হাউকাউ পার্টি নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের দোকান গুলোকে আমার কাছে একটা খনি মনে হয়, মাঝে মাঝে এখানে এমন চমৎকার সব বই পাওয়া যায়, যেগুলো হয়তো নতুন অবস্থায় সংগ্রহ করা খুব কষ্ট্সাধ্য কাজ। তাই এই জায়গাটাতে মাঝে মাঝে ঢু দেয়া হয়, আমাদের চোখ থাকে আর্ট আর ইতিহাসের বইতে। সেদিন এমন ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম এই বছরে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ছায়ানট থেকে প্রকাশিত একটা রবীন্দ্র চিত্রকলা নামে চমৎকার একটা পিক্টোরিয়াল বই। সৌজন্য সংখ্যা। কোন বিদগ্ধজন কে হয়তো দেয়া হয়েছিল, তিনি তা সের দরে বিক্রী করে দিয়েছেন
যদিও বিমূর্ত চিত্রকলা তেমন একটা বুঝিনা তারপরও বইটা পড়ে আর ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম আরেকবার।
কবি গুরুর আঁকা এত সব ছবি আমি আগে কখনোই দেখিনি।
সেই সব ছবি গুলো আর কিছু কথা...............
১।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৭ সালের দিকে তুলি ও কলমে আঁকার কাজ শুরু করেন। পরে পান্ডুলিপি সংশোধনের আছিলায় তিনি তাতে ডিজাইন বা নক্সা আকা শুরু করেন, যেটা আজ সুধুমহলে সুপরিচিত। তার পান্ডুলিপি সংশোধনের ধরণ থেকে নতুন একটা নকশা রীতি তৈরি হয়, অর্থাৎ এই নক্সাই এধরণের কাজের মূল কথা, বহু বছর ধরে তিনি তাঁর লেখার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাতার পর পাতা আকিবুকিতে ভরিয়ে তুলেছেন।
২।
প্রায়ই তিনি দিনে কবি তিন চারটা ছবি একে শেষ করতেন। ছবি আঁকার সরঞ্জামের ক্ষেত্রে খুব সাধারন ছিলেন তিনি, কলম, পেন্সিল, ফেলনা ছেড়া কাগজ....সব কিছুকেই কাজ লাগিয়েছেন।
৩।
ভালো রং নিয়ে তিনি পরোয়া করতেন না, বেশির ভাগ সময়েইও পেলিক্যান কালি ব্যাবহার করতেন।
৪।
তাঁর আঁকার পদ্ধতিটি ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব, স্বদেশি বা বিদেশী কোন ধারাই তিনি অবলম্বন করেননি।
৫।
তিনি নিজেই বলতেন " আমি আকার জন্য কলম ধরনি, তখন আমার মনে কোন পূর্বপরিকল্পনা থাকে না......কলম সরতে শুরু করলেই কলমের ডগা থেকে ছবি বের হতে শুরু করে। " এভাবে ছবির পর ছবির সৃষ্টি হয়েছে এক কবির হাত থেকে যার সংখ্যা দুই হাজারের কম নয়।
৬।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি গুলোর প্রথম চিত্র প্রদর্শনি হয়েছিল প্যারিসে। সাধারণ ভাবে তাঁট চিত্র গুলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়.........
১। প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।
২।
মানবদেহের চিত্র।
৩। জীব জন্তুর, পাখির ছবি।
কবি গুরুর প্রাকৃ্তিক দৃশ্য ও জীবজন্তুর ছবি গুলো বেশি সমাদৃত হয়েছিল ফ্রান্সে, অপরদিকে মানব চেহারার চিত্র গুলো আলোড়ন তুলেছিল জার্মান সমাজে, স্বীকৃতির এই তফাতটা লক্ষনীয়।
৭।
তাঁর আঁকাআঁকির জগতে সৃষ্টির স্রোত নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি শুধু নরম আর কারুকার্যময় ছবি একে সন্তুষ্ট হননি।
৮।
সাহিত্য সৃষ্টির চিন্তা দর্শনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে স্বীকার করে এগুলেও ছবির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রায় ঐতিহ্যবিমূখ।
৯।
এদেশের শিল্প পরম্পরা থেকে তিনি প্রায় কিছুই গ্রহণ করেননি। তবে সমসাময়িক উইরোপিয় ধারার কিছুটা প্রভাব হয়তোবা রয়েছিল। উনবিংশ শতকের শেষদিকে ইউরোপের আধুনিক চেতনার নতুন যে অধ্যায় রচিত হয়েছিল, তার বেশি প্রভাব দেখা গিয়েছিল রবীন্দ্র চিত্রকলায়।
১০।
চিত্রকলার ক্ষেত্রে বিপ্লব বিগত শতকে ঘটেছিল ইউরোপের, তার সাথে কবিগুরুর পরিচয় হয় ১৯২০-২১ শে পশ্চিম ভ্রমনের সময়।
এই পরিচয় তাকে নিজের চিত্রকর্ম সম্পর্কে সংশয় আর সংকোচ উত্তরণে সাহায্য করেছিল। বাস্তবের হবহু অনুকৃতি নির্মান ছাড়াও যে চিত্রকর্ম যেতে পারে, রং ও রেখার স্বাধীন সঞ্চালনে বাস্তববানুগতাবিহীন পটও চিত্রকলা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে সেই বোধটা তাকে চিত্রকলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ধারা সমন্ধে অস্থাবান করে তুলেছিল।
১১।
শিল্প বাস্তবের কোন হবহু প্রতিরূপ হবে না, শিল্প হবে বাস্তবের সাথে রূপরের ছন্দের মিলনে একটি মৌলিক সৃষ্টি, চিত্রকলার ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধারাটা প্রচলন করাতেই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ঠতা।
১২।
বহুকাল ধরে উপমহাদেশীর চিত্রকলা ছিল বর্ণানাত্মক, ছবিতে ধর্মীয়, সামাজিক, পৌরণীক, ঐতিহাসিক কোন ঘটনা, রাজারাজরারর জীবন অথবা কোন মহিমান্নিত দৃশ্য রচনা করাই ছিল এর কাজ। এখানে রবীন্রনাথই সর্বপ্রথম তাঁর ছবির মাধ্যমে আমাদের দেখালেন ছবিও একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সৃষ্টি এবং রূপ ও ছন্দের মিলনে শিল্পীর অনুভূতির গভীর এর জন্ম।
১৩।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।