আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে... (দ্বিতীয় পর্ব)

আগামীর স্বপ্নে বিভোর... যারা বানান করে দুই চার অক্ষরও পড়তে পারেন তারাও হাতের কাছে যে কোন ধরনের বই পেলে বিজ্ঞের মতোই হাত দিয়ে নাড়া চাড়া শুরু করে দেন, কখনো কখনো খুব মনোযোগ দিয়ে চোখ বুলাতেও ভুল করেন না। বই পড়তে কার না ভালো লাগে ? তবে সবার বেলায় সব ধরনের বই যে ভালো লাগবে এমন কোন কথা নেই। এই ক্ষেত্রে যার যার রুচি বোধের উপর বইয়ের পছন্দ অপছন্দ নির্ভর করে থাকে। আমিও বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করতাম, এখনো করি। সুখের জীবন বলে খ্যাত ছাত্র জীবনের মধ্য দিয়ে যখন দিনানিপাত করছিলাম তখন পাঠ্য বই আমাকে কখনোই পটাতে পারেনি।

হাতের কাছে অবহেলায় পড়ে থাকা পাঠ্য বইয়ের গা ঘেঁষে থাকা নজরুল, জীবনানন্দ, মার্ক টোয়েন, খলিল জিব্রান, হূমায়ূন, শেক্সপিয়রের কদরটাই বেশি ছিলো আমার কাছে। যা এখনো আছে। কিন্তু তৎকালীন সময়ের বাবারা সন্তানদের এসব ফাজলামী পছন্দ করতেন না বলে আমার বাবাও আমার এসব ইয়ার্কি পছন্দ করতে না। আমার বাবা রাজনীতির উত্তপ্ত বালুকাময় মাঠে দৌড়াতে দৌড়াতে উচ্চ মাধ্যমিকের দেয়াল টপকাতেই ধরা খেলেন বিয়ের পাতানো ফাঁদে। সে সময় বিয়ের ফাঁদে পা আটকালেই অনেক কিছুই আটকে যেত।

বিবাহিত মানেই পরিপক্ষ ও পারিশালীত মানুষ! বিয়ে করেছো ত মরেছো এবার সংসারের ঝোলা কাঁধে তোল এরকম একটা অবস্থা সেসময় সর্বত্রই বিরাজ করতো। বিয়ের পর বিদ্যাপীঠে গিয়ে জ্ঞানার্জন অনেকটাই উপহাস্য ছিলো বলে আর ওপথে পা মাড়ানো হয়নি বাবার। স্কুল কলেজের শিক্ষা তখন বাচ্চা কাচ্চাদের ব্যাপার ছিলো, কোন পরিশালীত পরিপক্ষ মানুষ বাচ্চা কাচ্চাদের কাজ করতে যাবে কেন ? তাইতো আমার বাবাও আর ওই কাজ করতে যান নি। কিন্তু আমার বাবার ইচ্ছে ছিলো তার সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে তার কালো মুখ ফর্সা করবে। রক্ত মাংসের অশিক্ষিত সন্তানদের চাইতে শিক্ষিত হাড় গোড়-ই সেসময়ের বাবাদের প্রিয় ছিলো বলেই শিক্ষকদের কাছে গিয়ে বাবাদের আবদারে প্রায়শই শোনা যেত "ছেলেকে মানুষ করার স্বার্থে রক্ত মাংসের আমার প্রয়োজন নেই, হাড় গোড় ফিরিয়ে দিলেই চলবে" কিন্তু আমার বাবা জানতেন না আমার রক্ত মাংসে যেমন পাঠ্য বইয়ের অস্তিত্ব ছিলোনা তেমনি হাড় গোড়ের ভেতরও নেই।

তাইতো আমি মার্ক টোয়েন পড়ে হাসতাম, নজরুল পড়ে রক্ত গরম করে নিতাম, জীবনানন্দ পড়ে প্রেমে হাবুডুবু খেতাম, খলিল জিব্রান পড়ে জীবন শিখতাম... আর ফাঁক ফোঁকর পেলেই সাদা কাগজে ইচ্ছে মতোন কলম চালিয়ে দিতাম। কলম চালাতে চালাতে হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম কিছু একটা দাঁড়িয়ে গেছে ! দাঁড়িয়ে যাওয়া লেখাটা খামের ভেতরে শুইয়ে পাঠিয়ে দিলাম বাংলা বাজার পত্রিকায়। সে সময়ে বাংলা বাজার পত্রিকা ছিলো পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। বাংলা বাজার পত্রিকা আমাকে নিরাশ করেনি হাতে গুনা কিছু দিনের মধ্যেই আমাকে আনন্দের বন্যায় ভাসালো। আমাকে আর পায় কে! আমার বাবার স্বপ্নকে খুন করতে শুরু হলো নতুন এক জীবন যেখানে কাগজ কলমই আপন।

