পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীরা যখন ভীত হয়ে পড়ে
ফকির ইলিয়াস
=====================================
খুনিরা ভীত হলে এই সমাজই সাহসী হয়ে ওঠে। সমাজ বুঝতে পারে, জেগেছে মানুষ। জেগেছে মানবতা। সত্যের পক্ষে মানুষের জয়ের ঝান্ডা নিয়ে মানুষ এগিয়ে যাবেই। একটি খবর আমাদেরকে আবারো এই সত্যের জানান দিয়েছে।
প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, কানাডায় পালিয়ে থাকা বিভিন্ন দেশের ৩০ যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮০০ জনের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ঘুম হারাম হয়েছে। চিহ্নিত আল বদর এবং শান্তি কমিটির লোকজনের পরিবার-পরিজন গভীর টেনশনে পড়েছেন কানাডার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সংবাদে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল কানাডা। সে দেশেই সাম্প্রতিক এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকেও নাড়া দিয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরুর পর বেশ কয়েক ডজন চিহ্নিত আল বদর ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক এবং লসঅ্যাঞ্জেলেস সিটিতে এসেছেন। এদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই রজনৈতিক আশ্রয় তথা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিও পেয়েছেন বলে জানা গেছে। আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আল বদরের কেউ কেউ ইমিগ্রেশনের কাজকর্মে নিয়োজিত থাকায় নবাগতদের জন্যে বেশ সুবিধা হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত কয়েকজন অনেক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেনশিপ নিয়েছেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। তাদের মধ্যেও আতঙ্ক পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি নেয়া এবং সিটিজেনশিপ গ্রহণের সময় জীবনবৃত্তান্ত উল্লেখ করতে হয়। সেখানে তারা কেউই একাত্তরের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করায় তারা এখন ফেঁসে যাবার আতঙ্কে রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ঐসব চিহ্নিতদের তালিকা ও জীবনবৃত্তান্ত স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন বিভাগে অবহিত করা হলে কানাডার মতো পরিস্থিতির শিকার হবেন তারাও-এ অভিমত কয়েকজন ইমিগ্রেশন এটর্নির। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কয়েকজন কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, যে তারা প্রকাশিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তালিকা সংগ্রহ করছেন। এগুলো হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তথা ইমিগ্রেশন বিভাগে দেয়া হবে।
এদিকে অটোয়া থেকে বাংলাদেশী কানাডিয়ানরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় গ্রহণের সময় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছেন। তারা সকলেই ফেঁসে গেছেন ঐ ১৮০০ জনের সঙ্গে। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার নোটিশ জারি হয়েছে। এদের প্রায় সকলেই নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রদানে মিথ্যার আশ্রয় অথবা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক নির্দয় আচরণের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ শিক্ষাগত যোগ্যতার ভুয়া সার্টিফিকেট সরবরাহ করেছেন।
পরবর্তীতে খোঁজ-খবর নেয়ার পর প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রেও অসংখ্য বাংলাদেশী ক্ষমতাসীন সরকারের রোষানলে পড়ার কাহিনী বিবৃত করে গত ১০/১২ বছর আগে থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি লাভ করেছেন। কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সি প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধী তালিকায় পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে রয়েছেন হাফিজ মাহমুদ খালিদ এবং মোহাম্মদ আরশাদ। এছাড়াও রয়েছে শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সুদান, কঙ্গোর যুদ্ধাপরাধী। কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী জেসন কেনি বলেছেন, কানাডার নাগরিকত্ব বেচা বিক্রির জিনিস নয়।
কিন্তু কেউ কেউ তা করেছে অবৈধভাবে। এখন তার শেকড় ধরে টান দেবার সময় হয়েছে। আমরা তাই করছি। এই ঘোষণার মাধ্যমে অপরাধীরা যে পার পাবে না, তা আবারো জানিয়েছে কানাডা সরকার। আমাদের অনেকের মনে আছে, বাংলাদেশের অন্যতম যুদ্ধাপরাধী আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে ও চৌধুরী মইনুদ্দীন ইংল্যান্ডে অবস্থান করছে।
এই সুযোগে তাদের বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টিতে আনা দরকার।
দুই.
