আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাজেট ২০১১-১২: প্রবল চাপ ও ঝুঁকির মুখে অর্থমন্ত্রী-এম এম আকাশ

ইসলামের পথে থাকতে চেষ্টা করি...। এবারের বাজেট ছিল বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসার পর তৃতীয় বাজেট। প্রথম দুই বাজেটে অর্থমন্ত্রী এবং সরকারের লক্ষ্য ছিল, উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত দু’টি সমস্যার সমাধান করা। প্রথমটি বিশ্বব্যাপী মন্দার আঘাত সামলানো এবং দ্বিতীয়টি হলো বিগত চারদলীয় জোটের চরম দুর্নীতি ও বিদ্যুৎ সংকটের মোকাবিলা করা। সুতরাং প্রথম দুই বাজেটে সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যে দিন বদলের ডাক দিয়েছিলেন সেটি প্রতিফলনের সুযোগ ছিল কম।

জনগণের প্রত্যাশাও ছিল তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু তৃতীয় বাজেটে এসে মানুষ দেখতে চায় অর্থমন্ত্রী তার নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিগুলো রক্ষা করছেন। তাই এই বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা ছিল মূলত তিনটি। প্রথমত: প্রবৃদ্ধির হার শুধু উচ্চই হবে না, তার ফলও অধিকাংশ জনগণ কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে উপভোগ করতে পারবেন। দ্বিতীয় প্রত্যাশা ছিল দুর্র্বিষহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকার কার্যকর বিশ্বাসযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।

তৃতীয় প্রত্যাশা ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের নিরসন হবে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ভোক্তাগণ তা ভোগ করতে পারবেন। অর্থমন্ত্রী এসব প্রত্যাশার কথা নিশ্চয়ই জানতেন; কিন্তু এও তিনি জানেন যে, প্রত্যাশা পূরণের জন্য সম্পদ প্রয়োজন। আর বাংলাদেশের সরকারের সম্পদ সংগ্রহ ও সম্পদের দক্ষ ব্যবহার উভয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি জানতেন যে, তৃতীয় বছরে এসে এমন কোনো অজনপ্রিয় ঘোষণা তিনি দিতে পারবেন না, যাতে জনগণ বর্তমান সরকারের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সকলের আকাংখা পূরণের জন্য বিশাল এক বাজেট ব্যয়ের প্রস্তাব করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।

বিশাল এই অর্থে নয় যে এটির প্রয়োজন নেই বা এটি অসম্ভব। বিশাল এই অর্থে যে, কেন্দ্রিভূত আমলাতন্ত্রের উপর বা বৈদেশিক সাহায্যের অনিশ্চিত প্রবাহের ওপর নির্ভর করে বা ব্যাপক ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে বা রাজস্ব বৃদ্ধির একটি অতি উচ্চকল্পিত হারের অনুমানের ভিত্তিতে বড় একটি বাজেট ঘোষণা স্বাভাবিকভাবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু সেটিই করেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। আমার এই বক্তব্যের স্বপক্ষে আমি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে দুটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরতে চাই। বাজেট বক্তৃতার চৌত্রিশতম ধারায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ”বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনা ও ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় এনে আগামী ২০১১-১২ অর্থবছরে আমরা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ৭ শতাংশ। আমাদের সম্ভাবনা অপরিসীম তবে ঝুঁকিও রয়েছে।

” দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি রয়েছে ৩৮তম ধারায়। সেটি হচ্ছে, ”জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিজনিত অভিঘাত মোকাবিলার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন: হয়তো বেশকিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হতে পারে। (১) ভর্তুকিসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হ্রাস, (২) প্রয়োজনে কৃচ্ছ্রতা সাধন, (৩) রাজস্ব আয় বাড়ানো, (৪) মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যক্তিখাতে ঋণ সরবরাহ কমানো এবং (৫) বিনিময় হারের যথাযথ বিন্যাস। ” সুতরাং ঝুঁকির কথা অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ বছর মানুষ সরকারের কোনো ব্যর্থতাই সহ্য করবে না। এ বছর মানুষ ব্যাখ্যার পরিবর্তে বাস্তব কাজ ও ফলাফলের দিকেই বেশি মনোযোগ দেবে। সুতরাং বর্তমান বাজেটে ওই ঝুঁকিগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করে জনগণকে আস্থায় নিয়ে কতকগুলো অগতানুগতিক পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিলেই সরকার ভালো করতেন। সরকার ভালো করেই জানেন, বিদেশে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে তাই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছি না বা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছি না, এসব কথা বলার দিন ফুরিয়ে গেছে। স্পষ্টতই বোঝা যায়- OMS Fair Price card, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য রেশন, টিসিবির শক্তিশালীকরণ, ভোক্তা-অধিকার আইন প্রণয়ন, বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া, কৃষকদের ক্লাব এবং সমবায় গড়ে তোলা ও উৎপাদকদের বাজার তৈরি করা ইত্যাদি যেসব অগতানুগতিক নীতি-কৌশলের কথা সরকার অনেকদিন ধরে বলছেন এবং এই বাজেটেও যা আবার বলা হয়েছে, তা ফলপ্রসুভাবে বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে আগামীতে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সেজন্য শুধু ”সেইফটিনেট প্রোগ্রামের” অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করাটাই যথেষ্ট বলে এবার বিবেচিত হবে না। উপরোক্ত অগতানুগতিক নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, দলের ভেতরে এবং বাইরের দাতাদের তরফ থেকে প্রবল বাধা রয়েছে। বাধা রয়েছে স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের পক্ষ থেকে। মুক্তবাজারপন্থি অর্থনীতিবিদরাও কল্যাণধর্মী এসব কর্মসূচি অনুমোদন করবেন না। সুতরাং এই বছর সরকারের অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে, এসব অগতানুগতিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং ভর্তুকির দ্বারা দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা।

