ছোটকালে দুষ্টের সর্দার ছিলাম। তাই মা আমাকে মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন বাবার সাথে তার কর্মস্থল সোনারগাঁয়ে। সেখানে খংসারদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীতে গিয়ে ভর্তি হই। মেজ ভাই পাশ্ববর্তী উলুকান্দি মাদ্রাসায় পড়তো আর বড় ভাই বাবার সাথে ব্যবসা দেখাশুনা করতো। মা, শৈশবের বন্ধু, সর্বোপরি গায়ের ধুলাবালি ছেড়ে আসায় প্রথম প্রথম থাকতে খুব কষ্ট হতো।
অনেকটা ডাঙ্গায় তোলা কৈ মাছের মতো আমার অবস্থা। বাবার আদর, ভাইয়ের øেহেও অশ্র“ সংবরণ হতো না। এভাবেই একদিন প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে বৈদ্যের বাজার এন এ এম পাইলট হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। পড়াশুনায় মধ্যম মানের ছাত্র ছিলাম। ৯ম শ্রেণীতে উঠার পর কেন জানি হঠাৎ ভাল ছাত্রদের সংজ্ঞায় আমি পড়ে গেলাম।
মানবিক বিভাগ নিলাম। ল্য করলাম, আমার প্রতি ক্রমান্বয়ে শিকের øেহ মমতা বেড়ে গেল, সমীহ পেতে শুরু করলাম সহপাঠীদেরও। ৯ম শ্রেণীর বেশীর ভাগ সুন্দরী মেয়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হল। মানবিক বিভাগে আমার থেকেও ভাল ছিল ছেলেদের মধ্যে আমিন উদ্দিন। কিন্তু বিভাগওয়ারী বিষয়ে বরাবরই আমি পরীায় বেশী নম্বর পেতাম যা এস এস সি পরীায়ও অব্যাহত ছিল।
৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় সহপাঠী সুন্দরী মেয়ে বান্ধবীদের কাছ থেকে প্রচুর প্রেমের অফার পেয়েছি। কিন্তু গ্রহণ করিনি। বিশেষ করে “আর” এবং “জে” অদ্যারের দুই বান্ধবীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। ৯ম শ্রেণীতে ওঠার দুই মাসের মধ্যেই প্রস্তাব আসে শ্যাম বর্ণের অদ্যারের এক বান্ধবীর কাছ থেকে। স্কুল থেকে যাওয়ার পথে হাড়িয়া উঁচু ব্রিজে ওঠার পর আমাকে তার ভাললাগা ভালবাসার কথা জানায়।
প্রতি উত্তরে আমি বলেছিলাম ৯২ সালে এস এস সি পরীা দেওয়ার পর তোমার বাবা মা তোমাকে বিয়ে দিবে। আর পরীা দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার পথ তখন আমার শুরু হবে মাত্র। সুতরাং নো প্রেম, নো ভালবাসা। তখনি সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, তাহলে কি তুমি কোন দিন প্রেম করবে না? তার উত্তর দিতে গিয়ে আজ আমার মনে হচ্ছে, বিধাতাই সেদিন আমার মুখ দিয়ে সে কথাটি বের করে দিয়েছিলেন, ‘হ্যা. প্রেম যদি জীবনে করি তা হলে তাকে অবশ্যই বিয়ে করব।
১৯৯২ সালে এস এস সিতে প্রথম বিভাগে পাস করে চলে আসি আন্টির বাসা কুমিল্লায়।
এখানে কলেজে ভর্তি হয়ে পরিচয় হয় জ, জা, রো,কা অদ্যারের চার বান্ধবীর সাথে। ছাত্র জীবনে সব সময়ই আমার ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধু বেশি ছিল। এর মধ্যে পরিচয়ের শুরুর দিন থেকেই ‘জা’ অদ্যারের বান্ধবীর প্রতি আমার আন্তরিকতা বেশী অনুভব করি। একই সাথে ফিল করি বিপরীত দিকের অবস্থাও। আস্তে আস্তে ক্যালান্ডারের পাতা থেকে ঝরে যাচ্ছে দিন মাস-বছর।
অপর দিকে আমরাও পরস্পর পরস্পরের কাছে চলে আসি। কেউ কাউকে একদিনও না দেখে থাকতে পারতাম না।
রোজার কারণে কলেজ এক মাস বন্ধ হবে। তখন দেখা হবে কিভাবে? বলে রাখা ভাল. উভয় পরিবার জানে আমরা খুব ভাল এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। সত্যি বাস্তবেও তাই ছিলাম।
কলেজ বন্ধ হবার পর শুরু হলো একে অপরকে চিঠি লিখার পালা। প্রথমে আমি তার নিজ নাম চিঠিতে ব্যবহার করলেও একদিন চিঠিতে তাকে জানিয়ে দেই আজ আমি তোমাকে গোলাপী বলে ডাকবো। সেই থেকে আজ অবধি তাকে গোলাপী বলেই ডাকি। আর সে আমার নাম দেয় সপু। ইন্টার শেষ করে অর্নাস-মাস্টার্স এক সাথে শেষ করলেও ১৯৯২ সাল থেকে ২০০১ সাল অর্থাৎ গত ৯ বছরে আমরা কেউ কাউকে বলিনি, আমি তোমাকে ভালবাসি।
যদিও ভালবাসার নীল পদ্ম আমাদের হৃদয়ে প্রতিণই শিহরণ জাগাতো। আমার আন্টি গোলাপী আর আমাকে খালি বাসায় রেখে যেতো। এমন কত দিন হয়েছে তা হিসেব করে বলা যাবে না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা কেউ কাউকে বিয়ে করব না, সারা জীবন বন্ধু হিসেবে থাকব। বাবা-মার পছন্দমত উভয়ে বিয়ে করব।
আমরা প্রমাণ করব, আমরাই শ্রেষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু গোলাপীর কাছে দেয়া সেই কথা আমি রাখতে পারিনি।
এক দিন আমি আমার দেশের বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি আব্বা অসুস্থ। মা এবং আব্বা উভয়ের কথাতেই বুঝলাম, আমার বড় দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের প্রতি তারা সন্তুষ্ট নয়।
