আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐতিহাসিক চাঁদ সওদাগর দীঘি প্রতিদিন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে যায়

কালের নীরব সাক্ষী চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলি নদীর মোহনার ওপারে চাঁদ সওদাগর দীঘি অবস্থিত। যেটি প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটকদেরকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। নীরবে নিভৃতে। যার সাথে জড়িয়ে আছে অমূল্য ইতিহাসের সোনালী উপাদান। কথিত আছে কর্ণফুলী থানাধীন চম্পক নগরে কোটিশ্বর নামে এক রাজা বাস করতেন।

তাঁর পুঁজায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবতা তাঁকে এক পুত্র বর দেন। পুত্রের নাম ছিল চন্দ্রধর। একান্ত শখের বশে চন্দ্রধর ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। মধুকর, শঙ্খচূড়া, রত্মাবতি, দুর্গাবর, খরষাং, পাঠানপাগল, গুঞ্জাছড়ি, উদয়তারা, কোড়ামোড়া, কাজলরেখা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে চৌদ্দটি বৃহদাকার নৌকায় নানা প্রকার মালামাল বোঝাই করে তিনি বহু রাজ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ছুঠে বেড়াতেন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি চাঁদ সওদাগর নামে পরিচিত হয়ে উঠেন।

তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণকামী ও পরহিতৈষী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে জনকল্যাণ ও বাণিজ্য তরীতে সুপেয় জল সরবরাহের জন্য এ দীঘি খনন করেছিলেন। তারই নামে এ দীঘির নামকরণ করা হয় চাঁদ সওদাগর দীঘি। দীঘিকে ঘিরে বহু কিংবদন্তী ও লোক কাহিনী প্রচারিত আছে (সূত্র- মনসা পুথি)। এটির আয়তন ১ একরের অধিক।

পশ্চিমে পতিত জমি ও মেরিন একাডেমী’র প্রবেশ সড়ক, দক্ষিণে জনবসতি, পূর্বে দেয়াং পাহাড় ও উত্তরে মেরিন একাডেমী’র সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন পূর্ব পশ্চিম লম্বালম্বি কাঁচা রাস্তা। যেটি কেইপিজেড অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত। দীঘির উত্তর পাড়ের পূর্ব কোণায় একটি টংঘর রয়েছে। যাতে মনসা পুথির উল্লেখিত বিবরণ সাঁটানো আছে। দীঘিটি কোরিয়ান ইপিজেড’র অধিকারে।

এখানে পিকনিক কিংবা বেড়াতে আসলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। প্রবেশ মুখে কেইপিজেড’র মালিকানাধীন একটি জেটি রয়েছে। জেটি হতে শুরু হওয়া দীঘি প্রবেশ রাস্তা মুখে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি আপনার চোখে পড়বে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি ফলকটি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাটিতে গ্রোথিত করেছেন। ভ্রমণ পিয়াসী পর্যটকরা এখানে এসে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি পড়ে পুনরায় ফিরে যান।

এ সাইনবোর্ড হতে দীঘির দূরত্ব শতাধিক গজের মধ্যে হবে বলে অনুমান করা হয়। চলন্ত বাসে যেমন লেখা থাকে ‘কোন অভিযোগ থাকলে চালককে জানান, চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ’। এখানেও একই অবস্থা। একদিকে দীঘি দেখার পিপাসা। অন্যদিকে না যাওয়ার সতর্কবাণী।

আপনি দীঘি দেখতে আসতে মেরিন একাডেমী ঘাট অথবা ফিরিঙি বাজার ঘাট নতুবা চাতুরী চৌমুহনী হয়ে সেন্টারে নেমে এ সাইনবোর্ড পর্যন্ত আসতে পারেন। প্রবেশ মুখের দক্ষিণ পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, মেরিন একাডেমীর প্রাচীর ঘেঁষা খাড়ির নাম না জানা অসংখ্য বনফুল ও রাস্তার দু’পাশের আকন্দ, এরেন্ডা, চৈতগাড়া, কেয়াসহ বিভিন্ন নাম না জানা উদ্ভিদ ও ফুলের সমারোহ আপনাকে অন্য এক রাজ্যে নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছু দূর অগ্রসর হলেই দীঘি সন্নিহিত ভাঙ্গা কালভার্ট ও রাস্তার জনদুর্ভোগ দুর্গতি নিয়ে লোকজনের চলাচলের দৃশ্য দেখে আপনার রোমান্টিক মনের ভাবনা মূহুর্তে উঁবে যাবে। পুকুরে দেখবেন স্থানীয় নরনারীর স্নান কিংবা পানি নেয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। পুকুরে কোন ঘাটের অস্থিত্ব নেই।

পর্যটকদের প্রতি কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের প্রহরীরা সদা সতর্ক অবস্থায় থাকেন। অপরিচিত লোক দেখলেই নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। ক্যামরা থাকলে তো কথাই নাই। ছবি তুলতে গেলে ক্যামরা ভেঙ্গে ফেলা কিংবা কেড়ে নেয়ার এন্তার নজির রয়েছে। এলাকার লোকজন জানান, ২৬০০ একর পাহাড়ী ভূমি নিয়ে কেইপিজেড প্রতিষ্ঠিত।

