মৌমিতার ফোন পেয়েই সবার আগে ডাইনিং এ এসে টেবিল ক্লিন করা শুরু করলো রুমি। যদি মৌ ফিরে কোনোভাবে টের পায় যে ব্রেকফাস্ট করা হয় নাই তাইলেই বাড়ি ১২৪ ফ্লোরে উঠাবে। তারপর লিফট ছাড়াই আবার নামায় ছাড়বে। মাই গড! নো ওয়ে!
তড়িঘড়ি সিন্কে বাটিতে ঢালা সকালের দুধ ফেলে দিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিলো রুমি। ১০ মিনিটের মাঝে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে যাবে ভাবতেই আবার মৌমিতার ফোন।
- আমি রওয়ানা দিয়ে দিয়েছি। তুমি রেডি হয়ে থাকবা কিন্তু ওকে?
- ওকে ওকে জান আমি ২ মিনিটেই রেডী হয়ে যাচ্ছি। তুমি আসো।
লাইন কাটতেই আবারও মৌমিতার ফোন। উফফফ! নাহ আর পারা যায়না।
-শুনো এখুনি রেডি হবা কিন্তু। খবরদার কম্পুবৌ এর সামনে বসে থাকবা না।
- আচ্ছা আচ্ছা থাকবো না ।
- শুনো।
-তুই এখন রাখবি নাকি এমনেই জ্বালাতেই থাকবি?
- আবার তুই??? মৌমি চিলচিৎকার দিয়ে উঠে।
- না না তুই না মানে। মানে তুমি এইভাবে সময় নষ্ট করলে আমি কেমনে রেডি হবো সোনামনি?
- ওকে ঠিক আছে। শুনো বাবু।
- আবার কি?
- ঐ যে নেভি ব্লু শার্টটা পরো কিন্তু ওকে?ঐযে , বুঝছো তো।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
বুঝছি বাবা ঐটাই পরবো। এখন তুমি কি আমাকে রেডী হইতে দিবা নাকি আরও কিছু বলবা?
- না আর কিছু না যাও তাড়াতাড়ি রেডী হও। শুনো
- জী? বলেন মহারাণী।
-ঐ শার্টটা কোথা্য আছে জানোতো?
-আমাদের ওয়ার্ডরোবের স্পেশাল তাকে। মানে আমার বিয়ের শাড়িটা আর তোমার শেরওয়ানীটা যেখানে থাকে সেখানে।
- উফফ জানি। তুই ছাড়বি?
-আ্যই আবার??
- ওহ ওকে ওকে স্যরি। আর ভুল হবেনা। স্যরি। সোনামনি তুমি এখন তাড়াতাড়ি চলে আসো।
ও হ্যাঁ একটা কাজ করতে পারবা?
- কি কাজ?
- আসার সময় আমার জন্য একটা জিনিস আনতে পারবা?
- কি?
- মানে এক প্যাক Marlboro ...
উফ আর শুনতে হয়না। শুরু হয়ে যায় মৌ এর চিল-চিৎকার। কানে আঙ্গুল দেয় রুমি। ফোন অফ করে দেয়।
মনে মনে হাসে যতই চিল্লাক আর যতই স্মোকিং মৌমির অপছন্দ হোক রুমি একটা জিনিস চাইছে আর মৌ সেটা দেবেনা ।
হতেই পারেনা।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ধানমন্ডির কফি ওয়ার্ল্ডের কোনার দিকের গ্লাস ওয়ালটার কাছে ছোট্ট একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে মৌমিতা আর রুমি। প্রায়ই ওরা আসে এখানে। বিকেল পার করে সন্ধ্যা কাটিয়ে একটু রাত হলে তারপর ওঠে।
তারপর সোজা ছুটে চলে আশুলিয়া বা সোনার গাঁ রোড ধরে রুমির প্রিয় ফিল্ডারটা নিয়ে। এত জায়গা থাকতে ওদের ঠিক এই ধানমন্ডি ২৭ এর এই কফিশপটাতে প্রায়ই ঢু মারার একটা বিশেষ কারণ আছে।
-রুমি তোমার মনে আছে? তিন বছর আগের ঠিক এমনি এক সন্ধ্যায় এ টেবিলটাতেই বসেছিলাম আমরা।
- হুম মনে আছে। আর তোমার হাতটাও এমনি ছিলো আমার মুঠোর ভেতরে।
টেবিলের উপর পড়ে থাকা মৌ এর বাম হাতটা রুমির ডানহাতের মুঠোয় চাপ দিয়ে বলে রুমি।
