আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মকবুল ফিদা হোসেন: সৌন্দর্য্যের পূজারী এক চিরনবীন

বুকের ভেতর বহু দূরের পথ... চলে গেলেন ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী মকুবল ফিদা হোসেন। গত ৯ জুন লন্ডনের রয়েল ব্রমটন হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৬ বছর। তাঁর জন্ম ১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মহারাষ্ট্রে। প্রায় শতায়ু হলেও আজীবন মনে-প্রাণে ছিলেন চিরনবীন।

রাস্তা, স্টুডিও, বাসা যেখানেই হোক না কেন মেতে উঠতে পারতেন রং-তুলির খেলায়। অসাধারন সব শিল্পকর্ম দিয়ে তিনি নাম কুড়িয়েছিলেন দেশ-বিদেশে। ভূষিত হয়েছেন ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৫৫), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৭৩) আর ‘পদ্মবিভূষণ’(১৯৯১) সম্মাননায়। ১৯৯৬ সালে মনোনীত হয়েছিলেন ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা সদস্য হিসেবে। বিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী তাঁকে অভিহিত করেছে ‘ভারতের পিকাসো’ হিসেবে।

কিন্তু সারাজীবনই বিতর্ক ছিলো তাঁর সঙ্গী। হিন্দু দেব-দেবীদের নগ্ন ছবি আঁকায় ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের রোষানলে পড়েছিলেন। ২০০৬ সালে তাঁর আঁকা ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (ভারতমাতা) ছবিটি আগুনে আরো ঘি ঢেলে দেয়। পুরো দেশের মানচিত্রের উপর তিনি আঁকেন নগ্ন এক নারীর চিত্র। আর শরীরের বিভিন্ন অংশে বসিয়ে দেন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নাম।

তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। আদালত তাঁকে সাধারন মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় । জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। ফলশ্রুতিতে দেশ ছাড়েন তিনি।

২০১০ সালে গ্রহণ করেন কাতারের নাগরিকত্ব। জীবনের শেষ সময়টুকু নির্বাসনে লন্ডন আর কাতারে কাটালেও নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আকুলতা তাঁর মধ্যে ছিলো প্রবল। আগাগোড়া এ চিত্রশিল্পী চলচ্চিত্র নির্মাণেও আগ্রহী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি তৈরি করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘ থ্রো দ্য আইজ অব এ পেইন্টার’। সংলাপবিহীন মাত্র ১৫ মিনিটের এ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিলো ভারতের রাজস্থানের ধারাবাহিক কিছু ছবি নিয়ে।

চলচ্চিত্রটি সে বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা পুরস্কার ‘স্বর্ণভল্লুক’ জিতে নেয়। এরপর ৩৩ বছর তিনি চলচ্চিত্র নির্র্মাণে হাত দেননি। তিনি ছিলেন বলিউডের চিত্রনায়িকা মাধুরী দীক্ষিতের রূপমুগ্ধ। মাধুরীকে মডেল করে তিনি এঁকেছিলেন অনেক ছবি। মাধুরীকে নিয়েই বানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গজগামিনী’(২০০০)।

এ ছবিতে তিনি নারী, কবিতা, সংগীত আর নৃত্যকলাকে সমন্বয় করেছেন পটে আঁকা ছবির মত। ছবির নৃত্যপরিচালক সরোজ খানকে তিনি বলেছিলেন ‘আমার চলচ্চিত্রটি হবে পেইন্টংয়ের মত। নাচ-গান সংলাপ অভিনয় সব কিছুতেই ছোঁয়া থাকবে রঙ-তুলির। ’ আরেক প্রিয় নায়িকা টাবুকে নিয়ে নির্মান করেছেন ‘মীনাক্ষী: টেল অব থ্রি সিটিজ’(২০০৪)। তাঁর প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে ছিলো নারী আর পেইন্টিং।

ছবিতে নানা রঙের ব্যবহারে মতই তাঁর চলচ্চিত্রের নারী চরিত্রগুলো ধরা দিত এক সঙ্গে অনেকগুলো রূপে। গজগামিনীতে মাধুরীকে কখনও দেখা গেছে সাম্য আর স্থিতিশীলতার প্রতীক নূরবিবির চরিত্রে। কখনও শকুন্তলা চরিত্রে যে রাজকন্যার জন্ম কালিদাসের কাব্যে, মনিকা নামের নৌকাচালকের ভূমিকায় যে খুঁজে ফিরছে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে; ফুলবিক্রেতা অশ্রুসজল মেয়েটির নাম ফুলবানিয়া যার স্বামী খুনের দায়ে অভিযুক্ত। কখনও বা সে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা। ’ মকবুল ফিদা হোসেন এভাবেই নারীর নানাবিধ রূপ খুঁজেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে।

ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ মকবুল ফিদা হোসেন সম্পর্কে বলেছেন, ‘ভারতে আমরা চলচ্চিত্র বানাতে ও দেখতে শিখেছি গল্প বলার ঢঙে। কিন্তু মকবুল ফিদা হোসেন আমাদের শেখালেন চলচ্চিত্রকে কীভাবে পটে আঁকা ছবি মত করে উপলব্ধি করতে হয়। গজগামিনী আর মীনাক্ষী দেখার পর চলচ্চিত্রে ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিয়েন্সের গুরুত্বটা দারুনভাবে টের পাওয়া গেলো। ’ মকবুল ফিদা হোসেনের কোন ছবিই বক্স অফিসে সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু শিল্প আর সৌন্দর্য্যরে প্রতি প্রেম যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে ঠুনকো ব্যবসায়িক চিন্তা তাঁকে হতাশাগ্রস্থ করতে পারেনা।

মীনাক্ষী আর গজগামিনীর পর চলচ্চিত্র না বানালেও ছেলের মুক্তি প্রতীক্ষিত প্রথম ছবি ‘পেহলা সিতারা’-তে সংলাপ লিখেছেন তিনি। এ বছরই তিনি শুরু করতে চেয়েছিলেন তাঁর নতুন চলচ্চিত্রের কাজ। কিন্ত তার আগেই হারিয়ে গেলেন না ফেরার দেশে। এ মহান শিল্পীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। # (তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা) (১৬ জুন ২০১১ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত) ***চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট***  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.