১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী আদিবাসী রাজাকারদের কথা আমাদের নতুন প্রজন্ম জানেই না। আর এই সুযোগে আদিবাসী রাজাকাররা বহাল তবিয়তেই আছে। দুঃখের হলেও সত্যি, রাজাকাররা এবং তাদের বংশধররা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘেও পৌঁছে গেছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমরা আদিবাসী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার করতে পারিনি কিন্তু তাদের পুরস্কৃত করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি করা কি অপমানের নয়?
ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয় এবং ১৮৮১ সালে সমগ্র জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন সার্কেলে তিন রাজা ছিল।
তাদের মধ্যে ছিল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, বোমাং রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী এবং মানিকছড়ির মং রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন)। মানিকছড়ির রাজা ছাড়া অন্য দুই রাজাই ছিল যুদ্ধাপরাধী।
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এই সময়ে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতেখারসহ ৮-১০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার বির্তকিত বই ঞযব Departed Melody -তে লেখে, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে সে (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোহাম্মদ হজরত আলী এবং আরও কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে।
পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরও কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবে। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারি-২০১১) পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে জামালউদ্দিন লেখেন, ...অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এই দলের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখার।
(পৃষ্ঠা নম্বর ৩৭৯-৩৮০)
এর আগে রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙামাটি আসেন। স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এসএম কালাম, আবদুল শুকুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, শামসুল হক মাস্টার এবং রাঙামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পিছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম শরবিন্দু শেখর চাকমা, (অঙ্কুর প্রকাশনী, জানুয়ারি-২০০৬ পৃষ্ঠা ২৫)।
ইফতেখার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা যেহেতু রাঙামাটি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই রাঙামাটি গিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখবেন এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবেন এমন ইচ্ছায় সে টগবগ করছিলেন তিনি। নিজের ছাত্র ইফতেখার সম্পর্কে আমার একাত্তর (সাহিত্য প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা নম্বর ৪৮) বইতে অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান লিখেছেন এই কথা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।