শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
ইসলামের ইতিহাস পড়তে গিয়ে (একাডেমিক, পাঠ্যর কথা বলছি) ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে ধর্ম হিসেবে ইসলামের যে বিস্তৃতি সেই বিস্তৃতি ঘটেছে উমাইয়া শাসকদের হাতে। বস্তুত, এই একুশ শতক পর্যন্ত ইসলামের এসে পৌঁছুনোর পেছনেও ছিল তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের অভীপ্সার প্রণোদনা-- এটা নিছকই আমার শিক্ষার্থী সুলভ পর্যালোচনা বা পর্যবেক্ষণ। এর সঙ্গে আমি আমার ইসলাম সম্পর্কিত পূর্ব-ধারণার কোনো মিল ঘটাতে পারিনি। পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্তের অভাব, ধারাবাহিক অনুসন্ধিৎসায় ঘাটতি সব মিলিয়ে এই ঔৎসুক্যের কোনও উত্তর খুঁজিনি। জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে দেখলাম তারও ঐ একই অভিজ্ঞতা।
আমার মনে হয়, পাঠ্য বইয়ে যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন তাদের সবার অভিজ্ঞতাই একই রকমের। কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে না—অমীমাংসিত সেই উত্তর অনীহার বিবরেই হারিয়ে যায়। পাঠ্যের বাইরে আমাদের আর কোনও অনুসন্ধিৎসা থাকে না। ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে চাপা পড়ে যায় প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলোও। এটাই স্বাভাবিক সত্যানুসন্ধানী প্রশ্ন সর্বত্র, সর্ব যুগেই সীলমোহরাঙ্কিত হয়েছে কখনও রাজদ্রোহী, দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী বর্তমানে ‘জঙ্গি’।
বর্তমানে ‘মুসলিম’ এবং ‘জঙ্গি’ শব্দদুটিকে সমার্থক করে তুলেছে তথাকথিত উন্নত বিশ্বের সিপাহী বরকন্দাজরা। সেরকম একটা সময়ে ‘মুসলমানমঙ্গল’ রচনাকে আমি জাকিরের সাহসিকতা বলব না, বলব সত্যানুসন্ধিৎসার ‘প্রয়াস’। পাঠক, লক্ষ্য করবেন ‘প্রয়াস’ বলছি, অর্জন নয় ; তবে সূচনা বলা যায়।
জাকির তালুকদার তার বইয়ের শেষ প্রচছদে যে কথাগুলো পাঠকের প্রতি লিখেছেন, ‘সংবেদী পাঠক, উভয়েই আপনি এবং আমি, রক্তাক্ত হই প্রতিনিয়ত আমাদের মুসলমান এবং বাঙালি এই দুই পরিচয় নিয়ে। রক্তাক্ত হই দুই দিক থেকেই।
বাহিরের দিকে আছে তথাকথিত উন্নত বিশ্বের মানুষ। তারা কিছু ভিক্ষে, সাহায্য ও ঋণচক্রজালের সাথে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা ও ঘৃণা ছিটিয়ে চলে আমাদের মুখে। আর ভেতরের দিকে রয়েছে আমাদের পাহাড়সম জাতীয় অজ্ঞতা, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে মানুষের অনীহা, ধর্মের নামে প্রতারিত হওয়ার জন্য উš§ুখ হয়ে থাকা, সারাজীবন ভুল নেতৃত্ব নির্ধারণ, আÍসম্মানবোধের অভাব, বহির্বিশ্বে নিজেদের অবস্থান স¤র্কে ধারণহীনতা এবং সর্বোপরি নিজেকে চিনতে চেষ্টা না করার বেদনাদায়ক অথর্বতা। আমাদের আছে গৌরবের অতীত, কিন্তু অসম্মানের বর্তমান, আর অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ। এই উপাখ্যান তাই এক অর্থে রক্তাক্ত বেদনারও উপাখ্যান।
কষ্টভাগ করে নিলে তা নাকি উপশমের সমান। এই প্রত্যাশা নিয়েই আপনি আর আমি মুখোমুখি। চলুন তাহলে শুর করা যাক।
মোটা দাগের বেদনার বিষয়গুলো জাকির তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যেই অনেক অসঙ্গতি বিদ্যমান।
জাকির যে বেদনায় আক্রান্ত সেই বেদনায় আক্রান্ত হয়ে কবিতা লেখা যায় উপন্যাস অবশ্যই নয়। জাকিরের সংবেদী পাঠকে প্রতি আহ্বানটি ভাবালুতায় পূর্ণ বঙ্গজাতিক কো¤ানির বিজ্ঞাপনের মতই যা এই বইটি লেখায় জাকিরের সদিচছাজাত প্রয়াসকেই মতান্তরে নস্যাৎ করে প্রায়।
মহাকবি গ্যেটে তার বন্ধু একরম্যানকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “ইসলাম স¤র্কে যা পড়লাম, যা জানলাম তাই যদি ইসলাম হয় তাহলে একথা বলতেই হবে জগতের সব মনীষীরই জীবন কাটে একজন মুসলমান হিসেবে। ” জাকিরের সংবেদী পাঠকের উদ্দেশে লেখা বক্তব্যে আমরা রক্তাক্ত হই উন্নত বিশ্বের যে মানুষদের দ্বারা তারা কারা? তারা কি উন্নত বিশ্বের সব মানুষের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে যার জন্য তাদের আমরা একবাক্যে বলে দিতে পারি উন্নত বিশ্বের মানুষ! অবশ্যই নয়—এতোটা সাধারণীকরণ ‘মুসলমানমঙ্গল’-এর লেখকের কাছে আশা করা যায় না। যাদেরকে জাকির উন্নত বিশ্বের মানুষ বলছেন তারা নিজেরাও উন্নত নন, উন্নত বিশ্বের প্রকৃত প্রতিনিধি নন, তারা উন্নত বিশ্বের কোন একটি সিন্ডিকেটের সদস্য মাত্র—যারা সর্বত্রই এমনকি তাদের দেশে সৎ এবং শুভ-র প্রতিপক্ষ।
