সাগর সরওয়ার
একদিনের ছুটিতে হঠাৎ করে চেপে বসলাম বাসে। রাতে। চট্টগ্রামের বাস ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। খবর এসেছে বান্দরবানে নাকি উতসব হচ্ছে। নবান্নের উতসব।
আহা এই চরম দু:সময়ে উতসব! আমি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসি। সেই কবে থেকে পাহাড়ের পথে হাটছি। এবার সাথে নিয়ে গেছি নতুন কেনা ল্যাপটপটি। পাহাড়ের সকাল একটু অন্যরকম। কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।
অদ্ভুত সব বুনো গাছের গন্ধ এসে লাগছে। আহা আমি তো এই গন্ধের জগতে থাকতে চাই সব সময়। জানি পার্বত্য এলাকায় মোবাইল টেলিফোন নেই। তাতে কি! প্রয়োজন মানে না কোন বাঁধা। লেখাটি সেখান থেকেই টেলিমডেম লাইনের মাধ্যমে পাঠাচ্ছি।
আমার সাথে পাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন আমাদের বান্দরবান সংবাদদাতা মিলন চক্রবর্তি। বান্দরবানের পাহাড়ে জুমের ফলন অন্যান্য বারের তুলনায় এবার কম। তারপরও পাশাপাশিভাবে বসবাসরত আদিবাসীরা স¤প্রদায় ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন রীতি-নীতিতে নবান্ন উৎসব পালন করে চলেছে। বান্দরবানে বসবাসরত মার্মা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরূং,খেয়াং, পাংখোয়া, লুসাই, বম, চাক, খুমি, ত্রিপুরাসহ ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠির অধিকাংশই জুম চাষের উপর তাদের সারা বছরের জীবীকা নির্বাহ করে।
আমরা হয়তো জানিই না যে, ম্রোদেরকে অন্যান্য আদিবাসীরা ডাকে থং ছা বলে (অর্থাৎ যারা পাহাড়ের সর্ব্বোচচ চুড়ায় বসবাস করে)।
এ স¤প্রদায় আদিকাল থেকেই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুমে ধানের সাথে আরো বিভিন্ন অর্থকরী ফসল চাষ করে যেমন ঃ তুলা, তিল,ভুট্টা, মার্ফা, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ ইত্যাদি। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম তৈরীর কাজ আরম্ভ করে, আগষ্ট মাসের শেষের দিক থেকে জুমের ধান কাটা আরম্ভ হয় নভেম্বরের প্রথম দিকে শেষ হয়। অন্যান্য ফসলাদি ক্রমান্বয়ে জানুয়ারীর শেষের দিক পর্যšত উঠানোর সময় থাকে। বর্তমানে জুমের ধান ঘরে তোলার কাজের জন্য আদিবাসীরা খুবই ব্য¯ত সময় কাটাচেছ।
জুমের ধান কাটার সময় তারা সংজ্ঞবদ্ধভাবে পাড়ার সকল শ্রেণীর নারী পুরষ মিলে একে অপরের জুমের ধান কাটার কাজে যায়। এই জুমের নতুন ধানের ভাত পাড়ার সকলে মিলে এক সাথে বসে মহা উৎসবের সাথে কলা পাতায় করে তাদের আদি রীতি নীতিতে খেয়ে তাকে। এটাই নবান্ন উৎসব নামে খ্যাত।
বম সমপ্রদায় এ উতসবকে তাদের ভাষায় থলাইথার (নবান্ন উতসব) নামে পালন করে থাকে। বছর শেষে জুম ক্ষেত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে যখন সোনালী ফসল ঘরে তোলে আনে তখন তারা আনন্দে মেতে উঠে।
এই উৎসবকে ঘিরে আয়োজন করে তারা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আনন্দ আর উচ্ছ্বলতায় মেতে উঠে পাড়াবাসীরা। খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী বম আদিবাসীরা পাড়ায় পাড়ায় আনন্দের পাশাপাশি প্রকৃতির ফসল ঘরে তোলার জন্য ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সম্মিলিতভাবে গীর্জায় প্রার্থনার মাধ্যমে আরম্ভ করে অনুষ্ঠানমালা।
জেলা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে পর্যটন এলাকা শৈল প্রপাত। এই ঝর্ণাকে ঘিরে বম আদিবাসী পল্লী লাইমী পাড়া, ফারুক মুন পাড়া।
শৈল প্রপাত পৌছার কিছু আগে রাস্তার ডান দিকে এঁকে বেঁকে ব্রিক সলিং করা সড়কটি লাইমী পাড়ায় প্রবেশ করেছে। পাড়ার কাছে যেতেই গীর্জাগুলো থেকে ভেসে আসছিল ঘন্টা ধ্বনি আর থেমে থেমে ভেসে আসছিল সুরেলা কন্ঠে বম ধর্মীয় গান। গানে ছিল ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণগানের কথা ও সুর। ও লাল পা না মালসম নাকসাং, কান জিংজং থুনা আলং। ঈশ্বরকে বমরা সম্বোধন করেন ‘লালপা’ হিসেবে।
