আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাদীর একটি ঐতিহাসিক স্থান ও একটি ঐতিহাসিক ঈদ দিবস-৩



তিনি বললেনঃ "ঐ দু'টি বস্তুর মধ্যে হচ্ছে- একটি সবচেয়ে বড় যা আল্লাহর কিতাব (কোরআন)। যার এক পক্ষ আল্লাহর হাতে এবং অপর পক্ষটি আপনাদের হাতে; তাই উহাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবেন যাতে পথভ্রষ্ট না হন। আর অপরটি হচ্ছে- তার চেয়ে ছোট, আর তা হচ্ছে- ইতরাত বা আমার পরিবারবর্গ। মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তায়ালা আমাকে জানিয়েছেন যে, এ দু'টি বস্তু কিয়ামতের দিনে হাউজে কাউসারে আমার নিকট না পৌঁছা পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। আর আমিও আল্লাহর নিকট ইহাই কামনা করেছিলাম।

সুতরাং আপনারা তাদের অগ্রবর্তী হবেন না, হলে ধ্বংস হয়ে যাবেন এবং অনুগামীও হবেন না, তাহলেও ধ্বংস হয়ে যাবেন"। অতঃপর আলীর হাত ধরে উঁচু করলেন। আর এমনভাবে উঁচু করলেন যে, তাঁদের দু'জনেরই বগলের শুভ্রতা দেখা যাচ্ছিলো এবং সেখানকার সকলেই আলীকে চিনতে পারলো। তখন তিনি বললেনঃ "হে লোক সকল! মোমিনদের মধ্যে এমন কোন্ ব্যক্তি আছে যে সর্বোত্তম?" সবাই বললোঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ "আল্লাহ আমার মাওলা (মাওলা শব্দের অর্থ অভিভাবক যার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে) ও প্রতিপালক, আমি মোমিনদের মাওলা ও প্রতিপালনকারী।

আর আমি মোমিনদের মধ্যে তাদের চেয়ে যোগ্যতম ও সর্বোত্তম ব্যক্তি। তাই আমি যাদের যাদের মাওলা ও লালন-পালনকারী এই আলীও তাদের তাদের মাওলা ও লালন-পালনকারী"। এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। অতঃপর বললেনঃ- "হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণকর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে; তুমি সহযোগীতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগীতা করে, তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে একা রাখে এবং সত্যকে আলীর সাথে রাখ তা যে দিকেই থাক না কেন"। হে লোকসকল! আপনারা অবশ্যই যারা উপস্থিত আছেন তারা এই বাণীটি অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন।

যেহেতু রাসূলের (সাঃ) বক্তব্য শেষ হয়েছিল তাই জিব্রাঈল (আঃ) আবার দ্বিতীয়বারের মত অবতীর্ণ হল এবং তাঁকে এই বাণীটি পৌঁছেদিলোঃ অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও নেয়ামত বা অবদানকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-৩) রাসূল (সাঃ) এই বাণী প্রাপ্ত হয়ে মহানন্দে আনন্দিত হলেন এবং বললেন- আল্লাহ মহান! যে দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও নেয়ামত বা অবদানকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং মহান প্রভূ আমার রেসালাতের বা নবুয়্যতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। অভিবাদন অনুষ্ঠানঃ রাসূল (সাঃ) তাঁর বক্তব্য শেষ করার পর মঞ্চ হতে নেমে আসলেন এবং একটি তাঁবুতে বসে নির্দেশ দিলেন যেন, আলী অপর এক তাঁবুতে বসে। অতঃপর বললেন, যেন সকল সাহাবীগণ আমিরুল মোমিনীনের অভিবাদনের জন্য আসে ও বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের পদাসীনকে অভিবাদন জানানো হয়। ইতিহাসগ্রন্থ রওজাতুস সাফা এর লেখক গাদীরের ঘটনা উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ- অতঃপর নীচে নেমে আসলেন ও একটি নির্দিষ্ট তাঁবুতে বসলেন।

