আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদর্শ থেকে সরে দাঁড়ালো : রাজনীতি না রাজনীতিবিদ?

৬২ বছর আগে আমাদের রাজনীতিকেরা যা পেরেছেন, আজকের রাজনীতিকেরা তা পারছেননা। এ অবস্থায় কি বলতে হবে? সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার দর্শন রাজনীতি কী পিছিয়ে পড়েছে-নাকি পিছিয়ে পড়ছেন রাজনীতির এগিয়ে চলার বাহন রাজনীতিকেরা? দেশের রাজনীতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুসলিম লগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেই জন্ম নেয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে এ দলটিকে শতভাগ অসাম্প্রদায়িক করার জন্য দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগ নামকরণ করা হয়। তৎকালীন রাজনীতিকদের এ দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে তখন তৈরি হয়ে ছিলো একটি অসাম্প্রদায়িক আবহ। গড়ে উঠেছিলো একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত ও প্লাটফর্ম।

যেখানে দাঁড়িয়ে এদেশে মানুষ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো বায়ান্ন এর মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুর করে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। যার পরিনীতি পর্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলো অসাম্প্রদায়িক আদর্শে গড়ে ওঠা আওয়ামীলীগ-গোটা জাতিকে ঐক্য বদ্ধ করে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক পাকিস্তানীদের পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিলো বিজয়। আমরা পেয়েছিলাম আমাদের পরম পাওয় স্বাধীনতা। বাঙ্গালীর এই বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিলো সে সময়কার রাজনীতিকদের রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িকীকরণের সিদ্ধান্তটি।

তখন মানুষের আকাঙ্খার সাথে রাজনীতিকেরা মিলাতে পেরেছিলেন রাজনীতির সিদ্ধান্তকে। যার ফলে রাজনীতিকদের দাবি আর মানুষের চাওয়া পাওয়া একাকার হয়ে গিয়েছিলো। জনতার আশা নেতার ভাষা হয়ে বেড়িয়ে এসেছিলো ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের সংবিধানেও তাই সঙ্গত ভাবেই অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ পড়েছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে। মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী অগণিত বীরের বুকের রক্তে, অসংখ্য মা- বোনের সম্ভ্রম হারানো শাড়ীর আঁচলে লিখা হয়েছিলো অসাম্প্রদায়িকতার জয় গান।

সংবিধানে লিখা হয়েছিলো, সকল ধর্মের সব মানুষই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের বা ধর্মাবলম্বীদের পক্ষগ্রহণকারী নয়। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। আর বিশ্বের কাছে আমাদের সংবিধানের এর ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রটিই ছিলো আমাদের বৈশিষ্ট্য, গর্ব আর অহংকারও। যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করে আওয়ামীলীগের জন্ম ও উত্থান সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কিন্তু আওয়ামীলীগের প্রতিটি পদক্ষেপই বিরোধিতা করে এসেছে।

অসাম্প্রদায়িক শক্তি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, ছয় দফার বিরোধিতা করেছে, গণ অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছে, ৭০ এর নির্বাচনে বিরোধিতা করেছে, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধেও তারা সশস্ত্র বিরোধিতা করেছে। এতো বিরোধিতা করেও সবশেষে সেই কালো শক্তি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পরাজিত হয়ে তারা বসে থাকেনি, চক্রান্তের জাল বিস্তার অব্যাহত রেখেছে। এ ঘৃণ্য পশুশক্তি তাদের চক্রান্তের মাধ্যমে সৃষ্টি করেতে সক্ষম হয়েছে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত করে, জেল হত্যা ঘটিয়ে, এরা আবারো ক্ষমতায় চলে এসেছে স্বাধীন বাংলাদেশে।

ক্ষমতায় এসে এরা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত-চিহ্নিত রাজাকারদের মন্ত্রীসভার সদস্য করেছে। এর সবই যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আর বঙ্গবন্ধুর লাশের ওপর দাঁড়িয়ে পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তির তাণ্ডব নৃত্য। এরাই অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথকে সুগম করে দিয়েছে। এই চক্রান্তকারীরাই রাষ্ট্রের কপালে এঁকে দিয়েছে ধর্মের তিলক। এভাবেই এরা স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পবিত্র সংবিধানকে সংশোধনীর নামে ছুরিকাঘাত করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যা করেছে তাঁর আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতাকে।

হত্যা করেছে সংবিধানের ধর্মনিরোপেক্ষ চরিত্রটিকে। ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এ চক্রান্তটিকে দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি মোটেও। যার জন্যই এদেশে সামরিক-স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন বার বার এতো বেগবান হতে পেরেছে। সামরিক স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবেও অসামান্য অবদান রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিতে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে।