জাকির লিখছেন আমরা আমাদের মুসলমান এবং বাঙালি এই দুই পরিচয় নিয়ে রক্তাক্ত হই। কেন? কার কাছে কার জন্য? কোন সময়ে? এই একুশ শতকে আমাদের বাঙালি এবং মুসলমান এই দুই পরিচয় নিয়ে বিব্রত হয়েছি আমরা যথেষ্ট একথা সত্য, সে কাল কি এখন আর আছে? আমাদের কে বাঙালি বলতে অনিচছুক ছিলেন যারা তারা তাদের ‘বাঙালি’-পরিচয় বিলীন করে দিয়েছেন ‘ভারতীয়’ পরিচয়ের নিখিলত্বের গর্ভে। আর আমাদের মুসলমান পরিচয়ে যারা অনিচছুক ছিলেন সেই আমাদের ---- ইসলাম- যাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান কায়েমস করেছিলাম সেই তথাকথিত ‘মুসলমান’ পাকিস্তানীরা আজ নিজেদের তালেবান ঘোষণা করছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। যারা আমাদের দুই পরিচয়েই দুই সিক থেকে বিব্রত করেছে—তাদের পরিণতি জানার পরও আমরা কেন বিব্রত যে আমাদের পরিচয় নিয়ে? সত্য তো তার শক্তিতেই দেদীপ্যমান- সত্য এই যে, পৃথিবীতে আমরাই বাঙালি মুসলমান। মহাকবিতা গ্যেটে যদি ইসলাম স¤র্কে পড়ে, জেনে এই কথা উপলব্ধি করতে পারেন যে জগতের সব মনীষীরই জীবন অতিবাহিত হয় একজন মুসলমান হিসেবে তবে আমরা এই বাংলাভাষী ভূরাজ্যের অধিবাসী মুসলমানরা যেন বিব্রত বা রক্তাক্ত হয় বাঙালি পরিচয়ে? আমরা তা নই, তা ছিলাম না বলেই এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
জাকির পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে ‘মানুষের অনীহার’ কথা বলেছেন, বলেছেন নিজেকে চিনতে না পারার ‘বেদনাদায়ক অথর্বতার’ কথা—এই সব শব্দ চয়ন এবং সাধারণীকরণ খুবই সমালোচনার যোগ্য এই বইটির জন্য বলে আমি মনে করি। জাকিরের এই বইয়ের শুর€র দিকেই ১৮-১৯ পৃষ্ঠায় সৈয়দ আমীর আলীর উদ্ধৃতি সহযোগে বিজ্ঞানী ইবনে সিনা এবং ইমাম গাজ্জালীর বাহাসের উদাহরণটি উদ্ধৃত হয়েছে। আমার মনে হয়েছে জাকির এই গ্রন্থ রচনার রচনায় নিজের অজান্তেই গাজ্জালী পন্থায় ঝুঁকে পড়েছেন। উপন্যাসের আদলে ‘মুসলমানমঙ্গল’ একটি সংকলন গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। যেখানে উসলাম স¤র্কিত নানা বাহাস বিতর্কগুলোর সমাবেশ ঘটেছে- তবে এটির সম্ভাবনা ছিল একটি চমৎকার উপন্যাস হয়ে ওঠার।
আমার মনে হয়েছৈ এটি লিখতে গিয়ে জাকির ঠিক করতে পারেননি তিনি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে উসলামকে হাজির করবেন নাকি ইসলামের ভেতর দিয়ে একটি উপন্যাসকে? যেটিই করতে চান না কেন খুব সহজ নয় সেই কাজ। এই কাজের জন্য সরকার গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং ধর্ম, সমাজ, দর্শন স¤পর্কে স্ব ছ প্রজ্ঞা- কেবলই আবেগকে সম্বল করে ইবনে সিনার মতো সত্যাবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
‘মুসলমানমঙ্গল’ রচনার অর্থ যদি হয় ‘গৌরবময় অতীত’ (ব্যাক কভারে যার উল্লেখ করেছে জাকির—যা মূলত এক প্রহেলিকাও)-এর রেনেসাঁর চিন্তা সেখানেও প্রয়োজন আছে প্রহেলিকা মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির। সোজা কথায় বলতে পুনরজ্জীবন নয়, দরকার জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়তার উজ্জীবন। অতীতের বোঝা নয়, বর্তমানের সঙ্গে যা যায় তাকে এনে জীবনে এবং বর্তমানে অধিষ্ঠিতকরণ।
না, এ নতুন কোনো মাযহাবের সূচনার কথা নয়—সূচনার কথা জীবনের। জাকির যে জন্য পরিশ্রম করেছেন সেই অনুভূতিটি যতই আবেগের চোরাবালিতে ঘুরপাক খাক না কেন আমি তাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি তার সূচনাকে স্বাগত জানাই।
মুসলমানমঙ্গল- জাকির তালুকদার \ প্রকাশক- রোদেলা \ প্রছদ- মাহবুব কামরান \ মূল্য- ৩৫০ টাকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।