কর্পোরেট মুনাফা বনাম প্রাণ
* মূল: রান্ড ক্লিফোর্ড
* কাউন্টারকারেন্টস থেকে ভাষান্তর: শাহ নেওয়াজ সুপ্রিম
গত বছরটা ছিল পৃথিবীতে প্রাণের জন্য ভয়াবহভাবে দুর্যোগপূর্ণ। একই সময়ে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গে কর্পোরেট মুনাফা ৩৬.৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এটা কি কেবলই কাকতালীয়, নাকি প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রভাব আসলেই এতটা বিপদজনক ?
মেহিকো উপসাগরে বিপুল বিষক্রিয়া কিংবা জাপানের রিঅ্যাক্টরগুলো থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার মত দুর্যোগ জীবজগত আর কত সহ্য করতে পারবে ? হয়তো আরও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মুনাফার ভার নিয়ে জীবজগত টিকে থাকতে পারবে ?
মেহিকো উপসাগর ও ফুকুশিমার ঘটনায় দুইটা মিল আছে- প্রথমত, উভয় ক্ষেত্রেই জায়গাগুলো বৃহৎ কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল; দ্বিতীয়ত, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে তথ্য গোপন করা ও মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছিল। সরকারগুলো যখন কর্পোরেটের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, তখন সরকারের বদলে কর্পোরেশন দিবালোকের দখল নেয়, তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে।
কর্পোরেশন নামের ভয়ঙ্কর জিনিসটি যেন নরক থেকে পল্লবিত সবচেয়ে মারাত্মক জীব।
সে অর্থে এটা কোন জীব নয় ঠিকই, কিন্তু ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে কর্পোরেট চাতুরী শুরু হওয়ার পর থেকে মানুষের চেয়ে কর্পোরেশনের অধিকারই তো বেশি !
বড়লোকি আদালত ব্যবস্থায় কোন কর্পোরেশনকে চ্যালেঞ্জ করলে আপনাকে হয়তো হতাশই হতে হবে। আর সেই কর্পোরেশনটা বড়সড় হলে এবং মামলা উপরে গেলে রায় পাওয়ার পর আপনার মনে হবে যেন খাওয়াদাওয়া করে, নিঃশ্বাস নিয়ে, সর্বোপরি বেঁচে থেকে আপনি কর্পোরেট মুনাফাকে বাধাগ্রস্ত করছেন। অতিকথন মনে হচ্ছে? চলুন দেখি কীভাবে কর্পোরেশনগুলো মানুষের মর্যাদা পাচ্ছে। গতবছর কর্পোরেশনগুলোকে নির্বাচনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের রায়টিও দয়া করে বিবেচনা করুন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য কর্পোরেশনগুলো যে ব্যয় করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা বাক-স্বাধীনতার পরিপন্থী।
তাহলে কি পবিত্র গ্রন্থ সংশোধন করে লিখতে হবে, ঈশ্বর কর্পোরেশন সৃষ্টি করেছেন?
কেউ কেউ বলেন অর্থই যত অনর্থের মূল; তাহলে এভাবেও বলা যায় যে, কর্পোরেশনই সবচেয়ে ক্ষতিকর অনর্থের উৎস। প্রাণঘাতী দুষ্ট জিনিসটা সময়ের সাথে সাথে শক্তিবৃদ্ধি করেই চলেছে, যার চাই শুধুই মুনাফা। কোন কৈফিয়ত না দিয়েই জীবজগত ধ্বংস করা আর ধনিককে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলারই অন্য নাম কর্পোরেশন; এটাই কি অনর্থের সবচেয়ে বড় উদাহরণ নয়?
