আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই আসে যাহা কই মুখে"

"হরি আছেন পূর্বে, আল্লা আছেন পশ্চিমে, তুমি তোমার হৃদয় খুঁজে দেখ- করিম ও রাম উভয়েই আছেন হৃদয়ে; এ জগতের সমস্ত মানব-মানবীই তাঁর অংশ। " (সন্ত কবীরের গান; তর্জমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কী পেয়েছে সে-মেয়েটি?- সে পেয়েছে জন্মদিন? চুড়িদার, আলুকাবলি- কু-ইঙ্গিত মামাতো দাদার। (যে-ছাত্রীটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে : জয় গোস্বামী) ১ মেয়েটি, হালকা বেগুনি রঙের জামা পরা ৬/৭ বছর বয়সের মেয়েটি, খুব দুষ্টুমি করছিল। তার মা, সম্ভবত বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা, তাঁর প্রায় প্রজাপতির মতো সুন্দর কন্যাশিশুটিকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। হাজার হোক, এটা ছিল একটা বিক্ষোভ সমাবেশ, সুতরাং গাম্ভীর্যপূর্ণ একটা পরিবেশ তো বজায় থাকা চাই!কিন্তু প্রজাপতি কি নিয়ম মেনে ওড়ে? সে তার সমবয়সী দুটি শিশুর সাথে খেলা করছিল, অকারণে খুশি হয়ে উঠছিল, হাসছিল, মাঝে মাঝে মানুষের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিল, আবার মায়ের স্বস্তি হয়ে ফিরে আসছিল।

আর সবার মতো আমিও উপভোগ করছিলাম মেয়েটির শৈশবের-মতন-নিরর্থক-সুন্দর কার্যকলাপ। কিন্তু আমার মনে কি শুধু একটা অনুভূতিই কাজ করছিল? না মনে হয়। আমি ভয় পাচ্ছিলাম ভবিষ্যতের ভাবনায়। এ-মেয়েটি, এবং এর মতো অন্যান্যেরা, কি এরকমই থাকতে পারবে চিরকাল? সব সময়? শঙ্খ ঘোষ যে লিখেছিলেন, “যমের দক্ষিন হাতে দিতে হবে আজ/ চায় তোকে দৃষ্টিহীন বধির সমাজ”; তা-ই কি সত্য হয়ে উঠবে না এই প্রজাপতিদের জীবনে? শুধুমাত্র দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর মানুষ হয়ে জন্মানোর ‘অপরাধে’? ২ আমি গত পনেরোই জুলাই দুইহাজারএগারো তারিখে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে স্থাপিত ভিকারুন্নিসা স্কুল ও কলেজের জন্য সংহতি মঞ্চ-এর কথা বলছি। সম্ভবত সবাই জানেন সম্প্রতি কি ভয়াবহ বিবমিষাজাগানিয়া ঘটনা ঘটে গেছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই শিক্ষানিকেতনটিতে।

একজন ‘শিক্ষক’(?) তাঁর কন্যাতুল্য একটি ছাত্রীর উপর দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এখন সাপ বেরোচ্ছে। জানা যাচ্ছে যে সেখানে এমন গুণধর শিক্ষক আরও দু’জন পাওয়া গেছে। অভিভাবকেরা এতোটাই ভীত যে তাঁরা গার্লস স্কুল থেকে পুরুষ শিক্ষক প্রত্যাহার করতে হবে ধরণের দাবিও নাকি তুলছেন। যাই হোক, আমি সাংবাদিক নই; আর কি ঘটেছে এবং ঘটনার পর কতটুকু ‘রাজনীতি-চর্চা’ হয়েছে তা-ও সম্ভবত সবার ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে; সুতরাং এই লেখাটিতে আমি মেয়েটির বিরুদ্ধে করা কয়েকটি মন্তব্য-এর জবাব দেব (মন্তব্যগুলো করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়-করেছেন অনেক অন্ধকারবাসী আততায়ী-এই ফেসবুকেও কাউকে কাউকে পাওয়া যেতে পারে একটু খুঁজলেই)।

এগুলো মৌলিক জবাব নয়; ভিএনএসসি-এর একজন শ্রদ্ধেয় আপু ও তাঁর মত অন্যান্য আলোকিত মানুষেরা, যারা অংশ ছিলেন সেদিনের সেই অসাধারণ আয়োজনটির; তাঁরা তাঁদের দাঁতভাঙ্গা জবাবগুলো দিয়েছিলেন পনেরো তারিখেই। আমি শুধু আমার দুর্বল ভাষায় আমার মতো করে সেগুলোর কিছু সেগমেন্ট পুনঃউপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি (নিজস্ব জবাবও আছে আমার, তবে যার মুখ থেকেই নিঃসৃত হোক এগুলো এদেশের সকল বিবেকবান মানুষের কথা, তাই পার্থক্যীকরণ নিষ্প্রয়োজন)। এই নোট অতএব শুধুমাত্র তাঁদের জন্য, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানাবিধ কারণে সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। “ মেয়েটি ‘বেয়াদব’ ছিল, উচিত ‘শাস্তি’ হয়েছে ” ভাল কথা, ছাত্র বা ছাত্রী বেয়াদব হলে একজন শিক্ষক শাস্তি দেবার অধিকার অবশ্যই রাখেন। তিনি গার্জিয়ান কল করতে পারেন, ‘বেয়াদব’-টিকে কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন একক্লাস সহপাঠীর সামনে, এমনকি রাগ বেশি উঠলে গালে চড়ও কষাতে পারেন শক্ত করে একটা।

