আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার সন্তানের সামনে আমি মাথা নিচু করে দাঁড়াতে চাই না- আপনি চান?

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............। যে জনপদের ‘সম্মানিত’ শিক্ষকেরা, বুদ্ধিজীবী-লেখকেরা আপনাকে ভুল রাস্তার দিশা দিয়ে ‘অন্ধকার বিদিশার নেশায়’ বেদিশা করে রাখে- অলীক স্বপ্নে বিভোর করে, কবিরা নিরব থাকে, পত্রিকাওয়ালা মিথ্যার বেসাতী করে, সে জনপদ আজ আপনার জন্মভূমি- বাংলাদেশ। এখানে কেউ নেই আপনার পাশে- আপনি নিজে ছাড়া। আপনি আজ আপনার নিজের সহায়। আপনার হাতেই আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ।

চার দশক আগে আমরা সুযোগ পেয়েও যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারি নি। আজ যখন এ নিয়ে আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করি, তখন তিনি চুপ হয়ে যান; সন্তানের সামনে নিচু হয়ে যান। আর সন্তানের সামনে ঘাড়-গর্দান ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক পিতার কালো মুখের সামনে দুনিয়া ভারী হয়ে যায়- অনেক ভারী। আজ থেকে দুই দশক পরে যখন আমার সন্তান আমাকে গ্যাস-বিদ্যুৎবিহীন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবে, আমি তখন নিচু হতে চাই না। আমি বলে দেব, ‘আমি চেষ্টা করেছিলাম, শেষবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম।

হয়তো থামাতে পারি নি- কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম। আমি জীবনে একটা হরতালকে মনে প্রানে সমর্থন দিয়েছিলাম। ’ কিন্তু, আমরা তো ‘এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি,’ আমাদের ‘অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে’। আপনি কী ভাবছেন, আপনার পছন্দের রাজনৈতিক দলটি আপনাকে আশ্রয় দেবে? আপনার আর আপনার সন্তানের অন্ন-বস্ত্রের যোগান দেবে! ভুলে যান, কখনো হবার নয়। সদ্য ‘গৃহহীন’ নেত্রী এখন তাঁর ‘অবুঝ’ পুত্রদায়ে ভারাক্রান্ত।

অন্য দল তার নেতৃবর্গের যুদ্ধাপরাধের দায়মোচনে ব্যতিব্যস্ত। সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অর্ধ শতকের অবিচ্ছিন্ন লড়াইয়ে ক্লান্ত আরও কেউ কেউ। নিজের নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত বাকিরা। না। এই অভাগা দেশ ছেড়ে যারা অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন- এই লেখা তাঁদের জন্য নয়।

এই লেখা তাঁদের জন্য, যারা এই পোড়ার দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না অথবা বোকাসুলভ ভালবাসায় বন্দী হয়ে যাচ্ছেন না- মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। একটু মালয়শিয়া থেকে ঘুরে আসি। সাল ১৯৮৯। দোর্দডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের হৃদপিন্ডে বাইপাস করা লাগবে। নিজের দেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র- এই দুইয়ের মাঝে মাহাথির নির্দ্বিধায় দেশকে বেছে নিলেন।

তাঁর নিজের ভাষায়, “মালয়শিয়ান চিকিৎসকদের উপর আমার বিশ্বাস রাখতেই হোত এবং আমি জানতাম যে, আমি নিজে যদি এই উদাহরন সৃষ্টি করতে না পারি, তবে কেউ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উপর আস্থা রাখবে না। ” ঘটনা এটাই। এখানে, কেউ আমার-আপনার উপর আস্থা রাখে না। সবাই ভাবে, আমি-আপনি দুর্বল, অবুঝ। ভুলে যায়, একদিন কারো পরোয়া না করেই আমি-আপনি এই দেশ দখলদার মুক্ত করে ছিলাম।

ভুলে যায়- কেউ বলে নি; আমি-আপনি মিলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকে জীবিত করেছিলাম। আমাদের চাইতে বেশি দেশপ্রেমিক সাজতে গিয়ে কেউ কেউ তাই অতীত ভুলে যায়! আমরা বাংলার চাষাভুষা- আতরাফ জনতা। শত বছর ধরে আমরা মহাজনের বর্গা আর সুদের জালে নিষ্পেষিত। তাই, কে আজ আমাদের বর্গাচাষের সহজপাঠ শেখাতে আসে? আমরা ধরিত্রী মাতার সম্পদ কুড়িয়ে জীবন চালাই। ‘টোকাই’ বলে সম্বোধন করলে আমাদের অসম্মান হয় না! ‘তুমি শুয়ে রবে তে-তালার ‘পরে, আমরা রহিব নিচে, অথচ তোমাদের দেবতা বলিব, সে ধারনা আজি মিছে।