রুমির সাথে মৌ এর প্রথম দেখা হবার ঘটনাটা বড় অদ্ভুত। এক বিকেলে মির্জার সাথে শামসুন্নাহার হলে যেতে হয়েছিলো তাকে। মির্জার তার কাজিনের কাছে কি এক জরুরী প্রয়োজন ছিলো। সাথে গিয়েছিলো রুমি।
মিলি মিরজার কাজিন তার সাথে হলগেইটে এসে দাঁড়ালো এক মেয়ে। এমন কোনো আহামরি সুন্দরী নয় কিন্তু হঠাৎ যেন সেই বসন্ত বিকেলের চারিদিকের আলো তার রঙ পালটে ফেললো। হলের মরিচা ধরা কালো গেইটটা এক নিমিষে হয়ে গেলো কোনো রুপকথার রাজপ্রাসাদের ঝলমলে তোরণ। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ছাই আর গোলাপীর মিশেলে এক অদ্ভুত রঙা সালোয়ার কামিজে এক দুষ্টু পাজী কিন্তু আল্লাদী টাইপ রাজকন্যা।
মেয়েটা কি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রে বাবা! এ্যই মেয়ে এমন নির্লজ্জের মত হা করে তাকিয়ে থাকতে হয় অজানা অচেনা কোনো আমার মত হ্যান্ডসাম হিরোর দিকে!! নিজের মনেই বললো রুমি।
ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠলো মিটিমিটি হাসিটা। কিন্তু চোখ ফেরাতে পারছিলোনা সে।
সেই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় কি যে অদৃশ্য এক বন্ধনে জড়িয়ে ফেললো ওকে সেই দুষ্টু মেয়েটি।
তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মৌ এর ফোন নং যোগাড় করতে হয়েছে ওকে। মিরজার কাজিন মিলিটা এমন হারামী, মৌ এর বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া স্বত্তেও কিছুতেই দেবেনা সে মৌ এর নং।
রুমিকেও কি আর সোজা বান্দা পেয়েছো বাবু? সেও তক্কে থাকলো।
-হ্যালো কে বলছেন।
-আমি।
-আমিটা কে?
-মানুষ।
- মানুষ তো তার নাম কি? নাম নাই?
- নাম বলা যাবেনা।
-কেনো? কেনো বলা যাবেনা? জানেন না ফোন করে নিজের পরিচয় ... ... ....একগাদা লেকচার ঝাড়তে শুরু করে দিলো মৌ...
-আপনার নাম কি?
-আমার নাম কেনো? জানেন না যাকে ফোন করছেন তাকে আগে পরিচয়... আবার শুরু হলো মৌ এর লেকচার।
- জানতাম আপনি বলতে পারবেন না আপনার নাম।
- কেনো কেনো পারবোনা?
- কারণ আপনার নামটা খ্যাত মার্কা। সত্যি কথা বলতে কি একেবারেই জঘন্য।
- কি!!!!!! ঘটনার আস্মিকতায় মৌ এর বুঝি বাকরোধ হয়ে যায়।
- তো তো তো তোমার নাম কি শুনি হে? এহ এসেছেন অন্যের খ্যাত নাম দেখতে। তো তো তোর নাম কি?
- হে তুই তুই করছেন কেনো? নামের মত দেখি আপনি স্বভাব চরিত্রেও আরেক খ্যাত।
- কি!!!!!!!!!!!!!!!! মৌ কি করবে, কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না।
- আমার নাম রুমি। হে হে হে হে হাসতে থাকে রুমি।
দেখছেন তো নামটা কেমন জোস! নামের মধ্যে একটা শান্তি শান্তি ভাব আছেনা । নাম নিলেই কত শান্তি লাগেনা? বলেন বলেন ।
- এহহহহহহহ শান্তি শান্তি না ? কিসের শান্তি?
-শুনেছি আপনি চাপাবাজ। বাট অলওয়েজ চাপাবাজি করতে হয়না। বলেন সুন্দর না আমার নামটা?
- সুন্দর না তো বান্দর! একেবারেই বান্দরের মত নাম।
-এই রকম করলে কিন্তু আমি আমার সাথে আপনাকে কথা বলতে দিবোনা।
-এহহহ! তো আমি কি কথা বলতে আসছি? ভাগ এখান থেকে?
