ছোটবেলায় স্কুল পরীক্ষায় একটা কমন প্রশ্ন ছিল ঢাকা কোন নদীর তীরে অবস্থিত। সেই থেকে আমরা জানি ঢাকার প্রাণ হল বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা ছিল বলেই ঢাকা হয়েছে ঢাকা। ঢাকা হয়েছে রাজধানী। শুধু রাজধানী হিসেবেই ঢাকার বয়স চারশ বছর।
অনেকে আরও বেশি বলে থাকেন। শহর হিসেবে বয়স কত কে জানে? ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী। অনেকের মতে বুড়িগঙ্গা নদী আগে গঙ্গা নদীর মুলধারা ছিল। তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর একটা শাখা। মুঘল আমলে সুবাদার ইসলাম খাঁ বাংলার রাজধানীর পত্তন করেছিলেন বুড়িগঙার তীরে এই ঢাকায়।
বুড়িগঙাকে ভালবেসে ছিলেন বাংলার আরেক সুবাদার মুকাররম খাঁ। তিনি এর সৌন্দর্য্যবর্ধন করেছিলেন। তার শাসনামলে শহরের যেসকল অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোক সজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরুপ সৌন্দের্য্যের সৃষ্টি হতো।
১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দুর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।
সেই বুড়িগঙ্গা আর নেই। বুড়িগঙ্গা এখন আর খরস্রোতা নয়। এখানে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ নেই, মত্স্য সম্পদ কিংবা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী নেই। এ নদী পরিণত হয়েছে রীতিমতো বিষাক্ত বর্জ্যরে বহমান আধারে।
পানি ব্যবহার তো দূরের কথা এসব নদীর সংস্পর্শেও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
এটা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাব নয়। স্বাভাবিক নিয়মে গতিপথ পরিবর্তনের কারণেও দৈন্যদশা হয়নি নদীগুলোর। যে মানুষের প্রয়োজনে এসব নদী, সে মানুষই এর জন্য একমাত্র দায়ী। এককালের প্রমত্তা এ নদীতে প্রতিদিন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গৃহস্থালি, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও নৌযানের বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিদস্যুদের অবৈধ আগ্রাসনই নদীগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
শিল্পবর্জ্য, কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য সবকিছুর আধার হল বুড়িগঙ্গা। এখানে প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি শিল্পবর্জ্যসহ কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে। এসবের সঙ্গে রয়েছে নগরীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের পয়ঃবর্জ্য, যার ২০ শতাংশ পরিশোধিত ও ৪০ শতাংশ সেপটিক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে আংশিক পরিশোধিত এবং বাকি ৪০ শতাংশই অপরিশোধিত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরের গৃহস্থালি ও অন্যান্য শিল্প থেকে প্রতিদিন ৭ হাজার টনের বেশি বর্জ্য উত্পন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ অপরিশোধিত কঠিন বর্জ্য বিভিন্ন সংযোগ খালের মধ্য দিয়ে নদীতে পড়ছে।
এছাড়া ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এমনকি পারদের মতো ক্ষতিকর বিষাক্ত বর্জ্যের ভারে নদীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিশোধন করেও এর পানি পান করা সম্ভব নয়। এছাড়া সদরঘাট টার্মিনালসহ ঢাকা নদী বন্দরের বিভিন্ন ঘাট থেকে প্রতিদিন ৪৯টি নৌরুটের শতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চসহ স্টিমার এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী নৌযান নানা গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও সমসংখ্যক নৌযান প্রতিদিন এখানে আসে। অর্থাৎ আসা-যাওয়া মিলিয়ে ছোট-বড়ো প্রায় ৪০০ নৌযান বুড়িগঙ্গা নদীতে বছরে ১.৭০ থেকে ২.৪০ বিলিয়ন টন পর্যন্ত বর্জ্য ফেলছে। এই পরিমাণ বর্জ্য থেকে টনকে টন রাসায়নিক পদার্থ পলি হিসেবে নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে।
এছাড়া বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ৭/৮ ফুট পলিথিনের স্তরও জমে গেছে। আপনি এই ভেবে আনন্দিত হতে পারেন যে দুনিয়ার আর কোথাও এত বড় পলিথিনের স্তর নাই! দূর্নীতির মত এখানেও আমরা চ্যাম্পিয়ন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের নদ-নদীগুলো দূষণের জন্য অধিক মাত্রায় দায়ী, ৩৬৫টি টেক্সটাইল মিল, ১৯৮টি চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা (ট্যানারি শিল্প), ১৪৯টি ফার্মাসিউটিক্যালস ফ্যাক্টরি, ১২৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ১১৮টি রাসায়নিক ও কীটনাশক দ্রব্য প্রস্তুত কারখানা, ৯২টি পাটকল, ৬৩টি রাবার ও প্লাস্টিক কারখানা, ৩৮টি খাদ্য ও চিনিজাত দ্রব্য প্রস্তুত কারখানা, ১০টি পেপার অ্যান্ড পাল্প ইন্ডাস্ট্রি, ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ৫টি সারকারখানা এবং ৪টি ডিস্টিলারি কারখানা। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী, প্রত্যেক শিল্পকারখানার জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (পানি শোধনযন্ত্র) স্থাপন বাধ্যতামূলক। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ সংক্রান্ত ছাড়পত্র না পাওয়া গেলে কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না।
কিন্তু জনবল ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
সাধারণত প্রতি লিটার পানিতে ৬ মিলিগ্রামের নিচে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) থাকার কথা। বিওডি হল পানিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র অনুজীবগুলো কি পরিমান অক্সিজেন ব্যবহার করে তার পরিমাপ। বিওডি ৬ মিলিগ্রামের বেশি হলে সেখানে কোনো ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এমন কি ক্ষুদ্র জীবানু ব্যাকটেরিয়াও না।