আইনস্টাইন সতর্ক করেছিলেন যে, পারমানবিক বিস্ফোরণ আমাদের চিন্তাধারা ছাড়া আর সবই পরিবর্তন করেছে, যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে অকল্পনীয় দুর্দশায়। এখন সেই অকল্পনীয় দুর্দশা আমাদের হাতের কাছেই- মেইড ইন জাপান! খেয়াল করুন কীভাবে জাপানে তেজস্ক্রিয় দূর্ঘটনার খবর মিডিয়া থেকে উধাও হল। ভুলে যান থ্রি মাইল আইল্যান্ড, ভুলে যান পুরো উত্তর গোলার্ধে ছড়িয়ে পড়া মিলিয়ন প্রাণহন্তারক চেরনোবিল দূর্ঘটনা।
জাপানের ফুকুশিমার অবস্থা আরো ভয়াবহ এবং নিয়ন্ত্রণহীন। সেখানকার তেজস্ক্রিয় দূর্ঘটনাগুলো উত্তর গোলার্ধের বিরাট এলাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে এবং মানুষসহ অগণিত জীব প্রজাতির জিনকাঠামো ভেঙ্গেচুরে দিতে সক্ষম। আমরা বলছি চিরকালীন প্রতিক্রিয়ার কথা। তবে মনে হয় তথ্য আর সত্য গোপনের আরো বড় কারণ হচ্ছে বিশাল কর্পোরেট মুনাফার ঝুঁকিতে পড়া।
নিউক্লিয় শক্তির কর্পোরেশনগুলো ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর মতই ধনী।
যখন ফুকুশিমা তেজস্ক্রিয়তার আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হল, প্রেসিডেন্ট ওবামা তখন আরো রিঅ্যাক্টর তৈরির জন্য ৩৬ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব ঋণ দেয়ার উপর জোর দিচ্ছিলেন (এখনো দিচ্ছেন)। বীমা কাম্পানি আর ঋণদাতারা নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরকে যেন টসটসে লাল আলু মনে করে; তাই তারা পৃথিবীতে প্রাণের প্রতি হুমকি বাড়িয়ে তোলে। শেষ যে জিনিসটা তারা চায় তা হচ্ছে মানুষ যেন ‘বাস্তবতা’ সম্পর্কে সাবধান হয়। প্রশান্ত মহাসাগরে তেজস্ক্রিয় লাভা ঢেলে দিতে না পারলে কি টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কাম্পানি এত লাভ করতে পারত? তারা হয়তো বলবে এতো বিশাল মহাসাগর। কিন্তু ফুকুশিমা থেকে উৎসারিত তেজস্ক্রিয়তার তুলনার এই পুরো গ্রহটিও খুব ছোট।
অর্ধেক দুনিয়ায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো এবং মেহিকো উপসাগরকে বিষাক্ত করার জন্য যেমন এনার্জি কর্পোরেশনগুলো দায়ী, তেমনি এত বছর ধরে বিকল্প জ্বালানীকে দমিয়ে রাখার জন্যও তারা দায়ী। পৃথিবীর শীর্ষ এগারটা কর্পোরেশনের তালিকায় আটটাই এনার্জি কর্পোরেশন। নোংরা প্রাণঘাতী জ্বালানী বাণিজ্য আর জীবাশ্ব-জ্বালানীর উপর একাধিপত্যই এদের শক্তি। এরা প্রতিযোগিতা ধ্বংস করতেই ভালবাসে। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের প্রশ্ন দমিয়ে রেখে তাদের মুনাফা বাঁচানোর সবচেয়ে বড় ঘটনাটি, অন্য কথায় মানবতার বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধের ঘটনা, ঘটে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নিকোলা তেসলা হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে।
তেসলা ছিলেন মানবতার জন্য এক আশীর্বাদ। তিনি লিখেছেন, “মানবতার কল্যানার্থে কাজ না করলে বিজ্ঞান কেবলি বিকৃতি”।
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক তেসলা সম্মেলনে জ্যোতির্বস্তুবিদ অ্যাডাম ট্রমলি বলেছিলেন, শতাব্দীর শুরুতে টেসলা যেসব আবিস্কারের পথ দেখিয়েছেন সেগুলো অনুসরণ করলে আমরা আজ জীবাশ্ব জ্বালানী নির্ভর অর্থনীতিতে নিপতিত হতাম না আর মর্গান-রকফেলার গংরাও এভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতো না।
নিকোলা তেসলার মেধা ছিলো অগাধ। অনন্যসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও কল্পনাশক্তির কারণে তিনি কোন কিছু লেখার আগেই নিখুঁতভাবে আবিস্কার সমাধা করতে পারতেন।
তিনি নিজেই বলেছেন, যখন আমি মনে মনে আবিস্কারটার সর্বোচ্চ উন্নতিতে সমর্থ হই তখন ওই চিন্তাজাত ধারণাটাকে চূড়ান্ত রূপ দেই। বিশ বছর ধরে সবসময়ই আমার ধারণানুযায়ীই আমার যন্ত্র কাজ করেছে, ব্যতিক্রমহীনভাবেই। তেসলার আবিস্কারের মধ্যে আছে রেডিও (তাঁর মৃত্যুর আট মাস পর সুপ্রিম কোর্ট যা স্বীকার করে), এক্স-রে (রন্টজেনের তিন বছর আগে), তেসলা কয়েল, ফ্লুরোসেন্ট বাতি, লেজার, ব্লেডবিহীন টার্বাইন, আড়াআড়ি উড্ডয়নক্ষম উড়োজাহাজ, তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহন, পার্টিকেল বিম, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র প্রভৃতি। মৃত্যুকালে তাঁর পেটেন্টের সংখ্যা ছিল সাত শ’র অধিক। তেসলার কাজের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত- কম্পিউটার বিজ্ঞান, রোবটিকস, রিমোট কন্ট্রোল, রাডার, ক্ষেপনাস্ত্রবিদ্যা, নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান সহ অনেক কিছু।
