অনুভুতিহীন জীবনের অপেক্ষায়... http://www.raatmojur.com/ আলতা সুন্দরী যখন পাড়ায় এসেছিলো, তখনকার দিন আজকের মতন না। তখন পাড়াতে মেয়ে আসতো তিন দিক থেকে। প্রাক্তন বেশ্যাদের কন্যা, গ্রামে কোনো দুর্ঘটনায় পঞ্চায়েতের রায়ে পতিতা খেতাব প্রাপ্ত অসহায় মেয়ে, অথবা দালালের হাতে পড়া কপালপোড়া কোনো মেয়ে। এদের সবাই আসলে একধরনের সামাজিক বর্বরাতা আর ঘৃনার স্বীকার হয়ে বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকে এই পেশায়।
তবে তার গর্ব, সে একদম ভিন্ন, ওদের থেকে একদমই ভিন্ন তার ইতিহাস।
তিনি যথেষ্ট শিক্ষিতা, অন্ততঃ ওদের তুলনায়। রুচিশীলাও। সবথেকে বড় কথা, তিনি খানদানি বংশের মেয়ে। এখানে আসা তার স্বেচ্ছায়।
আলতা বাবার আদরের মেয়ে ছিলেন, একমাত্র মেয়ে।
বাবা সবকাজেই আলতাকে সাথে রাখতেন, হোক সে বৈষয়িক অথবা গার্হস্থ। ছোটোবেলা থেকেই আলতাঅনেকবেশী জেদী আর দৃঢ়চিত্তের। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবার মতন মেয়ে।
সব সংসারেই কিছু না কিছু কালো থাকে। তার বাবার ছিলো প্রয়াত জমিদার দাদুর মতন মেয়ের শখ, মদের শখ।
তিনি নিয়মিত হাজিরা দিতেন শহরের সব থেকে জৌলুশময় বালাখানাতে। এই নিয়ে মায়ের আফসোস আর কষ্টের অন্ত ছিলো না। সারাদিনই কাঁদতেন, তার স্বামীকে কোন কোন রাক্ষুসী মায়া করে টেনে রাখে সেইসব নিয়ে।
আলতার তখন সদ্য কৈশোর। নিষিদ্ধ জ্ঞানের প্রতি ঝোক বাড়তি।
সেসময় এসব এত খোলামেলা আলোচনা হতো না। তবে হাতে পড়ে গেল গোলাম আব্বাসের "আনন্দী", পতিতারা কিভাবে এক শহর গড়ে তোলে আর একসময় সেই শহর থেকে তারাই আবার উচ্ছেদ হয়ে গড়ে তোলে আরেক প্রানপ্রাচুর্য্যে ভরা নগর সেই নিয়ে। কিশোরীর মনে দাগ কেটে বসে গল্পটা।
আশেপাশের তখন রেওয়াজ কুড়ির আগেই বিয়ে। তারপর পটাপট একের পর এক বাচ্চা, গিন্নিবান্নির মতন রান্নাঘরে কালিঝুলি মাখা, এসব ভালো লাগে নাআলতার।
তার মনে তখন ভাসতে থাকে সেই "আনন্দী"।
একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে, সন্ধের পরে মুখে আঁচল জড়িয়ে হাজির হয় পাড়াতে। তারপর সব ইতিহাস, এমন সুন্দরি আর কচি বয়েসের মেয়ে ছাড়তেচায়নি পাড়ার "মাসী" - সবার সর্দারনী। পড়তি যৌবনে যার আয়ের উৎস এমন মেয়েগুলিই। মেয়ের বাবাও টের পেয়েছেন, মাসীর ক্ষমতা, থানা পুলিশকরেও লাভ হয়নি।
আনা যায়নি মেয়েকে। আর মেয়েরো কোনো ইচ্ছে ছিলোনা ঘুঙুর আর মদিরার জৌলুশ, নিত্য নতুন রইস পুরুষের হাতছানি ঠেলে রান্নাঘরেএসে ঢুকতে। আর কুড়ি বছর আগের সমাজ! সে সমাজ তার ঘরে ফেরাটা মেনে নিতো, সে আশাও দুরাশাই।
