আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়: ভগৎ সিং

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত। ‘কেন আমি নাস্তিক’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে ভগৎ সিং লিখেছেন, ‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়।

বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে। ’ [ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ ধারার অন্যতম পথিকৃৎ 'শহীদ-ই-আজম্‌' ভগৎ সিং পূর্ববর্তী ও তৎকালীন অন্যান্য বিপ্লবীদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে আধুনিক যুগের উপযোগী বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানচেতনাকে হাতিয়ার করে বিপ্লবী জীবন গড়ে তোলবার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন তাঁর বন্ধুদের অনুরোধে লিখিত 'why I am An Atheist' নামক প্রবন্ধে। জেলের মধ্যে ফাঁসির অপেক্ষায় যখন তাঁর দিন কাটছিল সেই ১৯৩০-৩১ সালে লেখা হয় এই প্রবন্ধগুলি। ফাঁসির কয়েক মাস পরে 'The People' (Lahore, 27 Sept. 1931) নামক পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। ] একটা নতুন প্রশ্ন উঠেছে।

সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞ ভগবানের অস্তিত্ব আমি যে বিশ্বাস করিনা তা কি আমার দম্ভের জন্য? আমাকে যে এরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে তা আমি কোনদিন কল্পনাও করিনি। কয়েকজন সুহৃদ আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার বন্ধুদের কেউ কেউ (যদি অবশ্য তাদের বন্ধু বলাটা অত্যুক্তি না হয়) আমার সাথে সামান্য যোগাযোগের ভিত্তিতেই ঠিক করে ফেলেছেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে আমি প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, এবং আমার আত্মম্ভরিতাই এর জন্য দায়ী। যাই হোক, বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমি মানুষের এইসব দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে উঠে গেছি – এ গর্ব আমি করি না। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার পরিচয়, এর বেশী নয়।

কেউই এর থেকে বেশী দাবী করতে পারে না। আমার মধ্যেও এই দুর্বলতা আছে, অহংবোধ আমার চরিত্রেও আছে। আমার কমরেডরা আমাকে স্বেচ্ছাচারী বলত। এমনকি আমার বন্ধু বি কে দত্তও মাঝে মাঝে এ-কথা বলতেন। কোন কোন সময় স্বৈরাচারী(despot) বলে আমাকে সমালোচনা করা হয়েছে।

কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেন এবং খুব গুরুত্বের সঙ্গেই করেন যে নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও জোর করে অন্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মতামত চাপিয়ে দিই এবং আমার প্রস্তাব গ্রহণ করিয়ে নিই, এই অভিযোগগুলোর কিছুটা যে সত্য তা আমিও অস্বীকার করি না। এর থেকে আত্মশ্লাঘা আসতে পারে। অন্যান্য প্রচলিত মতবাদের থেকে যেহেতু আমাদের চিন্তাধারা অনেকখানি স্বতন্ত্র, তাকে ভিত্তি করে আমার মধ্যে খানিকটা অহংবোধ আসতে পারে। কিন্তু একে কখনই ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসাবে বলা যেতে পারে না। হয়ত আমাদের মতাদর্শকে ভিত্তি করে একটা যুক্তিসঙ্গত গর্ববোধ আছে, কিন্তু একে কখনই দাম্ভিকতা বলা যাবে না।

দম্ভ বা আরও সঠিকভাবে বললে অহংকার একজন মানুষের নিজের সম্পর্কে একটা মাত্রাতিরিক্ত গর্ববোধ। এমন অহেতুক অহংবোধ আমায় নাস্তিক করেছে, নাকি এ বিষয়ে সযত্ন অধ্যয়ন এবং বহু চিন্তা-ভাবনার ফলশ্রুতিতে আমার মধ্যে ঈশ্বর অবিশ্বাস জন্মেছে – আমি এখন সে প্রসঙ্গে আলোচনার অবতারণা করতে চাই। প্রথমেই একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলে রাখা ভাল যে, আত্মশ্লাঘা আর আত্মম্ভরিতা এক জিনিস নয়। প্রথমত আমি একটা বিষয়ে বুঝতে সম্পূর্ণ অপারগ যে দাম্ভিকতা বা আত্মশ্লাঘা কি করে একজনের ঈশ্বর বিশ্বাসের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একজন প্রকৃতই বড় মানুষের মহত্মকে তখনই আমি অস্বীকার করতে পারি যখন আমি বুঝব আমি কোন দিক দিয়েই তার সমকক্ষ না হয়েও অথবা আবশ্যিক কোন মহৎ গুণ না থাকা সত্ত্বেও কোন কারণে আমি একটু বিখ্যাত হয়ে পড়েছি।

এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু একজন আস্তিক কিভাবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দম্ভের জোরেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করা ছেড়ে দিতে পারে? দুভাবে পারে। হয় ঐ ব্যক্তি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে অথবা নিজেকেই ঈশ্বর হিসেবে ভাবতে শুরু করে। আর এ দুটোর কোন ক্ষেত্রেই সে যথার্থ নাস্তিক হতে পারে না। কারণ প্রথম ক্ষেত্রে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে না।

এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রকৃতির ঘটনাবলীর নিয়ন্তা হিসাবে পর্দার আড়ালে এক সচেতন সত্তার অস্তিত্বকে মেনে নিচ্ছে। এখানে সেই পরম সত্তা হিসাবে সে নিজেকেই ভাবছে না কি নিজের থেকে স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব হিসাবে ভাবছে – এ প্রশ্ন গৌণ। মূল কথাই হল তার বিশ্বাস আছে এবং সে অর্থে সে নাস্তিক নয়। ফলে, আমার কথা হল, আমি প্রথম বা দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়ি না। বরং সর্বশক্তিমান কোন ঐ পরমাত্মার অস্তিত্বই আমি অস্বীকার করি।

কেন করি সেই আলোচনায় পরে আসব। এখানে একটা কথা আমি পরিষ্কার করে বলে যেতে চাই যে কোন দম্ভ থেকে আমি নাস্তিকতার তত্ত্ব গ্রহণ করতে উদ্দীপ্ত হইনি। ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী বা অবতার কিংবা পরমসত্ত্বা-এর কোনটাই আমি নই। সুতরাং দম্ভ থেকে যে আমি এই চিন্তাধারায় পৌঁছইনি এই বিষয়টা পরিষ্কার। এখন আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো আমি দুটো ঘটনার সাহায্যে খন্ডন করতে চাই।

আমার এই বন্ধুদের মতে দিল্লীর বোমা ও লাহোর ষড়যন্ত্র ও মামলাকে কেন্দ্র করে অহেতুক জনপ্রিয়তা লাভ করাই আমার মধ্যে আত্মশ্লাঘা সৃষ্টির কারণ। কিন্তু তাদের যুক্তি কি সঠিক? বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, আমার মধ্যে নাস্তিকতার জন্ম মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটেনি। আমি যখন অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবক ছিলাম তখন এই বন্ধুরা কেউ আমাকে চিনতেন না, তখনই আমার মধ্যে থেকে ঈশ্বরে বিশ্বাস চলে গেছে। সামান্য একজন কলেজের ছাত্রের মধ্যে কোন দাম্ভিকতা থাকতে পারে না, যা তাকে নাস্তিকতার পথে ঠেলে দিতে পারে। (ক্রমশঃ…) মানিক মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ভগৎ সিং রচনা সংগ্রহ’ বই থেকে সংগৃহীত মডার্ন রিভিউ-এর সম্পাদককে লেখা ভগৎ সিং-এর চিঠি জুন 2, 2011 18:30 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.