দুই বোনের সাথে আলাপ করে দেখলাম তাদের মনোভাবও একই। যদিও আমরা তিন ভাই দুই বোন খুবই মিল। নিজে নিজকে প্রশ্ন করলাম, তিন ভাই এর মধ্যে বড় দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের প্রতি বাবা- মা,বোনেরা সন্তুষ্ট নয়। আমি যখন বিয়ে করব আমার স্ত্রীও যদি ভাবীদের মত হয় তবে দু:খের সীমা থাকবেনা তাদের। ছোট বোন কলি একদিন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমাকে বলল, ভাই, ভাবী দুই জন পেয়েছি আর দরকার নেই, এবার একজন বোন আনবেন যাতে আমরা এসে হাসি মুখে বাড়ি থেকে যেতে পারি।
আমি যা বুঝার তা বুঝলাম। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিলাম, কুমিল্লা গিয়ে গোলাপীকে বলব, গোলাপী আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকেই আমি বিয়ে করব। কারণ আমার বিশ্বাস, আমার পরিবার পরিজনের যে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারের ুদ্র চাহিদা তা একমাত্র তুমিই পারবে রাখতে। যে কথা সে কাজ। সম্ভবত ২০০০ সালের শেষ দিকের ঘটনা।
আমি বাড়ি থেকে এসে গোলাপীকে খবর দিয়ে কুমিল্লা চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেলাম। তাকে বিস্তারিত বললাম, কেন তাকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমার ধারণা ছিল সে আমাকে সাথে সাথে বলবে ঠিক আছে। কিন্তু না, সে আমার গোটা অস্তিত্বটাকে নাড়া দিয়ে বলল, তোমাকে আগামীকাল জানাব। আমি তার দিকে তাকালাম, বললাম ঠিক আছে।
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। ছটফট করলাম । পর দিন সকালে বাসায় এসে সে জানাল, আমাদের দেশে এমন অনেক দাম্পত্য জীবন আছে যাদের সংসার দশ বছর টিকেনি। আর শুধু বিশ্বাস আর নি:খাদ ভালবাসাকে অবলম্বন করে তোমার আমার বন্ধুত্ব আজ দশ বছরের বেশি। যেখানে নেই পাপ আর চাওয়া পাওয়ার হিসাব।
সুতরাং আমি রাজি।
শুরু হল আমাদের আরেক জীবন। কর্ম খুঁজছি আর লেখালেখি করছি। ২০০১ সালের ১৪ জানুয়ারি আমার বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে গোলাপী চলে যায় আমাদের বাড়িতে।
সেখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে সবাই তাকে দেখে। এক বছর পর সে জানাল পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। তাড়াতাড়ি কিছু একটা কর। আমার মাথা গরম। তখন দুই পেশা মিলিয়ে পাই মাত্র ২৬০০ টাকা বেতন।
আর সে শহরে কোচিং সেন্টারে টিচিং দিয়ে পায় ২৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া করে সংসার চলবে কি করে। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিবার জেনে গেল আমাদের সম্পর্ক। প্রথমে উভয় পরিবার থেকে আপত্তি এলেও এক পর্যায়ে গিয়ে আমাদের অসীম ভালবাসার কাছে সবাই হার মেনে বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করে। ২০০২ সালের ১০ মে শুক্রবার আমাদের ভালবাসা পরিণয়ে রূপ নেয়।
বিয়ের পূর্বে আমি একটি মেসে থাকতাম। আর গোলাপীরা তিন বোন একত্রে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতো। ১৬ মে বাড়ি থেকে সরাসরি আমি তাদের বাসায় উঠি। বাড়ি থেকে একই দিন ৫/৬ বছরের এক ভাতিজাকে নিয়ে আসি কুমিল্লায় রেখে পড়াবো বলে। গোলাপী, দুই শালিকা, ভাতিজাও আমি মিলে শুরু হয় আমার ৫ জনের সংসার।
মেস থেকে একটি প্লেট, একটি গ্লাস, সিঙ্গেল লেপ-তোষক ও একটি বালিশ নিয়ে আসি। আত্মীয় স্বজনসহ সকল পরিচিত মহল বলেছে প্রেমের বিয়ে আনন্দে শুরু- বিরহ দিয়ে শেষ হয়। সংসার সুখের হয় না। আরো হাজারো সমালোচনা ও জাতীয় উপদেশ আমাদের উভয়কে শুনতে হয়েছে। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই আমি পেয়ে যাই একটি জাতীয় দৈনিক ও আরেকটি স্থানীয় সাপ্তাহিকে চাকুরি।
২০০৫ সালের ৩ ডিসেম্বর আমাদের কোল জুড়ে আসে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। একই বছর গোলাপী পেয়ে যায় একটি সরকারি চাকুরি। ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট আল্লাহ পাক আমাদের দান করেন একটি কন্যা সন্তান। গোলাপীকে ভালবেসেছি ১৯৯২ সালে এবং বিয়ে করেছি ২০০২ সালে। পরিচয় থেকে পরিণয় এ পর্যন্ত গত হয়েছে ১৯ বছর।
আজ পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে নূন্যতম কোন মনের অমিল হয়নি। ভালবাসা হ্রাস পায়নি এতটুকু। মনে হচ্ছে প্রতিনিয়ত দু’জন দু’জনকে নতুন করে আবিষ্কার করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।