’ আমরা কমশিক্ষিত, নিরক্ষর। আইনের মারপ্যাঁচে ভরা চুক্তি-নীতিমালা আমাদের জন্য না। ওগুলো লেখাই হয় এমন করে যেন আমরা এক বর্ণও বুঝতে না পারি! তাই, মডেল পিএসসি-২০০৮, সমুদ্রসীমা-ব্লক-আনক্লজ(UNCLOS)- এই সব বুঝি না! বুঝি না ১৫.৫.৪ ধারায় কী লেখা আছে। জানতে চাই না, কার স্বার্থে ১০.২৭ এ রদবদল হয়েছে। ৮০-২০, ৫৫-৪৫ এর হিসেবে মাথা নষ্ট করতে চাই না।

শুধু জানি, ঐখানে- ঐ অতল সমুদ্রে যদি আদৌ কোন তেল-গ্যাস থাকে, তবে সে সব শুধু আমাদের, আর কারো না! ১ পার্সেন্টও অন্য কোথাও যাবে না। কনোকোফিলিপ্‌স পেট্রোলিয়াম শিল্পে বিশ্বে পাঁচ নম্বরে না পঞ্চাশ নম্বরে- সেটা জেনে আমাদের কোন কাজ নেই। জানতে চাই না, বিশ্বের কতগুলো দেশে ওরা তেল-গ্যাস তুলছে। আগের চেয়ে এই চুক্তি ‘কতটা ভারসাম্যপূর্ণ’ সে হিসেব কষার ফুরসত নেই আমাদের। শুধু জানি, ওরা সব পুঁজির আড়তদার, মুনাফার সওদাগর।

অন্যত্র বেশি মুনাফা পেলে ওরা এক ফোঁটা তেল-গ্যাসও আমাদের দেবে না! আমি প্রশ্ন করতে চাই, আমার টাকায় বাপেক্স বানিয়ে তাকে কেন নপুংশক বানিয়ে রাখা হয়েছে? রিগ কেনার জন্য ৮০ কোটি টাকা পাওয়া যায় না, ভর্তুকির ২০০০ কোটি টাকা কার পিতার সম্পত্তি থেকে আসে? ৩ তারিখের হরতাল এ কথা গুলোই স্মরণ করিয়ে দেবে তাদের, যারা গোপন বার্তায় দেশের সম্পদ অন্য দেশে পাঠানোর আশ্বাস দেন– যারা আমাদেরকে আইনের সবক দিতে চান- যারা আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সিঁধেল চোরের জন্য সদর দরজা খুলে দেবার বন্দোবস্ত করেন। না। তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি আমাদের কেউ না। দুই দশক ধরে কাজ করেও তাঁরা আমাদেরকে সম্পদের মালিকানার চেতনার উন্মেষ ঘটাতে পারেন নি। কোন পথে আমাদের উত্তরণ, তা তাঁরা আজো বোঝাতে অক্ষম।

কিন্তু, এখন বিবাদের সময় নেই। ‘জাগবার দিন আজ, দূর্দিন চুপি চুপি আসছে’। আমরা সে দূর্দিনকে রুখে দেব। দু'’দশক পরে আমার আদরের কন্যাকে বুকের কাছে চেপে ধরে বলব, ‘আমার সাধ্য ছিল না বলে সেদিন আমি ঐ সম্পদ তুলি নি, তোর জন্য, তোদের জন্য পরম মমতায় রেখে দিয়েছি। যা, এখন তুলে নে।

এই সম্পদ তোর জন্য, তোর অনাগত সন্তানদের জন্য। ’ না। এ অলীক স্বপ্ন নয়। একটু সাহস করলে- প্রতিবাদী হলে এ স্বপ্নই বাস্তব হয়ে ধরা দেবে। ঢাকায় যারা পারব হরতালে রাস্তায় নামব।

আর পুঁজির দুনিয়ায় জীবিকার হাঁড়িকাঠে আমরা যারা বলি হচ্ছি প্রতিনিয়ত, তারা আর কিছু না পারি অন্যদের সচেতন করে তুলব, একটা কালো ব্যাজ পড়ে অফিস করব। শরীরী-প্রতীকী সকল প্রকার প্রতিবাদে জানিয়ে দেব- “হে পরাক্রমশালী শাসকগন! তোমাদের শক্তি আছে; আমাদের সম্পদ অন্যকে দিয়ে দিতে পারো। আমরা আপাতঃ শক্তিহীন। তাই বলে ঘুমিয়ে নেই। আমরা মোটেই পছন্দ করছি না এ সব।

’ ‘যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়; ...যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখাল্লায়; ...যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়; ...যখন আমার কন্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়; নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়। .. ...আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায় দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে কোনঠে সবায়?’’ এই কবিতার লেখক হয়তো আজ আর নিজের কবিতায় বিশ্বাস রাখেন না। কিন্তু, আমরা আমাদের দেশপ্রেমের উপরে এখনো বিশ্বাস রাখি। এদেশে যতবার মীরজাফর-জগৎশেঠেরা জন্মেছে, ততবার সিরাজ-মোহনলাল রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ কী এর ব্যতিক্রম হবে? আমার বর্ণমালা ব্লগ এবং আলাপ -এ প্রকাশিত।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।