আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাদীর একটি ঐতিহাসিক স্থান ও একটি ঐতিহাসিক ঈদ দিবস



বিদায় হজ্জের একটি বিবরণঃ হিজরী দশম বছর, সমস্ত জাজিরাতুল আরবে (আরব ভূ-খণ্ডে) ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। আরবের সকল গোত্রই মুসলিম আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রাসূলের (সাঃ) রেসালাতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। মূর্তি ও মূর্তিপূজার কোন চিহ্নই তাদের কোন গোত্রের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না। রেসালাতের কর্ণধারের পরিশ্রম আজ ফলদায়ক হয়েছে এবং তার সুস্বাদু ফলকে উৎপাদনশীল করেছে। এলাহীর সিংহাসন থেকে মূর্তিগুলোর পতন ঘটেছে ও পবিত্র বাণী "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" বিস্তৃত জাজিরাতুল আরবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

মানুষের মধ্যে এখন পার্থক্য শুধুমাত্র অন্তরে পুষে রাখা ঈমানের ও ইসলাম পূর্ববর্তী অবস্থার। রাসূল (সাঃ) -যিনি প্রায় ২৩টি (তেইশটি) বছর ধরে প্রচণ্ড জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন ও এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এক মূহুর্তের জন্যেও তাঁর কর্তব্য ও রেসালাতের প্রচার কার্যে অবহেলা করেন নি- তিনি কখনোই দূর্বলতা অনূভব করেন নি, এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, অতিশীঘ্রই এই দুনিয়াকে বিদায় জানাতে হবে এবং মহান প্রভূর সাথে সাক্ষাত করতে হবে। তাই পূর্বের মতই নিরলশ চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মত দীপ্তিমান হয় ও ইসলামী আইন-কানুন শিক্ষা লাভ করে। অতিসামান্যই ইসলামী বিধি-বিধান অবশিষ্ট আছে যা এখনও প্রচারের ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত সময় আসেনি। ফরজ হজ্জ হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি তখনও সুযোগ পান নি যে, মুসলমানদেরকে হজ্জের নামাজ শিক্ষা দিবেন। তাই এখনই একমাত্র ও শেষ সময়। সাধারণ ঘোষণা করা হল যে, রাসূল (সাঃ) হজ্জ করতে যাবেন। গোত্রের জনগণ সব মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং তিনি (সাঃ) জিলক্বদ মাসের ৬ দিন (ছয় দিন) অবশিষ্ট থাকতে শনিবারে আবু দুজানাকে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলেন, সেটাও ঐ অবস্থায় যখন তাঁর সমস্ত স্ত্রীগণ ও পরিবারবর্গকে যাত্রা সঙ্গী করেছিলেন এবং একশ'টি উট কোরবানীর জন্য সাথে নিয়ে মদীনা হতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ঐ সময় মদীনায় মহামারী রোগের প্রাদুরভাব দেখা দিয়েছিল।

যারফলে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই আড়ম্বরপূর্ণ বরকতময় সফর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তারপরেও হাজার হাজার লোক রাসূলের (সাঃ) সহযাত্রী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাঁর সহযাত্রীর সংখ্যা চল্লিশ হাজার, সত্তর হাজার, নব্বই হাজার, একলক্ষ চৌদ্দ হাজার, একলক্ষ বিশ হাজার, একলক্ষ চব্বিশ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি আরো বলা যেতে পারে যে, আসলে এত পরিমাণ জনগণ তাঁর সহযাত্রী হয়েছিলেন যে, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত কারো সাধ্য ছিল না। তাও আবার তাঁরা শুধু ঐ সকল ব্যক্তিই ছিলেন যারা মদীনা হতে এসেছিলেন।

আর হাজীদের সংখ্যা এতটুকুতেই সীমিত ছিল না। কেননা, মক্কার ও তার আশেপাশের অধিবাসীগণ এবং যারা ইয়েমেন থেকে আমিরুল মোমিনীন আলীর (আঃ) সাথে এসেছেন তারাও উক্ত হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি (সাঃ) গোসল করলেন ও পবিত্র দেহ মোবারকে তেল মালিশ করলেন, সুগন্ধি লাগালেন এবং চুলগুলোকে চিরুণী দিয়ে আঁচড়ে পরিপাটি করলেন। অতঃপর মদীনা হতে বের হলেন। মদীনা হতে বের হওয়ার সময় তাঁর শরীরে মাত্র দু'টি কাপড় ছিল যার একটি ছিল ঘাড়ে রাখা আর অপর ছিল কোমড়ে বাঁধা।

একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, যখন "জিল হোলায়ফা"তে পেঁৗছলেন তখন ইহরাম বাঁধলেন। অতঃপর আবারও পূর্বের ন্যায় পথ চলতে শুরু করলেন এবং জিল হিজ্জ মাসের চার তারিখ মঙ্গলবারে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বনী শাইবার ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে ঢুকলেন, তাওয়াফ করলেন, তাওয়াফের নামাজ পড়লেন, সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করলেন এবং নিয়মানুযায়ী ওমরার কর্মাদি সম্পাদন করলেন। যারা নিজেদের সাথে কোরবানীর পশু নিয়ে আসেন নি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন- তারা যেন মাথা মুঁড়ন করে ইহরাম খুলে ফেলে। তিনি (সাঃ) যেহেতু কোরবানীর পশু নিয়ে এসেছিলেন তাই ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন যতক্ষন পর্যন্ত না মীনাতে কোরবানী করেন।

আমিরুল মোমিনীন আলী (আঃ) যেহেতু রাসূলের (সাঃ) হজ্জে যাওয়ার কথা ইতিপূর্বেই অবগত হয়েছিলেন তাই তিনিও ইয়েমেন থেকে ৩৭টি (সাইত্রিশটি) কোরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছিলেন ও ইয়েমেনের অধিবাসীদের মিকাতে ঐ একই নিয়্যতেই, যে নিয়্যতে রাসূল (সাঃ) ইহরাম বেঁধেছিলেন, ইহরাম বাঁধলেন এবং রাসূলের (সাঃ) ন্যায় সাফা ও মারওয়া সাঈ করার পর ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন। রাসূল (সাঃ) জিল হিজ্জ মাসের ৮ম (অষ্টম) দিনে মীনা হয়ে আরাফার ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন যাতে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শুরু করতে পারেন। ৯ম (নবম) দিনের সূর্যোদ্বয় পর্যন্ত মীনাতেই ছিলেন। অতঃপর আরাফায় পৌঁছে স্বীয় তাঁবুতে অবস্থান নিলেন। আরাফায় মুসলমানদের আড়ম্বরপূর্ণ সমষ্টির মধ্যে প্রাঞ্জল ভাষায় খুতবা পাঠ করলেন।

তাঁর এই খুতবাতে মুসলমানদেরকে ভ্রাতৃত্বের প্রতি ও পরস্পরের প্রতি সম্মানের কথা তুলে ধরলেন; ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগের সমস্ত আইন-কানুনকে বাতিল ঘোষণা করলেন এবং স্বীয় রেসালাতের সমাপ্তির কথাও ব্যক্ত করলেন। ৯ম (নবম) দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। যখন সূর্য অস্তমিত হল ও অন্ধকার নেমে আসল তখন "মুজদালাফা"র উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি সেখানেই রাত্রি যাপন করার পর দশম দিনের প্রত্যুশে মীনার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মীনার নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে হজ্জ শেষ করলেন এবং এভাবেই হজ্জের বিধি-নিষেধগুলি মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিলেন।

এই হজ্জকে হুজ্জাতুল বিদা, হুজ্জাতুল ইসলাম, হুজ্জাতুল বালাগ, হুজ্জাতুল কামাল ও হুজ্জাতুত্ তামাম বলা হয়ে থাকে। হজ্জের অনুষ্ঠান সমাপনীর পর তিনি মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন। যখন "রাবেগ" নামক স্থানে পৌঁছলেন, যে স্থানটিকে গাদীরে খুম বলা হত। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) অবতীর্ণ হলেন এবং তাঁর নিকট ঐশীবাণী এভাবে পাঠ করলেন- "হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর বাণী কিছুই পৌঁছালেন না।

আল্লাহ আপনাকে মানুষের শত্রুতার হাত থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। আল্লাহর এই বাণী এমন এক নির্দেশ যা রাসূলের (সাঃ) উপর গুরুদায়িত্ব হিসেবে অর্পন করা হয়েছে; এমনই এক ঘোষণা যে, কেউ যেন এ সম্পর্কে অনবগত না থাকে, আর যদি এমনটা না করেন তাহলে এমন মনে হবে যে, তিনি একেবারেই দ্বীনের কোন কাজই সম্পাদন করেননি। সুতরাং এই বাণী প্রচারের জন্য উক্ত স্থানই ও উক্ত সময়ই সর্বোত্তম; যেখানে মিশর, ইরাক, মদীনা ও অন্যান্য সকল স্থানের অধিবাসীদের পরস্পরের পথ আলাদা হওয়ার স্থান। আর সকল হাজীগণ অনন্যোপায় হয়ে এই পথই পাড়ি দিয়ে থাকেন।