দীঘি সংলগ্ন মাঠে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জনসভা করে এটি উদ্বোধন করে ছিলেন। নামফলক ছিল। কে বা কারা এটি অপসারণ করায় সন তারিখ জানা যায়নি। এলাকাবাসীরা আরো জানালেন, এটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে এ প্রতিবেদক কেইপিজেড অভ্যন্তরে যেখানে পাহাড় কেটে স্যু ফ্যাক্টরী নির্মিত হচ্ছে তার পূর্ব দিকে একটি উদ্বোধনী নামফলক প্রত্যক্ষ করেছেন।

এতে ১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন বলে উৎকীর্ণ রয়েছে। দেয়াং পাহাড়টি ইতিহাস সমৃদ্ধ। প্রাগৈতিহাসিক বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী। কালের প্রবাহে মানব সভ্যতার বিকাশ ও মানবিক প্রয়োজনে বহু পাহাড়ের রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে।

ধবংস যজ্ঞ দেখতে উম্মোচিত নামফলকের চতুর্দিকে দৃষ্টি দিলেই সত্যতা মিলবে। একদিন এখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সেদিন কোন এক বৃদ্ধ তার সন্তানকে বলবে এখানে পাহাড় ছিল। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ছিল। পরিবেশবাদীরা রহস্যজনকভাবে পাহাড় কেটে প্লট বানানোর বিষয়ে নীরবতা পালন করছেন বলে এলাকাবাসীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

আবার এও বললেন, যেখানে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও দেশের ভাগ্যোন্নয়ন নিহিত সেখানে দেয়াং পাহাড় তো নস্যি। তবে চাঁদ সওদাগরের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তারা জানালেন, চাঁদ সওদাগরের বাড়ি আনোয়ারা থানার বটতলী ইউনিয়নে অবস্থিত। এখানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশন রয়েছে। দীঘির লাগোয়া জমি ও জমির পশ্চিম পার্শ্বে কর্ণফুলী নদীর তীর চাঁদ সওদাগরের স্মৃতিধন্য। নদী তীরে তাঁর বজরার জেটি ছিল।

দেয়াং পাহাড়ে চাটিগাঁ দুর্গ ও দেয়াং কারাগারের নিদর্শন রয়েছে। ঐতিহাসিক চাঁনখালী নদী ও শঙ্খনদীর মোহনায় অবস্থিত চাঁনপুর ঘাট তাঁরই নামে বলে এলাকাবাসীরা দাবী করলেন। এক কালে দেয়াং পাহাড়ের পাদদেশে বড় বড় বাণিজ্য তরী কর্ণফুলীতে নোঙ্গর করতো। চাঁদ সওদাগরও সপ্ত ডিঙ্গা নিয়ে এখান থেকে সমুদ্র যাত্রা করতেন। এ দীঘির জনগনের খাবার পানির প্রয়োজন মিটিয়ে ডিঙ্গাতে পানি সরবরাহের অন্যতম উৎস ছিল।

এসব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কেইপিজেড’র বিস্তার ঘটলে দীঘি ও সন্নিহিত এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। তখন হয়তো দীঘির অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। চাঁদ সওদাগরের নামও কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। এলাকার সচেতন মহল ও ইতিহাস প্রেমিরা অভিমত রেখেছেন ঐতিহাসিক এ সব নিদর্শন যেমন দেয়াং কারাগার, চাটিগাঁ দুর্গ ও চাঁদ সওদাগর দীঘি কেইপিজেড’র আওতার বাইরে রাখা অতীব জরুরী।

জেটিটি চাঁদ সওদাগরের নামে নামকরণ করারও দাবী জানানো হয়েছে। তাঁদের মতে এতে করে ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হবে। চাঁদ সওদাগরের স্মৃতি বিজড়িত দীঘি লাগোয়া জমিতে পর্যটন মোটেল করা যায়। সম্প্রতি এ স্থান হতে সামান্য দূরে সমুদ্র সৈকত পারকিতে সরকার পর্যটন উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে এসব নিদর্শনকে এ পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করা দরকার।

চাঁদ সওদাগর কথা বাদ দিলেও ১৬৬৬ হতে ১৭৬০ পর্যন্ত মোঘল শাসন, পরবর্তীতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ইতিহাসের বহু স্মারক, তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। সৃজন ও সমীক্ষার ক্ষেত্রে মানুষ পূর্ব পুরুষদের পদচিহ্নকে সন্ধান করেছেন। ইতিহাসের প্রয়োজনে অতীতকে খুঁজে বেড়ানো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। অতীতের সব কিছু মানুষ গ্রহণ করতে না পারলেও নতুনের পথে অগ্রযাত্রায় শক্তি জোগায় সোনালী অতীত। সময় সব কিছুকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পালালেও অতীতকে মুছে দিতে পারে না।

নিজের অজান্তে মানুষ কিছু না কিছু চিহ্ন রেখে যায়। চাঁদ সওদাগরও আজ অতীত। কিন্তু তাঁর অমর কীর্তি দীঘি রয়েছে। পুঁথি সাহিত্যে তিনি দেদীপ্যমান। এসব চিহ্ন যথাযথ সংরক্ষণ করলে জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে।

এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.