আলতাকে আদর করে "আলতাসুন্দরী" ডাকেন রাতের অতিথিরা। নামটা শুনলে অদ্ভুত এক আনন্দে রক্ত ঝলকে ওঠে আলতার শরীরে।
এই বছর কুড়ি পরে, আলতার এখন সেই রমরমা আর নেই। পাড়াতে আগের মতন রইসেরা আর আসেন না যারা এক এক রাতের জন্য টাকার বান্ডিলে ভরেদিতো বিছানা। সারাজীবন নিজেই একা হয়ে থেকেছেন পাড়ার ভেতরে, রূপ, বংশ আর শিক্ষার গরবে, এখন আরো একা হয়ে পড়েছেন। কিছু জমাও রাখেননি। ভবিষ্যত ভেবে কুল পান না আলতা।
তবে এখনো না খেয়ে থাকার দিন আসেনি। কিছু খদ্দের আসে, ন্যালাখ্যাপা টাইপের, বাতি নিভোলে কুড়ি আর ষাট তাদের কাছে একই। তেমন কয়েকজন বাঁধা খদ্দের আছে, ওদের ভরসাতেই চলছে এখন।
ওদের একজন, আসাদ, বাইং না কি জানি ছাই কাজ করে। মাতাল হলে ছেলেটা টাকাও দেয় খারাপ না।
যদিও ছেলের বয়সী, তবে পতিতাদের ওসব ভাবনাথাকে না। এই ছেলেটা মাতাল হলে রাজ্যের গল্প করে, রাজনীতি, নারি অধিকার এসব নিয়ে লেখালেখিও নাকি করে। শুনে মনে হয় ভালোই লেখে। নিজেরপুরোনো কথা মনে চড়ে যায় আলতার। সে নিজেও তো দারুন লিখতো।
স্কুলে মাস্টারবাবু খুব প্রশংসা করতেন। তখনই বুদ্ধি খেলে যায় তার মাথায়।
লেখা শুরু করেন আলতাসুন্দরী। বাইং এর ছেলেটা, আসাদ, প্রকাশের ব্যাবস্থা করে দেয় লেখা। দুজনে মিলেই প্লট ঠিক করা।
সমাজের আর সমাজপতিদের হাতে পতিতা হতে বাধ্য হওয়া এক অসহায় নারীর কথা, যিনি জীবনের কুড়িটি বছর দুঃসহ যন্ত্রনা ভোগ করে বেঁচে আছেন শহরের কোনের "পাড়ায়"। প্রতিটি রাত ধর্ষিতা হতে তার কেমন অমানবিক লাগতো এই গল্প এখন শুধু দু'টাকা দামী সস্তা পত্রিকাটিতেই নয়, মুখোরোচক গল্প হিসেবে মানুষের মুখেও ফেরে। নির্যাতিতা এই মহামানবীকে আবিষ্কারের কারনে, তাকে সমাজের উপরেরতলায় তুলে আনবার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে আসাদ মোটামুটি খ্যাতির শীর্ষে উঠতে থাকেন তরতর করে। মানবাধিকার পুরষ্কার এবারে বোধ হয় পাকা। আর আলতা স্বপ্ন দেখেন নারী কল্যানের টাকার কল্যানে বাকী জীবনটা স্বচ্ছন্দে পার করবার।
আলতাসুন্দরী লিখে যান সত্য মিথ্যে মিশিয়ে, আসাদ তাতে প্রুফ করে দেন। সিরিজ চলতে থাকে। কুড়ি বছরের কথা, সিরিজ আর কিছু না হোক, বছরখানেক তো চলবেই। সত্যতা যাচাই করার কেউ নেই যে! আর তার আত্মীয় দাবী করে তালে নাচা জনরোষের মুখে পড়বেন এখন?
জনতার চোখে পানি ঝরে আলতাসুন্দরীর লেখা কষ্ট আর বেদনা কল্পনা করে।
তাদের ইমোশনের জোয়ার ভাটা ঘটাতে গর্জাতে থাকে আলতাসুন্দরীর কলম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।