একটা আবিস্কার ছিল যার কথা তেসলা পুরোপুরি খুলে বলতেন না। বললেও ধাঁধায় ভরা থাকতো সে কথা। এই আবিস্কারটি তাঁর ও অন্যদের সব আবিস্কারকেই ম্লান করে দিতে পারতো। এই আবিস্কারের জন্যই সম্ভবত তেসলাকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং পাবলিক চৈতন্যে তাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ভবিষ্যদ্বানী করছিলেম যে মানুষ একদিন তার যন্ত্রগুলোকে মহাশুন্যের শক্তির সাথে যুক্ত করবে, প্রকৃতির নিজস্ব চাকায় চলবে।
মহাশুন্য থেকে শক্তি গ্রহণের তাত্ত্বিক আলোচনা গত পঞ্চাশ বছর ধরেই ‘মূলধারার’ পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তেসলা যেমন বারবার ইঙ্গিত করেছেনঃ কোন ‘মুক্ত জ্বালানী’র যন্ত্র কখনোই বাজারে আসতে দেয়া হয় নি।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহাশুন্য থেকে জ্বালানী সংগ্রহ বিষয়ে তেসলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সঙ্গে দেখা করার তারিখ ঠিক করেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বলা হয় হার্ট অ্যাটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
কিন্তু তদন্তকারীদের ফাঁস করা তথ্য থেকে জানা যায় যে, ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ স্বার্থে তদন্ত রিপোর্ট গোপন করা হয়েছে; কারণ ওতে লেখা আছে তেসলার মৃত্যু হয়েছে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায়।
এইবার স্মরণ করুন প্রতিযোগিতা! স্মরণ করুন, পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ত্ব! মুক্ত জ্বালানী সকলের জন্য উন্মুক্ত হলে কর্পোরেট মুনাফায় ততটাই ধ্বস নামত, যতটা আমাদের জীবাশ্ব জ্বালানী নির্ভর অর্থনীতি গোটা জীবজগতকে ধ্বংস করছে। মানুষকে তেসলা অনেক দিয়েছেন, আরো অনেক দিতে চেয়েছিলেন। আর কর্পোরেশনগুলো শুধু তাকে খুনই করেনি, তাকে মূলধারার ইতিহাস থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করেছে। কর্পোরেট মুনাফাকে হুমকির মুখে ফেলার মতন বিপজ্জনক কাজ যে আর নাই, তারা এইটা প্রমান করার চেষ্টা করেছে ও করবে।
পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ত্বের জন্য এই বিষয়টা কী ইঙ্গিত বহন করে? মানুষের কর্মকান্ডের মধ্যে সবচেয়ে বিপদসংকুল হচ্ছে জীবজগতকে দুঃস্বপ্নের মত নরকমুখে ঠেলে দেওয়া প্রতিষ্ঠিত জ্বালানীর ধরণগুলোর বিপরীতে বিকল্প জ্বালানীর বিকাশ। প্রাণের অস্তিত্ব ধারণের ক্ষমতা জ্যামিতিক হারে কমছে পৃথিবীতে; এই ঘটনাটি পরিবেশিত হচ্ছে কর্পোরেটের সৌজন্যে। একটা জ্যান্ত গ্রহের কৃত্রিমতাময় মানুষগুলোর একটাই ধ্যানজ্ঞান- মুনাফা, কেবলই মুনাফা।
একবার ভাবুন তো, ঘুম থেকে উঠে জানলেন পৃথিবীতে কখনোই জীবাশ্ব জ্বালানী নির্ভর অর্থনীতি ছিল না। যুদ্ধ- দূষণ- জলবায়ু হুমকি- খুন- ক্যান্সার- দাসত্ব- নিঃসকরণ আর সম্পদের অশ্লীল কেন্দ্রীকরণ, প্রাণের প্রতি সব হুমকি কেবলই দুঃস্বপ্ন ছিল, সত্যি নয়।
কারণ অর্ধশতাব্দী আগে আমরা নিকোলা তেসলার কথা মত ‘প্রকৃতির নিজস্ব চাকায়’ ভর করে সত্যিকারের উৎকর্ষময় সভ্যতা গড়ে তুলেছি।
চেরনোবিল আর ফুকুশিমা ঘটেই নি!
ভাবুন তো, কর্পোরেট মুনাফার চেয়ে পৃথিবীতে জীবনের গুরুত্ব বেশি।
এর সবই সম্ভব হতো, যদি আমরা জেগে উঠতাম।
লেখকের পরিচিতিঃ র্যান্ড ক্লিফোর্ড একজন অ্যামেরিকান কথাসাহিত্যিক। তাঁর উপন্যাস প্রিস্ট লেইক ক্যাথেড্রাল, টাইমিং, ক্যাসলিং প্রভৃতি প্রকাশ করেছে স্টারচিফ প্রেস।
সহসা বের হবে ইবুক আকারেও। ক্লিফোর্ড ও তার স্ত্রী টেলিভিশন বর্জন করেছেন এবং অন্যদেরও করতে বলেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।