সরকারের ওপরে এবছর প্রবল চাপ থাকবে বিভিন্ন সেক্টরে অর্থায়ন করা এবং সেজন্য বিশাল সম্পদ সংগ্রহ করা। দুটি চাপের কথা এখনই বলা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে হয় সরকারকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে অথবা রাজনৈতিক বিবেচনায় তা যদি অসম্ভব হয় তাহলে ভর্তুকির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যেহেতু আমাদের প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে, সেহেতু বাজারে চালের নি¤œতম দাম কেজিপ্রতি ৩৫ টাকার কম হবে না। এই দামে দেশের ৩০ শতাংশ হতদরিদ্র লোক বাজার থেকে চাল কিনতে সক্ষম হবে না। ”সেইফটিনেট এবং নানা রকম কর্মসূচি দ্বারা এই সারে চার কোটি লোকের মাত্র ৩৫ শতাংশকে কাভার করা যাবে, বাকি ৩ কোটি লোককে বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে সরকারের পক্ষে উদাসীন হয়ে বসে থাকা সম্ভব হবে না।

যদি সরকারের উন্নয়নব্যয় ও বিনিয়োগ দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হতো, তাহলে দ্রুত ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোগুলো গড়ে উঠত। সেখানেও অনেক লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব হতো। আর ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো অনুকূল হলে ব্যক্তিখাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেত। যদি আয় বণ্টনের বিরাজমান বৈষম্য আর না বাড়ে, তাহলে ঐ বিনিয়োগজনিত প্রবৃদ্ধি থেকে সমানুপাতিক হারে দরিদ্র্য লোকেরাও উপকৃত হতেন। আর সরকার যদি সুষম বণ্টনের নীতি অনুসরণ করে দরিদ্র-অভিমুখী ঋণ ও সম্পদের প্রবেশাধিকার ত্বরান্বিত করতে পারতেন, তাহলে প্রবৃদ্ধির সুফল আরো বেশি করে এই দরিদ্র জনগণ পেত।

সরকারের বাজেটে এসব বিষয়ে কিছু কিছু কথা আছে। সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অর্থায়ন, খাস জমি ও জলা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ, বিকেন্দ্রিভূত জেলা বাজেট প্রণয়ন-এসব বিষয়ে অনেক বড় বড় বক্তব্য প্রদান করেছেন। এমনকি সম্পদশালীদের কাছ থেকে কর আদায়ের প্রস্তাবও এই বাজেটে রয়েছে। যদিও শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যারা সহসাই প্রচুর সম্পদ আহরণ করলেন, তাদের সরকার প্রশ্রয় দিয়ে বর্তমান বাজেটে ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজদের একটি ইতিবাচক বা নির্বিকার থাকার সিগন্যাল দিয়েছেন। সুতরাং এখানেও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কায়েমী স্বার্থের চ্যালেঞ্জ।

সবশেষে একটি আশঙ্কার কথা বলে এ লেখা শেষ করছি। ধরা যাক, সরকার তার বর্তমান বাজেটের গতানুগতিক দিকগুলো রক্ষা করলেন; কিন্তু অগতানুগতিক পরামর্শগুলো শুধু Lip Service-এ পরিণত হলো অথবা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের চাপে সরকার এসব পদক্ষেপ আধা-খেঁচরাভাবে বাস্তবায়িত করলেন, তখন কী হবে? তখন সরকারের তহবিলে টান পড়বে। ব্যাংক থেকে ঋণ করেও কুলাবে না। আইএমএফের কাছে ধর্না দিতে হবে। আইএমএফ কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র বুঝে না! সে বুঝে নয়া উদারনৈতিক নীতির কঠিন বাস্তবায়ন।

বর্তমান সরকার কি তখন বাধ্য হয়ে আইএমএফের তিক্ত বটিকা গিলবেন? ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.