তখনই গতানুগতিক শিক্ষাকে উষ্টা মেরে নিজের মতো শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলাম। অবশ্য এক্ষেত্রে আমার বাবার বড় একটা ভূমিকা ছিলো তিনি যদি দেশের বাইরে চলে না যেতেন তাহলে হয়তো আমার জীবনটা তার স্বপ্নেই গড়ে উঠতো! বাবা দেশের বাইরে থাকায় আমার উপর চোখ রাঙানীর মতো তেমন কেউও ছিলোনা। তখন নিজের জীবনের উপর নানান মূখী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালাম, কিছু পরীক্ষায় কৃতকার্য হলাম কিছু পরীক্ষায় অকৃতকার্য থেকেই গেলাম। আমার সব সময় লক্ষ্য থাকতো হেঁটে হেঁটে নয় বরং লাফিয়ে লাফিয়ে লক্ষ্যে পৌছানো যখন যে লক্ষ্যে পৌছাতে পেরেছি তখন লক্ষ্যে পৌছেই পেছনে তাকিয়ে দেখতাম সহ যাত্রীরা জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। আবার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্যে নামার পর প্রথম লাফেই উষ্টা খেয়ে পড়ে গেছি আর উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও হয়নি।

একসময় বাবা দেশে ফিরে এলেন, দেশে ফিরে দেখলেন তার অন্যসব সন্তানেরা তার স্বপ্নের আংশিক কেউ কেউ স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছে। শুধু আমি আকৃতিতে মানুষ থেকে গেলাম কিন্তু বাবার চোখে প্রকৃত মানুষ হতে পারিনি। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেলেও সময় বন্ধ হয়না, চলন্ত সময়ের পরিক্রমায় বাবার সাথে এখন আমার দূরত্ব ঘুচেছে। বাবা এখন তার অন্যান্ন সন্তানদের চাইতে আমাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেন, যে কোন বিষয়ে আমিও অনেক কিছুই তাকে অবলীলায় বলার সাহস পেয়ে গেছি। ঘরে টাঙ্গানো সচল ক্যালেন্ডারের ভেতর চাপা পড়ে যাওয়া কোন এক দিনে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপের সুরে বলছিলেন "কেন যে আরো একটু পড়লিনা" আমি তখন তার মুখের উপর বলে বসেছিলাম বাবা এই যুগে যে যত বেশি শিক্ষিত সে তত বেশি পাপী! বাবা তখন ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বলেছিলাম দ্যাখো বাবা এই যুগে মেট্রিক পাশ করে বড় জোর একটা দারোয়ানের চাকরি জুটানো সম্ভব, সেই দারোয়ান যদি ঘুষ খায় তবে সে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ টাকা ঘুষ পেতে পারে।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যে কেউ একটা কেরানীর চাকরি জুটাতে পারে, ঐ কেরানীটা যদি ঘুষ খায় তবে তা এক দুশো টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বি,এ পাশ করে একটা অফিসার পদ জুটানো যায়, অফিসারেরা পাঁচশ এক হাজারের নীচে কখনো নিতে দেখেছো ? এম, এ বা তারচে বেশি শিক্ষা অর্জন করে দখল করা চেয়ারের অফিসারের মন রক্ষা করতে গেলে মধ্য বিত্তের জিভ বের হয়ে আসে। এবার একটু অন্য পথে যাই, যদি কখনো কোন সংসদ সদস্যর মন যোগানোর দরকার পড়ে আর তিনিও যদি উপরের গোত্রীয় হয়ে থাকেন তাহলে তোমার হাত দিয়ে তিল তিল করে যে মার্কেট গড়ে তুলেছো সেই মার্কেটের দুই মাসের ভাড়া তুলে আর ব্যাংকে জমানো লাগবেনা। কোন মন্ত্রীকে খুশি করতে চাও তাহলেই সেরেছে আগামী ছ'মাস আর তোমাকে টাকার গন্ধ শুকতে হবেনা। আল্লাহ না করুক যদি কখনো রাষ্ট্রপতির দ্বারস্ত হতে হয় আর তিনিও যদি ঐ দলের হয়ে থাকেন তাহলে তোমার বাড়ীটা আগে ভাগে বিক্রি করে দিও নইলে পরে তাড়া হুড়া করে বিক্রি করতে গিয়ে ভালোই ধরা খাবে।

বাবা আমার ব্যাখ্যা শুনে তার মাইনাস থ্রি পাওয়ারের চশমা খুলে আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিলেন, ভাব খানা এমন যেন এই ছেলেটাকে দেখতে হলে চশমা পরার দরকার পড়েনা। বাবাকে পরাজিত করার আনন্দ ছেলে যতটা পায় তারচে কয়েক গুণে বেশি হয়তো বাবারা পায়। এখনো আমি বাবার ছেলে যেদিন ছেলের বাবা হবো সেদিন এর সত্যতা যাচাই করে নেবো। কাগজ কলমের ঘষা ঘষিতে সময়টা বড্ড দ্রুত চলে গেলো আমার আর সময় হয়নি কোন স্বীকৃত বিদ্যাপীঠ থেকে একখানা ছাড়পত্র ছাড়িয়ে নেবার। মাথা কিংবা শরীর কোনটার জোর খাটিয়েও টাকা রোজগারের পথ এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি হয়তো একদিন হবে।

সময় সুযোগে কোন একদিন হয়তো নিজের ভাবনা গুলোকেও ভারি মলাটের ভেতর বন্দি করে ফেলতে পারবো। টাকার জোরে ওজনদার মালাটের বইয়ের লেখক হওয়া সহজ কিন্তু টাকার জোরে ওই মলাটের ভেতরে লেখক পরিচিতিতে লেখা যায় না লেখক অমুক অমুক বিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অমুক অমুক ডিগ্রি অর্জন করেছেন... তখনি ভারি নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলি এ কোন ভালোবাসা যে ভালোবাসা ভিখারী করে রেখে গেলো আজীবন ! সুমন আহমদ সিলেট। ৩০শে জুন ২০১১ খৃষ্টাব্দ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.