা বুঝতে পারল আমি বুঝতে পারলাম না। আমিই বা কতটুকু বুঝে কথাটা বললাম নিজেই কি বুঝতে পারছি!
আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই বলে আমাদের কোন বিশেষ কোটা হয়নি উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি হতে বা চাকুরী পেতে। অনেক কম মেধা সম্পন্ন বা ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রটিও সরকারী চাকুরী পেয়েছে কোটা সুবিধায়। তাদের জন্য আমরা মনে মনে আহ্লাদিত হয়েছি এই ভেবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের মুল্যায়ন হয়েছে।
যদিও আজো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রিকশা চালাতে দেখি। ভিক্ষা করছে শুনতে পাই। পানের দোকান দিয়ে পেট চালায়। তাদের জন্য আজো মাথা হেট হয়, সম্মানিত না করতে পারার অপরাধ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজের কাঁধে তুলে নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশিত দেশ না পাওয়ার বেদনার কথা তাঁরা বলতে বলতে যখন তাঁদের চোখের কোণে জল চিক চিক করে উঠে, আমার বুকেও ব্যর্থতার বেদনা কাঁটা হয়ে বিঁধে।
কণ্ঠ বুঁজে আসে। কথা থামিয়ে দেই। এর বেশী কি করার আছে আমার?
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিবার নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়। আবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদও পড়ে। এই রাজনৈতিক খেলা আমাদের আহত করে।
কিন্তু আমরা এখানেও দর্শকের ভুমিকায় থাকি মাত্র।
সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকুরি দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে সম্মানিত করেছে। দেশবাসী সাধারণ মানুষ (যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নন), তারা সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছে। কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানদের (নাতি-নাতনী) এই কোটার অন্তর্ভুক্ত করেছে তখন এই সাধারণ মানুষই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কারণ এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ও নাতি-নাতনি সহ ৩০/৪০ জনও এই কোটার আওতায় পড়েছে।
তাতে সত্যিকার মেধাবীরা চাকুরি থেকে নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা আমার সন্তানকে আমি কিভাবে বোঝাবো? আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়া বা সার্টিফিকেট না থাকার দায় কেন আমার সন্তানকে বহন করতে হয়? যখন তারা দেখে তাদের ক্লাসের পিছনের সারিতে বসা আর সারা জীবন ভাল রেজাল্ট করেও শুধুমাত্র কোটার ফাঁদে আটকে যায় তাদের চাকুরী বা ভর্তি, তখন তারা দেশটার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। পাড়ি জমাতে চায় ভিন্ন কোন দেশে।
এভাবে কোটা পদ্ধতির বেড়াজালে আটকা পড়ে দেশ মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। তাই কোটা পদ্ধতির সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার আরো অনেক উপায় আছে। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থে তেমন উপায়গুলো খুঁজে বাস্তবায়ন করা।
প্রধানমন্ত্রী ভিডিও চিত্র দেখে কোটা বাতিলের আন্দোলনকারীদের চাকুরী না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তার কথাগুলো সব সাধারণ চাকুরী প্রার্থীর কাছে পৌঁছে গেছে। আন্দোলনে মুষ্টিমেয় যারা ছিল তারা না হয় চাকুরী বঞ্চিত হবে।
ক্রোধে ফুঁসে প্রতিশোধ নেবে ব্যালটে, কিন্তু যারা আন্দোলনে অংশ না নিয়ে মনের মাঝে দেশের প্রতি অনাস্থার আন্দোলন রোপন করে চলেছে তারা কি এই আন্দোলনকে সমর্থন দেবে না? এই ক্রোধ আমাদের কোন পথে নেবে আমি জানি না। কারণ আমাদের এই সরকার মন্দের ভাল হয়ে টিকে থাক, অন্য কোন অপশন যে আমাদের হাতে নেই!
লেখক: সালেহা ইয়াসমীন লাইলী, লেখক ও সাংবাদিক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।