আমি সত্য জানতে চাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, বাংলাদেশের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গবেষণা সংস্থা সিপিডির সভাপতি জনাব রেহমান সোবহানের জন্ম দিন আজ। খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদের জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা
রেহমান সোবহান ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কে. এফ. সোবহান ছিলেন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মায়ের নাম হাসমত আরা বেগম। রেহমান সোবহান তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেছেন দার্জিলিং-এর ঐতিহ্যবাহী সেন্ট পলস্ স্কুলে (১৯৪২-৫০) এবং লাহোরের অ্যাচিসন (Aitchison College) কলেজে (১৯৫১-৫২)।
স্কুল জীবনে তিনি সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। পড়াশুনায় ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যেই থাকতেন সবসময়। খেলাধুলায়ও বেশ আগ্রহ ছিল। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিন বছর তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।
১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তাঁর শিক্ষাজীবন বিস্তৃত হয়েছে অক্সফোর্ড ও হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে আসার পর রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দানের এক বছরের মধ্যেই দেশে সামরিক আইন জারি হলো। সংবিধান স্থগিত করা হলো এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরও বাধা এল।
লেখালেখির মাঝেই তিনি এর প্রতিবাদ করতেন। সামরিক আইনের পুরোটা সময় জুড়েই তিনি বিভিন্ন সভায় দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়টি নিয়ে বক্তৃতা করতেন। সেসময় এক সভায় সভাপতির আসনে বসে ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানী ভদ্রলোক। তিনি রেহমান সোবহানের এক বন্ধুকে ডেকে বলেছিলেন- তিনি কি জানেননা এদেশে এখন মার্শাল ল' চলছে? তাঁর সেদিনের ঐ বক্তৃতা সব বড় বড় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান অবজারভারও ঐ বক্তৃতা তাদের প্রথম পাতায় ছেপেছিল।
ঐ সময় বাংলাদেশের মানুষদের ওপর অত্যাচার, আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা সবাই জানলেও সংবাদপত্রে কেউ প্রকাশ করবার সাহস পেত না। তাঁর বক্তৃতার কারণে তিনি তখন জনগণের কন্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন। এদেশের প্রান্তিক, অধিকার বঞ্চিত, বাকস্বাধীনতাহীন এবং ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ধ্যাণরত, প্রচন্ড আশাবাদী এই মানুষটির লেখনী কাঁপিয়ে দিয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারকে।
১৯৬৫ সালে রেহমান সোবহান বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সালমা সোবহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের বড় ছেলে তৈমুর সোবহান ১৯৮১ সাল আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।
মেজ ছেলে বাবর সোবহান একজন অর্থনীতিবিদ। ছোট ছেলে জাফর সোবহান আইনজীবি। ২০০৩ সালে সালমা সোবহানের মৃত্যুর পর রেহমান সোবহান ড. রওনক জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পাকিস্তানিদের দ্বৈত অর্থনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অদম্য লেখনীর জন্য ১৯৭১-এর কালরাত্রির পরপর হানাদারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। একারণে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন এবং ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ রাতে দিল্লি পৌঁছেন।
রেহমান সোবহান তাজউদ্দিন আহমদের কথামতো এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে ও এপ্রিলের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় ও প্রবাসী বাঙ্গালিদের সংগঠিত করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ৯সাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাঝে আসে চিরকাঙ্খিত সেই স্বাধীনতা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর রেহমান সোবহান অন্যান্যদের সাথে ঢাকা বিমান বন্দরে পৌঁছেন।
১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন রেহমান সোবহান।
অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদমর্যাদায়); শিল্প, বিদ্যুত্ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) যথাক্রমে চেয়ারম্যান, গবেষণা পরিচালক, মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিআইডিএস- এ এমিরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও কুইন এলিজাবেথ হাউজে ১৯৭৬-১৯৭৯ পর্যন্ত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট এর এ্যাডভাইজরী কাউন্সিল (ক্যবিনেট মিনিস্টার এর পদমর্যাদায়), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (১৯৯১) সদস্য ছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি ষ্টাডিজ-এ (২০০১-২০০৫) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৯৪- ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন রেহমান সোবহান। তিনি বিআইডিএসের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া তিনি আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং করছেন।
তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখেন সুখী সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশের। আর তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি কখনো বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা আর সুশীল সমাজের উদ্যোক্তা আবার কখনোবা পৃষ্ঠপোষক হয়ে আজও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইয়ুব খানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যবর্তী শাসন পদ্ধতিতে সার্বজনীন সাহসী উদ্যোগের ভূমিকা, বৈদেশিক নির্ভরশীলতার সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা, কৃষিজ সংস্কার, সমন্বয় নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ এবং সর্বশেষে দারিদ্র বিমোচনের কৌশল।
এ পর্যন্ত রেহমান সোবহানের ৪২টি বই আর মনোগ্রাফ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন জার্নালে প্রায় ২০০ এর উপরে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আর এসব কিছুর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৮ সালে স্বাধীনতা পদক অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের 'মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতিবিদ' হিসেবে খ্যাত, খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদের জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।