তারপর নির্দেশ দিলেন যেন পর্যায়ক্রমে সবাই আলীর তাঁবুতে যায় ও তাঁকে যেন অভিনন্দন জানায়। যখন সবাই এই কাজটি সম্পন্ন করলেন, উম্মাহাত (নবীর স্ত্রীগণ) আলীর নিকট গেলেন এবং তাকে অভিনন্দন জানালেন। 'হাবিবুস সীয়ার' নামক ইতিহাস গ্রন্থে গাদীরের হাদিস বর্ণনার পর এরূপে এসেছে যে, অতঃপর আমিরুল মোমিনীন আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু অর্থাৎ মূর্তির সমীপে তার শির কখনো নত হয়নি) রাসূলের (সাঃ) নির্দেশের ভিত্তিতে এক তাঁবুতে বসলেন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে অভিবাদন জানাতে পারেন, বিশেষ করে উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের কর্ণধারকে বললেন- অভিনন্দন, অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ থেকে আপনি আমার মাওলা ও মাওলা সকল মোমিন ও মো'মিনাদের। তারপর উম্মাহাতুল মোমিনীন রাসূলের (সাঃ) ইঙ্গিতে আমিরুল মো'মিনীনের তাঁবুতে গেলেন এবং তাকে অভিবাদন জানালেন। মরহুম তাবার্সী মুফাস্সীর, মুহাদ্দিসও ঠিক অনুরূপভাবে তাঁর "ইলামুল ওয়ারা" নামক গ্রন্থে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

সকল সাহাবীগণ আবার রাসূলের (সাঃ) হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করলেন এবং সেই সাথে আলীর (আঃ) সাথেও বাইয়াত বা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। সর্ব প্রথম যে ব্যক্তিবর্গ রাসূলের (সাঃ) ও আলীর (আঃ) হাতে হাত রেখেছিলেন তারা ছিলেন আবুবকর, উমর, উসমান, তালহা ও জোবায়ের। ইতিপূর্বেও তুলে ধরেছি যে, অভিনন্দনের জন্য উমর যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন, তা ঐতিহাসিকদের নিকট স্মরণীয় হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন অভিনন্দন, অভিনন্দন হে আবুতালিব নন্দন! আজ থেকে আপনি আমার এবং সকল মোমিন-মোমিনাদের মাওলা। আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ মুহাদ্দিস বা হাদিসবেত্তাগণ এই ঘটনাটি ঐ সকল সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং উমরের কন্ঠে এই বাক্যটি শুনেছিলেন।

যেমন- যারা এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তারা হলেন- ইবনে আব্বাস, আবু হোরায়ারা, বুরাআ ইবনে আজিব, যায়েদ ইবনে আরকাম, সা'আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস, আবু সাঈদ খুদরী এবং আনাস ইবনে মালিক যাদের নাম উল্লেখযোগ্য। জনাব আল্লামা আমিনী তাঁর "আল-গাদীর" নামক গ্রন্থে ৬০ জন (ষাটজন) আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন যারা স্বীয় গ্রন্থে উক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার অনেকেই ইহাকে আবু বকরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যখন অভিভাদন অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘটল তখন হাস্সান বিন সাবিত নামক একজন কবি, যিনি স্বীয় যুগে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি বললেনঃ "হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমতি প্রার্থনা করছি যে, আপনার উপস্থিতিতে আলীর উদ্দেশ্যে কবিতার ক'টি লাইন পাঠ করবো। " অতঃপর হাস্সান উঁচুস্থানে উঠে পাঠ করতে লাগলেনঃ- মুসলমানদের রাসূল (সাঃ) গাদীর দিবসে উচ্চস্বরে তাদেরকে ডাকলেন, কতটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে, আল্লাহর প্রেরিত একজন ব্যক্তি দেখ কিভাবে আহ্বান করছেন।

তিনি বললেনঃ তোমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক এবং রাসূল কে? সেখানকার সকলেই নির্দ্বীধায় বললেনঃ আপনার আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং আপনি আমাদের রাসূল ও আমাদের মধ্যে এমন একজনকেও পাবেন না, যে বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) নির্দেশের ক্ষেত্রে আপনার অবাধ্য হবে ও বিরোধীতা করবে। তখন আলীকে বললেনঃ হে আলী উঠে দাঁড়াও! কারণ, আমি তোমাকে আমার পরে ইমামত ও নেতৃত্বের জন্য নির্বাচন করেছি। অতঃপর আমি যাদের যাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক, এই আলীও অনূরূপ তাদের তাদের পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং তোমরা তার সঠিক অনুসারী হও এবং তাকে ভালবাস। এবং সেখানে দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ! আলীর বন্ধুকে তোমার বন্ধু মনে কর এবং যে আলীর সাথে শত্রুতা করবে তুমিও তার সাথে শত্রুতা কর।

(চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.