কিন্তু ধর্ষণ কি করতে পারেন?বেয়াদবির শাস্তি ধর্ষণ? কোন কিতাবে লেখে! আসলে বেয়াদবি টেয়াদবি কিছু নয়, ও একটা ছুতো, নিরীহ ছাগলছানার ঘাড় ভাঙতে ধূর্ত নেকড়ের কোনোকালেই ছলের অভাব হয় না! প্রকৃত প্রস্তাবে মেয়েটি নয়, সেই ‘শিক্ষক’-ই বেয়াদব। শিক্ষকতার আদব তিনি জানেন না, জানলে এ-কাজটি কখনোই করতে পারতেন না। “মেয়েটা স্কার্ট পরা ছিল, উল্টাপাল্টা পোষাক পরবে আর একটু আকটু হাতাহাতি করলেই দোষ? হে হে হে” প্রথম কথা একটা মেয়ে শর্ট স্কার্ট পরে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গেছে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা আমি বিশ্বাস করি না। স্কার্ট বলতে বোধ হয় লং স্কার্ট-কেই বোঝাতে চান মন্তব্যকারীগণ। আচ্ছা, পশ্চিমের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম; বাড়ির কাছের আদিবাসী নারীরাও তো বহু বহুদিন ধরে স্কার্ট জাতীয় পোষাক পরছেন; কই, তাদের পুরুষ কাউন্টারপার্ট-রা তো কখনো হাতাহাতি করার চেষ্টা করেন বলে শুনি না! হাতাহাতি করার রোগটা কি তাহলে বিশিষ্টভাবে আমাদের বাঙালি ছেলেদের? এই রোগের চিকিৎসা কি? স্কার্ট নিষিদ্ধ করা নাকি? “লায়েক মেয়ের পর্দা-পুশিদা করা উচিত ছিল” দারুন! লায়েক মেয়ের তো আর প্রজাপতি সেজে উড়ে বেড়ানো ঠিক না, আফটার অল, বাচ্চা মেয়ে তো আর না।

নালায়েক মেয়েরা তো তাহলে খুবই নিরাপদ এই বাংলাদেশে, তাই না ধার্মিক(?)মন্তব্যকারীগণ। তিন বছরের তানিয়ারও তাহলে পর্দা-পুশিদা করা উচিত ছিল। বোকা মেয়ে বোঝে নাই, বাংলাদেশে তিন বছরেই একটা মেয়ে লায়েক অর্থাৎ ধর্ষণোপযোগী-হয়ে যায়। বুঝলে পুলিশ হেফাজতে গণ-ধর্ষণের শিকার হয়ে তিন বছরের মেয়েটাকে মরতে হত না গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে!!! যারা এরকম আরও অসংখ্য মন্তব্যে মুখরিত ও আলোড়িত করে তুলছেন চারপাশ, যারা চমৎকার চর্চা করছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা-র, যারা একটা অসহায় মেয়ের পাশে না দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত বিকৃতি ছিটিয়ে দিচ্ছেন মেয়েটির শারীরিক ও সামাজিক অস্তিত্বে; তাদের কোন পশুর সাথে তুলনা করবো? পরিমল একা নির্যাতন করেননি মেয়েটিকে, তিনি সাথী হিসেবে পেয়েছেন এরকম মন্তব্যকারী-দের। পরিমল জয়ধর না হয় ফাঁসিকাঠে ঝুলবেন, কিন্তু এইসব সম্ভাব্য পরিমলদের নিয়ে আমরা কি করবো? কেউ উত্তরণের উপায় জানেন? ৩ তবু এত কষ্টের মাঝেও দেখতে পাই সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যায়নি এখনো।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনু মুহাম্মদ, আকমল হোসেন, নুসরাত লাবনী, আলিফা বিনতে হক, জোনায়েদ সাকী, আয়শা খানম, তাসলিমা আখতার, জুলহাসনাইন বাবু, দেলোয়ার হোসাইন: নক্ষত্রের মত আশাজাগানিয়া এই নামগুলো; এই নামগুলো থেকে উঠে আসা কথাগুলো; রাগ-অভিমান-দ্রোহ-ভালোবাসা-দৃঢ়তা মিশ্রিত তাঁদের কণ্ঠস্বরগুলো;- আমাদের স্বপ্ন দেখায় আর্তুর রেঁবো-কল্পিত ভোরবেলার সেই অপরুপ নগরে পৌছুঁবার। আমরা স্বপ্ন দেখছি ও দেখতে থাকবো ন্যায় ও সাম্যের… কারণ মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়! বি.দ্র.: শিরোনাম (কাজী নজরুল ইসলাম) থেকে শুরু করে মূল লেখার অনেক কিছুই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ধার করা; সবার কাছেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.