পরিবেশ অধিদপ্তর বুড়িগঙ্গা নদীর মিরপুর ব্রিজ, কামরাঙ্গীরচর, চাঁদনীঘাট, সদরঘাট, ফরাশগঞ্জ, ধোলাইখাল, বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু, হাজারীবাগ এলাকার পানি পরীক্ষা করে দেখেছে, এসব এলাকার প্রতি লিটার পানিতে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ২, ১৮ দশমিক ৬, ২২, ২৪, ২৬ দশমিক ২, ২৮ দশমিক ৪, ১২ দশমিক ৮, ৩০, ৪৫, ৩৩ মিলিগ্রাম। অধিদপ্তরের গবেষণা বিভাগের পরীক্ষাগারের প্রতবেদন অনুয়ায়ী বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে প্রায় ১০ গুণ বেশি বিওডি রয়েছে। যা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।
বুড়িগঙ্গার পানি কার্যত রীতিমতো বিষে পরিণত হয়েছে, যা আদৌ সেবন তো দূরের কথা ব্যবহারযোগ্যও নয়। এছাড়া যেখানে ডিজলভড অক্সিজেন থাকার কথা প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিগ্রামের বেশি সেখানে বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানিতে কোনো ডিজলভড অক্সিজেন নেই বললেই চলে।
বুড়িগঙ্গার পানিতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সিসার পরিমাণও আশঙ্কাজনক। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্টস, ডায়িং, ওয়াশিং, প্লাস্টিক, পলিথিন, চামড়া কারখানা রয়েছে। এ কারখানাগুলোর অধিকাংশের তরল বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত তরল বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে। বুড়িগঙ্গা নদীর ঢাকা অংশে দুটি বড়ো খালসহ অর্ধশত পাইপ রয়েছে যেগুলো থেকে ২৪ ঘণ্টা বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত পানি নদীতে পড়ছে।
একইভাবে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ থেকেও ২৫-৩০টি খালের মাধ্যমে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত পানি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। শিল্পকারখানার নিষ্কাশিত ও অপরিশোধিত বর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গার ও শীতলক্ষ্যার পানি এখন শোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। জীবাণুমুক্ত করার জন্য ক্লোরিন ও এলুমিনিয়াম সালফেট দেওয়া হচ্ছে। পানি অতিমাত্রায় বিষাক্ত হওয়ায় জীবাণুমুক্ত করতে গিয়ে পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অথচ জনশ্রুতি আছে ইংরেজ আমলে শীতলক্ষ্যার পানি বোতলে ভরে লন্ডন শহরে বিক্রি হত।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০০১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত ক্রোমিয়ামসহ ৩০ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য নিয়মিত বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে। দৈনিক যার পরিমাণ ২০ হাজার ঘনমিটার। এসব বিষাক্ত দ্রব্য অপরিশোধিত আকারে নদীতে ফেলায় পানি শুধু দূষিতই নয়, বিবর্ণও হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে নদী এলাকায় ঘুরে দেখেছি এ নদীর পানি এতো কালো এবং কুৎসিত হয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবে পানির দিকে তাকানো যায় না। গন্ধে এর পাশে থাকা যায় না।
এমনকি এর পানি গায়ে লাগলে চুলকানি শুরু হয়। এখনে যারা নৌকা চালান তাঁরা হাতে পায়ে পাস্টিকের গ্লাভস পরে নৌকা চালান। নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও অসহ্য দূর্গন্ধ। শুধু তাই নয় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানিতে বিষাক্ত ক্ষার ও সিসার কারণে জাহাজের তলদেশ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। নৌযানের বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে এই পানি লাগলে মুহূর্তে তাতে মরিচা পড়ে যায়।
বুড়িগঙ্গায যত ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ থাকা সম্ভব তার সবই আছে। শুধু পানি নেই। বুড়িগঙ্গা এখন আর নদী নাই। এটা একটা বিষের প্রবাহ।
পানি দূষণ ছাড়াও নদী দখলের কারণে বুড়িগঙ্গার দুই পাশ দিনদিন ছোটো হয়ে যাচ্ছে।
গত এক দশকে বুড়িগঙ্গা দখল উচ্ছেদের জন্য কয়েক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। তারপরও প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে তাদের দখল অব্যাহত রেখেছে। এমনকি দেখা গেছে একদিক থেকে উচ্ছেদ শুরু হলে শেষ না হওয়ার আগেই আবার দখল শুরু হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার জন্য ২০০৩ সালের ফেব্রচ্ছারি মাসে তৎকালীন নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল ১১ সদস্য বিশিষ্ট বুড়িগঙ্গা টাস্কফোর্স। তবে সেই টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি সরকার।
বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের ১০ ফেব্রচ্ছারি টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে। এতেও আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এই হলো ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার অবস্থা। পৃথীবির আর সব দেশ যখন তাদের নদ-নদী পরিবেশ রক্ষায় ব্যস্ত আর আমরা তখন নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব নদনদী ধ্বংস করতে ব্যস্ত। আমাদের সহ্যশক্তি এত বেশি যে আমাদের কে ভোঁতা বলা যায়।
সরকার, জনগন, পরিবেশবাদী কেউ কিছু করতে পারছে না। বুড়িগঙ্গার দিকে তাই কেবল হতাশাগ্রস্থ বাংলাদেশের ছবি ভেসে উঠে।
তথ্যসূত্র:
১। নিউজ বাংলা
২। উইকিপিডিয়া
৩।
পরিবেশ অধিদপ্তর ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।