গাদীরের খুম নামক স্থানটিই একমাত্র স্থান ছিল যেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীটি সমস্ত হাজীদের কর্ণকোহরে পৌঁছানো সম্ভবপর। তাই স্বস্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হল। তিনি বললেন অগ্রগামীদের ফিরে আসতে বল আর পশ্চাৎপদদের জন্য প্রতীক্ষা কর। হেজাজের উত্তপ্ত মরুতে জনগণের ঘটেছিল এক মহা সমাবেশ। দিনটিতে ছিল প্রচণ্ড গরম ও এলাকাটির তাপমাত্রাও ছিল অত্যন্ত বেশী; এত গরম ছিল যে, সেখানকার পুরুষরা তাদের স্বীয় আলখেল্লার অর্ধাংশ দিয়েছিলেন মাথায় আর অর্ধাংশ দিয়েছিলেন পায়ের নীচে।

সকলের মনে একই প্রশ্ন যে, কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এরকম প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বা বাহ্যিক দিক থেকে অনুপোযুক্ত জায়গায় রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে স্বস্থানে অবস্থানের নির্দেশ দিলেন? তাপামাত্রা এত উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল যে, হাজীদেরকে অস্থির করে ফেলছিল। তিনি নির্দেশ দিলেন- যেন বয়োবৃদ্ধদেরকে বৃক্ষতলে নিয়ে যাওয়া হয় আর উটের পালান (জিন) গুলোকে যেন একটার উপর অপরটা রেখে মঞ্চ বানানো হয়। সুউচ্চ মঞ্চ তৈরী করা হল। প্রায় দুপুরের সময়, যখন সকল হাজীগণ ঐ মরুভূমিতে একত্রিত হয়েছিল, তিনি মঞ্চে আরোহন করলেন এবং এভাবে একটি বক্তব্য প্রদান করলেনঃ- " সকল প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য। আমরা তাঁর প্রতিই ভরসা করি এবং নাফ্সের তাড়না ও অসৎ আচরণের জন্য চাই তাঁর নিকট আশ্রয়; তিনি সেই প্রভূ যে, ঐ ব্যাক্তির কোন পথপ্রদর্শক নেই যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেছেন আর তার কোন পথভ্রষ্টকারী নেই যাকে তিনি পথ প্রদর্শন করে থাকেন।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ব্যতিত কোন প্রভূ নেই ও মোহাম্মদ তাঁরই প্রেরিত বান্দা" অতঃপরঃ "হে উপস্থিত জনতা; সর্বোজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা আমাকে অবগত করেছেন যে, কোন নবীই তার পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেকের বেশী বয়স ধরে জীবন যাপন করে নাই এবং বেশী দেরী নেই যে আমাকেও উক্ত চিরস্থায়ী আবাসে আহ্বান করা হবে, আর আমিও তার আহ্বানে সাড়া দিব। এটা বাস্তব যে, আমাকে ও আপনাদের সবাইকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। অতঃপর আপনারা কি জবাব দিবেন?" সকলেই বললেনঃ- আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের নিকট পৌঁছিয়েছেন ও উপদেশ দান করেছেন এবং চেষ্টা-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোন অলসতা করেননি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন। তিনি বললেনঃ- "আপনারা কি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, এক আল্লাহ ব্যতিত কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ তাঁর প্রেরিত বান্দা, তাঁর বেহেশ্ত, দোযখ ও মৃত্যু সত্য এবং নিঃসন্দেহে পুনরুত্থান সংঘটিত হবে ও আল্লাহ তায়ালা সকল মৃত ব্যক্তিদের জীবিত করবেন?" সবাই বললেনঃ হ্যাঁ, আমরা এ সকল বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি ।

তিনি বললেনঃ "হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক"। অতঃপর বললেনঃ "হে লোক সকল! আমার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন"? তারা বললেনঃ- হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ- "আমি আপনাদের পূর্বেই হাউজে কাউসারে উপস্থিত হব আর আপনারা হাউজের পার্শ্বে আমার নিকট উপস্থিত হবেন; ঐ হাউজটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে সানআ' হতে বুসরা'র দৈর্ঘ্যের সমান এবং তার পানপাত্রগুলি প্রত্যেকটি একটি রোপ্য নক্ষত্রের সমান। এখন দেখতে চাই যে, আমার পরে আপনারা আমার এই দু'টি মহামূল্যবান বস্তুর সাথে কেমন আচরণ করেন"। উপস্থিত জনগণের মধ্য হতে একজন বলে উঠলেন- হে আল্লাহর রাসূল! ঐ দু'টি মহামূল্যবান বস্তু কি?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.