বম সমাজে জনপ্রিয় এ ধর্মীয় গানের মর্মকথা হলো- প্রভু আপনার অবদান আমাদের উপর আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। পাড়ার পাকদির মেম্বার জানালেন, বম আদিবাসীদের ঐতিহ্যের আদি স্মরণী থাইথার। জুম ধান এবং অন্যান্য ফসলাদি ঘরে তোলার এই উতসব। প্রাচীন কাল থেকে তারা এ উৎসব পালন করে আসছে। একজন জুমিয়া জানালেন এবার ফলন খুব একটা বেশী ভাল না হলেও রীতি অনুযায়ী এই উতসব তারা পালন করে থাকে।
খ্রীষ্ট ধর্মাবলাম্বীদের রবিবার প্রার্থনার দিন। এ দিনে তারা সব কাজ বাদ দিয়ে এক সাথে মিলিত হয় গীর্জায়। থাইথারের সাথে রয়েছে ধর্মীয় যোগ। তাই নবান্ন উতসবের দিনটি তারা আনন্দ-উদ্দীপনার পাশাপাশি স্মরণ করে ঈশ্বরকে। থাইথারকে ঘিরে সকাল থেকে চলে গীর্জায় গীর্জায় প্রার্থর্না।
এরপর আসে কাঙ্খিত থাইথার বা নবান্ন উতসবের পর্ব। সুর্য উঠার আগেই আবারো সকলের গন্তব্য থাকে গীর্জা এবং চলে দুপুর পর্যন্ত প্রার্থনা। ৬৫ পরিবার অধ্যুষিত লাইমী পাড়ায় রয়েছে ৩ টি গীর্জা। পাড়ার আশপাশে ছায়া সুনিবিড় ও পরিপাটি ভাবে সাজানোটাই যেন পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের সুন্দর রুচির। এ পরিবেশ যে কারো মনোযোগ আকর্ষন করবে খুব সহজেই।
গীর্জার অভ্যন্তরে জুম েেত উৎপাদিত নবান্নসহ নানা সুমিষ্ট ফল প্লেটের মধ্যে রাখা হয়। নবান্নকে ঘিরে চলে পালকের দেশনা ও সমবেত প্রার্থনা। ধর্মীয় আয়োজন শেষে প্রথমে পালকের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন ফসল খাওয়া-দাওয়ার কাজ। এরপর দল বেঁধে আবালবৃদ্ধ বনিতা এ ঘর থেকে ও ঘরে গিয়ে মিলিত হয় নবান্নের উৎসবে। ঘরে ঘরে সাধ্যমত রান্না হয় নানা সুমিষ্ট খাদ্য।
তখন পাড়ার বড় একটি খোলা প্রান্তরে তরুন-তরুনীরা আয়োজন করে তাদের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক পরিবেশনার। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বম সাংস্কৃতিক গ্র“পের তরুনরা গয়ালের শিং বাজিয়ে নৃত্য, তরুনীরা ফাওয়ার ড্যান্স, বিয়ের নৃত্যসহ নানা ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও গান পরিবেশন করে।
নবান্ন উৎসব নিয়ে কথা হয় বম আদিবাসী নেতা জুমলিয়ান আমলাই এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বান্দরবান ইউনিটের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর জিরকুম সাহুর সাথে। জুমলিয়ান আমলাই জানান, প্রাচীন কাল থেকে বম আদিবাসীরা পালন করে আসছে থাইথার বা নবান্ন উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাশাপাশি বসবাসরত ১১টি আদিবাসীরাও যার যার ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে পালন করে এ নবান্ন উৎসব।
তিনি আরো জানান, বান্দরবানে বম অধ্যুষিত মোট ৫৪ টি পাড়ায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সাথে পালিত হয়েছে থাইথার। তিনি আরো জানান, অতীতের তুলনায় উৎসব আয়োজনের পরিসর বেড়েছে। আগে একেকটি পাড়ায় পরিবার সংখ্যা ছিল স্বল্প এবং দূর্গমতার কারণে আয়োজন থাকত সীমিত। ক্রমান্বয়ে থাইথার সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও আগে যেখানে একটি শুকর ৫ টাকায় পাওয়া যেত এখন তা দাড়িয়েছে ৫/৬ হাজার টাকায়। তবুও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে নবান্ন উৎসব বম আদিবাসীরা পালন করে আসছে।
পার্বত্য শাসনবিধি অনুযায়ী বান্দরবানে বোমাং রাজা জুম খাজনা আদায় করেন। বোমাং রাজার কার্যালয় জানায়, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১২ হাজার জুমিয়া পরিবার জুম চাষ করে আসছে।
সবুজ আর নীল পাহাড়ের মানুষ জানে কি করে আন্দন্দ করতে হয়। অনেক দু:খের মধ্যেও আমার এ আনন্দ ভালো লাগছে.........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।