এই প্রসঙ্গে আরো একটি খবরের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)২০১০ সালের ১২ জুন উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অনুষ্ঠিত তাদের প্রথম পর্যালোচনা বৈঠকে এ মর্মে এক ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত আগ্রাসী যুদ্ধসমূহকে বিচারযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হবে। বৈঠকে উপস্থিত ৮০টিরও বেশি রাষ্ট্র এ ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়েছিল ।
ঘোষণায় আগ্রাসন বা বলপ্রয়োগের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বলপ্রয়োগ বলতে বোঝায় এক দেশ কর্তৃক আরেক দেশের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ, আক্রমণ পরিচালনা এবং বোমাবর্ষণ। এগুলো জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। যুদ্ধের শিকার মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ভবিষ্যতের নিষ্ঠুরতা এবং গুরুতর যুদ্ধাপরাধীদের দায়মুক্তি বন্ধের যে উদ্যোগ আইসিসি নিয়েছে কাম্পালা ঘোষণায় তার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা অন্যায় যুদ্ধ শুরু কিংবা তা কার্যকর করছেন কাম্পালা চুক্তি বাহ্যত আইসিসিকে সেসব ব্যক্তির বিচার করার ক্ষমতা প্রদান করবে।
একই সঙ্গে আইসিসি তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের দায়েও অভিযুক্ত করতে পারবে।
২০০০ সালে রোমে গৃহীত সংবিধির অধীনে গঠিত আইসিসিই হচ্ছে বিশ্বে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের জন্য প্রথম স্থায়ী আদালত। ১২০টি দেশ ১৯৯৮ সালে রোম সংবিধি গ্রহণ করে। পরে ৬০টি দেশের অনুমোদনের পর ২০০২ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়। ১১১ সদস্যের আইসিসি এ পর্যন্ত নিজস্ব বিবেচনার নিরিখেই তার কর্মকা- চালিয়ে এসেছে এবং প্রধানত আফ্রিকা মহাদেশেই নিজের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রেখেছে।
প্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ সদস্যই আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকারের দেশ। তবে জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নই এর অর্থের সবচেয় বড় জোগানদাতা। এ পর্যন্ত আগ্রাসনমূলক অপরাধ বিচারের একমাত্র ঘটনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অনুষ্ঠিত টোকিও এবং নুরেমবার্গ যুদ্ধোত্তর ট্রাইব্যুনাল। এ বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় জাপানি ও নাজি কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেয়া হয়।
সুদানের সেনাবাহিনী ও সরকার সমর্থিত মিলিশিয়ারা সে দেশের দারফুর প্রদেশে যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তার কারণে দেশটির প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। ক্ষমতাসীন কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে এ জাতীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা এটিই ছিল প্রথম। তবে সুদানি প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন আফ্রিকান ও আরব দেশ ভ্রমণ করতে গেলে সেসব দেশের অধিকাংশ সরকারই তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। লিবিয়ায় অনুষ্ঠিত আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) শীর্ষ সম্মেলন থেকে বলা হয়, তারা আইসিসি কর্তৃক জারিকৃত বশিরকে গ্রেপ্তার করার আদেশ কার্যকরের ক্ষেত্রে কোনো রকম সহযোগিতাই প্রদান করবে না।
ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যা পিয়াঁরে বেসবাকে আইসিসি ঘোষিত এক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আওতায় ২০০৯ সালে বেলজিয়ামে গ্রেপ্তার করা হয়।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের দায়ে আইসিসি কর্তৃক অভিযুক্ত কঙ্গোর অন্যান্য বিদ্রোহী নেতার সঙ্গে তিনিও এখন ইউরোপের জেলে বন্দী অবস্থায় বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন।
২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত কেনিয়ার সাধারণ নির্বাচন-উত্তর যেসব লোক সে দেশের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে আইসিসি কেনীয় সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত লাভ করেছে। নিয়মানুযায়ী একটি দেশ নিজে যখন তার দেশের কোনো অপরাধীর বিচার না করে কিংবা করতে না পারে কেবল তখনই আইসিসি সেই অভিযুক্তের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ইতোমধ্যে ভয়ানকভাবে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করেও বহু দেশের সরকার আইসিসির বিচারপ্রক্রিয়া থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। সে প্রসঙ্গে আরেক দিন আলোচনা করা যাবে।
আইসিসি আগ্রাসনমূলক অপরাধকে কিভাবে দেখে সে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই চিন্তিত। তবে আইসিসি খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, অন্যায় যুদ্ধের জন্য দায়ীদের শাস্তিবিধানে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রোম সংবিধিতেও আইসিসির ভূমিকা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। কাম্পালায় সমবেত প্রতিনিধিরা এ মর্মে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন যে, জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন ঘটিয়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা তাদের সেনাবাহিনীকে অন্য দেশে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এককভাবে সবচেয়ে বেশিবার এই সনদ লঙ্ঘনকারী যুক্তরাষ্ট্র এ বক্তব্যে কিছুটা বিচলিত না হয়ে পারে না।
কারণ সে বহুবার অন্য দেশে আক্রমণ চালিয়েছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দখল করে নেয়ার ঘটনা অবশ্যই আইসিসির বিবেচনায় আসার কথা।
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধাপরাধীদের স্বরূপ উন্মোচনে উত্তর আমেরিকা সচেষ্ট থাকলেও তারা নিজেদের মাতব্বরি বজায় রাখতে যে কোনো শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে এই, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডায় লুকিয়ে থাকা নাজি কিংবা বাংলাদেশের একাত্তরের ঘাতক অথবা বসনিয়ার খুনি চক্রকে খুঁজতে এই যে অভিযান শুরু হয়েছে, তা বিশ্বমানবতার জন্য শুভ সংবাদ। কারণ এরা দেশে বিদেশে, যে কোনোখানেই থাকুক না কেন-তারা মানবতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বিরুদ্ধ শক্তি।
এই মুহূর্তে প্রবাসে অবস্থানরত প্রতিটি সচেতন বাঙালির উচিত হবে এসব যুদ্ধাপরাধীদের আস্তানা চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের গোচরে আনা। এজন্য প্রবাসী বাঙালির ঐক্য ও সংহতি খুব জরুরি তো বটেই।
নিউইয়র্ক , ২৭ জুলাই ২০১১
=======================================
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা/ ৩০ জুলাই ২০১১ শনিবার
ছবি- মিরো লি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।