আহ অমরত্ব, তোমার উষ্ণ ঠোঁটে রাখি ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে সবটুকু আনন্দ ভোগ করি। তোমার উষ্ণতায় বারেবারে বিলীন হয়ে যাই, দিতে পারিনি কিছুই, শুধু নষ্ট করে যাই। "মনে করুন আপনি কাউকে খুন করতে চান, তাহলে কিভাবে করলে সবচেয়ে ভালো হয়?”
যাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করা হয়েছে, তিনি প্রশ্নকর্তার দিকে ভুরু কুচকে তাকালেন। তার নিজের উপরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে এমন একজন লোকের পাশে এসে বসেছেন সেই জন্য। তিনি চায়ের কাপ নিয়ে সরে বসলেন।
যে লোকটা চা বানাচ্ছিল সে কথাগুলো শুনে। প্রতিদিনই সে নতুন নতুন গল্প শুনে। খুন, ধর্ষণ কিংবা এর চেয়েও ভয়ংকর কোন অন্যায়ের গল্প।
যাই হোক এখন প্রশ্নকর্তার পরিচয় দেই। প্রশ্নকর্তার নাম মাহবুব।
বয়স ত্রিশ। চেহারা মাঝারী ধরনের। রাস্তার পাশের আকাশী রঙের বাড়িটার একটা ফ্ল্যাটে সে থাকে। তার পরিবারে সে ছাড়া কেউ নেই। একা থাকতে থাকতে তার মাঝে একটা গম্ভীর ভাব চলে এসেছে।
মাহবুব প্রতিদিন এই চায়ের দোকানে চা খেতে আসে। চা খেতে খেতে সে তার পাশে যে বসে তার কাছে বিভিন্ন গল্প করে। গল্প গুলো তার করা অন্যায় কিংবা পাপের গল্প।
মাহবুব তার গল্প বলতে থাকে।
“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।
আমাদের এই বন্ধুত্বটা শুরু হয়েছিল বলতে গেলে প্রথম দিন থেকেই। প্রথম একটা বছর আমরা অনেক আনন্দ করে কাটালাম। একদিন আমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে বড় ধরণের ঝামেলা হয়। আচ্ছা সেটা থাক। মূল কাহিনীতে আসি।
তো আমরা দুই জন মিলে ঠিক করলাম তৃতীয়জনকে খুন করবো। কিভাবে করবো সেই নিয়ে আমরা অনেক চিন্তা করি।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। আমরা তিনজন ঘুরতে বের হলাম। আমি প্রস্তাব দিলাম যে চল নৌকা ভ্রমন করে আসি।
আমরা দুই ঘণ্টার জন্য একটা নৌকা ঠিক করলাম। মাঝিকে বললাম যে আমরা নিজেরাই নৌকা চালাবো। সে প্রথমে কিছুতেই নৌকা ছাড়তে রাজি হয়না। অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করাই। আমরা নৌকায় করে নদীর ওপারে চলে আসি।
নদীর তীর থেকে অনেকটা জায়গা কাশবন। আমরা কাশবনের ভেতর ঢুকি। কাশবনে ঢুকে আমরা দুইজন মিলে ঐ বন্ধুকে চেপে ধরে বেঁধে ফেলি। আমি পকেট থেক ছুরিটা বের করে গলা বরাবর একটা টান দেই। রক্ত যাতে শরীরে না লাগে সে জন্য আমরা সরে আসি।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আমরা লাশটা কাশবনের ভেতর ফেলে রেখে নৌকা নিয়ে চলে আসি। মাঝিকে বলি যে আমাদের ঐ বন্ধুর কাজ ছিল তাই সে চলে গেছে। ”
গল্প বলা শেষ হলে সবাই আস্তে আস্তে উঠতে শুরু করে। গল্প বলার সময় মন দিয়ে শুনে।
গল্প বলা শেষ হলেই সবাই মাহবুবের দিকে ঘৃণার চোখে তাকায়। অনেকের চোখে থাকে ভয়।
চা ওয়ালা টুং টাং শব্দে চা বানায়। মাহবুব পরপর তিন কাপ চা খেয়ে তারপর উঠে। সে রাস্তার মাঝে কয়েকবার চক্কর দিয়ে বাসায় চলে আসে।
২.
মাহবুবের বাসার কলিংবেল বাজছে। কে হতে পারে, মাহবুব চিন্তা করছে। মাহবুব উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অনিন্দিতা দাড়িয়ে আছে। অনিন্দিতা মাহবুবের বন্ধু।
অনিন্দিতা অনার্স শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে যায়। প্রায় পাঁচ বছর পর তাদের দেখা।
“তুই!”
“হ্যা, চলে এলাম। গতকাল রাতে এসেছি। সকাল হতেই তোর এখানে চলে আসলাম।
”
“কেমন আছিস?”
“অনেক ভাল। কিন্তু তু তো বুড়ো হয়ে গেছিস। । ”
“আরে না, এই দেখ, মাসল দেখ। কি বুড়ো মনে হচ্ছে?”
“হুম, ভাল।
”
“কতদিন পর দেখা। তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। ”
“বাসার বাকি লোকজন কোথায়। ”
“একাই আছি, এ আমার আনন্দময় একাকীত্ব।
”
“মানে তুই এখনো বিয়ে করিসনি। আমি ভাবলাম কয়েকটা পিচ্চি বাচ্চা এসে পাব। ”
“তুই?”