-কোনোই এহ মেহ না । আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলতেছি।
এইভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন । এরপর হঠাৎ একদিন মৌ দের ভার্সিটির বর্ষাকাব্যের এক আবৃতি্ত অনুষ্ঠানে মিরজার পিছু ধরে হাজির হয়ে যায় রুমি।
আকাশনীল রঙ শাড়ি আর বেলফুলের মালা খোঁপায় জড়ানো আবৃত্তিরত মৌকে দেখে আবারও তখন মুগ্ধ রুমি!
অনুষ্ঠান শেষে মিরজা আর রুমির পাশেই এসে বসলো মিলি আর মৌমিতা।
-সুন্দর লাগছে আপনাকে। খুব বেশী বেশী সুন্দর! যেন বৃষ্টিতে ভেজা এক স্নিগ্ধ রজনীগন্ধা। রাঙা হয়ে ওঠে মৌমিতার দুগাল। ( মনে মনে হাসে রুমি, নিজের মনেই বলে, ফোনে যেমনে তুই তোকারি, মুখরা রমনীগিরি করো এইখানে তো দেখতেসি একেবারেই লজ্জাবতী লতা!)
- ধ্যাৎ কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি ঠিক ঠিক বুঝে যাই।
- মিথ্যা বলে কি লাভ? সত্যিকে সত্যি বলার সাহস আমার আছে। হা করে তাকিয়ে থাকে মৌমিতা এই বাকপটু ঠোঁটকাটা ছেলেটার দিকে। তড়িঘড়ি কথা ঘুরাতে চেষ্টা করে।
- আচ্ছা আবৃতি কেমন লাগলো সেটা বলেন?
-ওহ আবৃতি! সেটা শুনে মনে হয়েছে একটা অসাধারণ কবিতার মৃত্যু ঘটলো।
- মানে!!! চোখ গুললু গুললু হয়ে যায় মৌমিতার।
- মানে আর কিছুই না কবিতাটা অসাধারণ বাট আবৃতিটা ....থাক আর বলতে চাচ্ছিনা। হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে রুমি। ( এমনিতেই কবি ও কবিতা দুই ই রুমির অপছন্দের বিষয়। তায় মৌকে তার নিজস্ব স্বভাবসিদ্ধ চপলতায় কনফিউজড করতে এমন কিছুই বলে দেয় রুমি। )
ওদের কথা শেষ হতেই মিলি বলে ওঠে,
-রুমিভাইয়া এই কবিতার কবির নাম মৌমিতা নাহরীন আর ও এবারের আমাদের ভার্সিটির আন্তঃ আবৃতি প্রতিযোগীতায় ফার্স্ট হয়েছে।
এ কথা শোনার পর রুমির চোখ পুরাই ছানাবড়া হয়ে যায়। আর মৌমিতা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে। সেসব কথা মনে করে আজও হাসি পায় মৌমিতার।
-- তুমি আজীবন আমার সাথে জুলুম করেছো।
- আরে! জুলুমের কি? আমি মরতেসি তোমার বিরহে আর তুমি স্বীকার করবা না? মানে তুমিও তো মরতেসিলাই।
বাট স্বীকার করবা না?
- আমি মরতেসিলাম!
- না তো কি? মরতেসিলা না??? বুকে হাত দিয়ে বলো। নিজের বুকে না হাত দাও আমার বুকে হাত দিয়ে বলো দেখি।
- চুপ একদম। মৌ সত্যিই মনে হয় রেগে উঠে।
- কি দেখলা তো সত্যি বলতে ভয় পাও তুমি।
- ভ্যা ...... ভেংচি কাটে মৌ। দুজনেই হাসতে থাকে।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে মৌমিতার মুখটা। চোখের ভেতর পানি টলটল করতে থাকে। ।
মৌমিতার এসব অদ্ভুত আচরণের সাথে পরিচয় আছে রুমির। তাই পাত্তা দেয়না তেমন। তবে মৌমিতার এমন ইমোশনগুলো এনজয় করে সে। দুষ্টুমী ভরা হাসি মুখে কিছু বলতে যায়। তার আগেই হঠাৎ রুমির বামগালটা ওর ডানহাতের তালুতে পরম মমতায় বুলিয়ে দেয় মৌ।
যেন রুমি ছোট্ট এক তিন বছরের বাচ্চা।
রুমি মনে মনে হাসে। আশে পাশে এত মানুষ জন... অন্য সময় হলে.... হেন তেন কত কথা.......অথচ কোনো খবরই নেই এখন লজ্জাবতী লতার!
তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্ত দুপুরবেলা
চলবে.....
তুমি আমার প্রথম সকাল ....তুমি আমার সারাবেলা....
তুমি আমার ক্লান্ত দুপুর... তুমি আমার সারাবেলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।