এই রক্তদানের পেছনেও কিন্তু কাজ করেছে মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি প্রবল ভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মানুষ মনে প্রাণে চেয়েছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র আর অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ২০০৮ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে। এ নির্বাচনে একদিকে ছিলো সাম্প্রদায়িক শক্তির পুরোধা জামাত-বিএনপির চারদলীয় জোট আর অন্যদিকে ছিলো অসাম্প্রদায়িক শক্তির ধারক আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট (অবশ্য- পতিত স্বৈরাচারকে সাথে নিয়ে)। ছিলো ছোট খাটো কয়েকটি বামদলও।

তারপরও মানুষ একই আকাঙ্ক্ষা থেকে মহাজোট তথা আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় এনেছে। ক্ষমতায় আসার আগে এবং ক্ষমতায় এসেও আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার বাস্তবায়নের কথা বলেছে। বলেছে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার কথা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কথা। এসব কথা আর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে মানুষ।

এসব প্রতিশ্রুতিতে মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে আওয়ামীলীগের প্রতি। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসাব তাই আজকের রাজনীতিতে চলে এসেছে দারুনভাবে। প্রাপ্তির হিসেব কষতে গিয়ে আজ মানুষ যখনই দেখে কোনো গড়মিল তখনই সে আশাহত হয়। আশাহত হয়ে একে অপরকে প্রশ্ন করে-এখন আমরা যাবো কোথায়? ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার প্রশ্নে এদেশের বুদ্ধিজীবী মহল রাজনৈতিক দল সমূহ, শিক্ষক সমাজ, আইনজীবী ও পেশাজীবীরা সংবিধান সংশোধনী কমিটির আমন্ত্রণে কমিটির সামনে হাজির হয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, তারা ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে চায়। সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতির বিধান চায় না, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে রেখে সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে তারা বিনষ্ট করতে চায় না।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম সংবিধানে থাকুক এটাও তারা চায় না। এগুলো শুনেছেন সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটি। কিন্তু এসব শুনেও পঞ্চদশ সংশোধনী যেভাবে নিয়ে আসা হলো তাতে মানুষ হতাশ হয়েছে আর সংবাদপত্র পড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে শক্তির, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষের শক্তির কথায় কর্ণপাত না করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার পর এখন যদি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়-ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির অধিকার সাংবিধানিক ভাবে রক্ষা করা পরও কোনো ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল কেনো এ সরকারকে সাধুবাদ জানালো না? বরং তারা এখন বলছে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিমের বাংলা অনুবাদে পরিবর্তন এনে সরকার এ সংবিধানকে অসাম্প্রদায়িক করে পবিত্র ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে। তারা এর প্রতিবাদে ইতোমধ্যে হরতালও ডেকেছে।

তাহলে এতসব করে কি লাভ হলো? অন্যদিকে বাম রাজনৈতিকেরা বলছেন, ৭২ এর সংবিধানে ফিরে না গিয়ে এ সরকার জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। আমি সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী একটি লিখায় বলেছিলাম, শেখ হাসিনার সরকার যদি সংবিধানের প্রতিটি পাতা পবিত্র কোরান শরীফের আয়াত দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেন তাহলেও ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এ সরকারকে সাধুবাদ জানাবে না। কিংবা আওয়ামীলীগকে একটি ভোটও দিবে না। কাজেই এদের সাথে আপোষ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। তাহলে কোন লাভের আশায় বুক বেধে আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা সংবিধান সংশোধন করেতে গিয়ে এমনটি করলেন? তার উত্তর পাওয়া যাবে আগামী দিনের সুকঠিন রাজনীতি মোকাবেলার পর্যবেক্ষণ থেকেই।

তবে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মনে রাখা উচিত–ধর্মীয় রাজনীতির আঁড়ালে সবসময় লুকিয়ে থাকে সন্ত্রাস, ধর্মীয় রাজনীতি লালন করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় রাজনীতি সমর্থন করে স্বৈর-শাসনকে। যে রাজনীতিকে আজ গোটা বিশ্ব ঘৃণার চোখে দেখে। যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি বয়ে আনে। এ-সবকিছু বিবেচনায় রেখেই রাজনীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে পাঠ নিয়ে রাজনীতিকদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ রাজনীতিকরা ডাক্তার নন।

একজন ডাক্তারের একটি ভুলের জন্য একজন রোগীর মৃত্যু হয় আর একজন রাজনীতিকের একটি ভুলের জন অপমৃত্যু ঘটে যেতে পারে একটি গোটা জাতির। আমি বিশ্বাস করি দেশের রাজনীতিকেরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তার সাথে এগিয়ে যাবে দেশ ও জাতি। গত ২ জুলাই আওয়ামীলীগ সভা নেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে আওয়ামীলীগ শতভাগ সন্তুষ্ট নয়। আমিও সৈয়দ আশরাফের কথার সাথে শতভাগ একমত পোষণ করছি। লেখক : সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা খবরের সূত্র এইখানে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.