“বিয়ে করার সময় পাইনি। এবার কর্ম সম্পন্ন করার জন্য এসেছি। একটা ভালো দেখে পাত্র যোগাড় কর।
”
“পাত্র তোর সামনেই বসে আছে। ”
“তাহলে আর বিয়ে করা হচ্ছেনা। ”
“ঠিক আছে বস। আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসি। ”
“যা, নিয়ে আয়।
ভালো হলে আমার বাসার কাজের লোক হিসেবে নিয়োগ দেব। "
অনিন্দিতা মাহবুবকে কতটুকু পছন্দ করে কিংবা মাহবুব অনিন্দিতাকে কতটুকু পছন্দ করে সেটা তাদের কেউই কোনদিন জানতে চায়নি। কিংবা জানতে চাইলেও হৃদয়ের বাইরে কখনো নিয়ে আসতে চায়নি। কিছু ব্যাপার হৃদয় নিজের মাঝেই রেখে দেয়।
গত পাঁচ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু তাদের দুজনের বন্ধুত্ব একটুও বদলায়নি।
মাহবুব কফি নিয়ে আসে। দুজনে আয়েশ করে কফিতে চুমুক দেয়।
"হাসান কেমন আছে, জানিস?'
"হুম, শুনেছিলাম ভালই আছে। গত তিন বছর ধরে ওর সাথে যোগাযোগ হয়নি। "
"কেন?"
"আসলে কারো সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছে হয়না।
"
"তুই তো একদম অসামাজিক হয়ে গেছিস। "
"না বন্ধু। তোমাদের সমাজ আমাকে গ্রহণ করেনি। তাই নিজেই একটা সমাজ বানিয়ে নিয়েছি। আর তার একমাত্র সদস্য হলাম আমি।
'
"থাক তোর নিজের মত করে। "
তাদের কথা চলতেই থাকে। বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম তাতে কখনোই কথা শেষ হয়না। মাহবুব আর অনিন্দিতা মিলে রান্না করে। অনিন্দিতা দুপুরের খাওয়া শেষ করে তারপর বাসায় ফেরে।
মাহবুব আবার একা হয়ে যায়। একা হওয়ার তীব্র ইচ্ছায় তার হৃদয় হাহাকার করে।
৩.
এভাবেই চলতে থাকে মাহবুব হাসানের দিন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে চায়ের দোকানে যায়, সেখানে একটা ভয়ংকর গল্প , তারপর ফ্ল্যাটে ফিরে তার নিজের একাকীত্ব। মাঝে মাঝে অনিন্দিতা আসে, গল্প হয়।
মাহবুবের ফ্ল্যাটের সামনে যে ফ্ল্যাটটা , সেখানকার লোকজন তাকে প্রচণ্ড ভয় পায়, তাই তাদের সাথে তার যোগাযোগ হয়না।
একদিন মাহবুব চা খেতে এলনা। আরেকটি সকাল গেলো তাও সে এলনা। সেদিন অনিন্দিতা মাহবুবের বাসায় আসে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
অনেকক্ষণ ধরে সে বেল বাজাল কিন্তু কোন সাড়া নেই। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশে খবর দেয়া হল।
পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে।
মাহবুব বিছানায় শুয়ে আছে। অনেকক্ষণ হল মারা গেছে।
লাশ থেকে বিশ্রী রকমের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
অনিন্দিতা স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার চোখের জলধারা তার কষ্টগুলোকে পৃথিবীতে প্রকাশ করছে।
পুলিশ অফিসার মাহবুব সম্পর্কে সবার কাছে জানতে চাইলো। সবাই তার সম্পর্কে অনেক কিছু বলল।
সবাই তাকে খারাপ মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করলো। অনিন্দিতা সবার কথা শুনে। নিজের কানকেও সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। মাহবুবকে সে ভালো ভাবেই জানে। সে উঠে দাড়ায়।
সে পুলিশ অফিসারের সামনে দাড়ায়।
"স্যার আসলে ওরা যা বলছে, তা পুরোটাই মিথ্যে। মাহবুব অনেক ভালো একজন লোক ছিল। "
অফিসার তার কথা বিশ্বাস করে অথবা হয়তো করেনা। তারা লাশ পোস্টমর্টেম এর জন্য নিয়ে চলে যায়।
লোকজনের আলোচনা চলতেই থাকে, আলোচনা অনেক ডালপালা ছড়ায়।
অনিন্দিতা বাসায় চলে আসে, অনেক কষ্ট সাথে নিয়ে।
তার পনের দিন পর। মাহবুব যে পাড়ায় থাকতো, সেখানে একটি বৃদ্ধাশ্রম ছিল, সেখানে একজন আইনজীবী আসেন। তিনি তাদের বলেন যে, মাহবুব হাসান এই বৃদ্ধাশ্রমে তার সব সম্পত্তি দান করে গেছেন, যেটার মোট মুল্য প্রায় দশকোটি টাকা।
মুহূর্তেই খবর সবদিকে ছড়িয়ে পরে। মাহবুব হাসানের মহত্ত্ব নিয়ে সবাই আলোচনা করতে থাকে। সবার চোখে মাহবুব একজন মহামানব হয়ে যান।
মাহবুব আসলে ব্যাক্তি হিসেবে অনেক ভালো ছিল। সে কখনো অন্যায় করেনি।
কিন্তু তার মাঝেমাঝে খুব অন্যায় করতে ইচ্ছে হত। তাই সে কল্পনা করে নিত যে সে একজন ভয়ানক অপরাধী। এবং এ জন্য সে ভিবিন্ন জনের কাছে বানিয়ে তার অপরাধের গল্প বলতো।
চায়ের দোকানটা আজ ভোরে আবার খুলেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে।
চায়ের কেটলির নল দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে।
এই বৃষ্টিতে কেন জানি অন্যায় করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।