বাংলা আমার দেশ
মুনতাসীর মামুনের লেখা যেদিনই পত্রিকায় ছাপা হোক সবার আগে ওটাই পড়তে হয়। মামুনের কলামের অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠকের ভেতর আমিও একজন। পড়া শেষ করে মামুনকে ফোন করে বলি, কোন প্রসঙ্গ ভাল লেগেছে, কোনটি আরও ভাল হতে পারত। অনেকের মতো আমিও বলি মামুনের লেখা তথ্যের ভাণ্ডার। ব্যক্তি ও ঘটনা সম্পর্কে মামুনের তীর্যক মন্তব্য তার লেখার প্রধান আকর্ষণ।
মামুনের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য সমরতন্ত্র, স্বৈরাচার, আমলাতন্ত্র, মৌলবাদ ও সা¤প্রদায়িকতা। মামুনের ধারালো মন্তব্য জামায়াত, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা সমচরিত্রের দলগুলোকে যেমন মাংশের কিমার মতো কুচি কুচি করে কাটে, অনেক সময় আওয়ামী লীগকেও রেহাই দেয় না।
জনকণ্ঠে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো বরেণ্য কলামিস্ট থেকে আরম্ভ করে আমার মতো অভাজনদের লেখাও ছাপা হয়। কোন লেখা কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে সম্পাদকরা তা জানেন। মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশে একমাত্র কলাম লেখক যার লেখা ছবি সহ দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়।
এতে সমগোত্রীয়দের কেউ ঈর্ষা বোধ করেন বৈ কি, আমি বন্ধুগর্বে গর্বিত হয়ে অন্যদের পড়ে শোনাই। কাউকে না পেলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া পুত্র অর্পণকে বলি শোন, তোর মামুন কাকা কী লিখেছে।
১৯ মার্চ জনকণ্ঠে মামুনের লেখা ‘বিএনপির বিরুদ্ধে মওদুদের অভিযোগ’ পড়ে যথারীতি ফোন করেছি। কয়েকটি তথ্যগত ভুল ও অসম্পূর্ণতার কথা উল্লেখ করেছি। ভুল সম্পর্কে মামুনের বক্তব্য বিএনপির প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের বইয়ে ওভাবে বলা হয়েছে।
অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে মামুন আমাকে লিখতে বলেছেন।
হাসিনা, খালেদা, এরশাদের পর মামুন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন মওদুদ আহমেদ সম্পর্কে। এবার মামুন লিখেছেন মওদুদের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ঃ এ স্টাডি অব দি ডেমোক্রেটিক রেজিমস’ সম্পর্কে। মওদুদের এ বইটি না পড়লেও অন্য বই পড়েছি। লেখক ও রাজনীতিবিদ মওদুদের দ্বৈতচরিত্র সম্পর্কে মামুন যে মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোন সুযোগ নেই।
মামুন লিখেছেন
‘যে ক’জন বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন তার মধ্যে মওদুদ একজন। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি তাঁকে বর্জ্য মনে করি। অবশ্য তাতে তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু তিনি যখন লেখেন তখন বাংলাদেশের যে কোন ভাল একামেডিশিয়ানের চেয়ে খারাপ লেখেন না, সঙ্গে সঙ্গে ভাবি, তাঁর যদি উচ্চাশা কম থাকত তাহলে তিনি আজ সামাজিক স্বীকৃতি পেতেন উঁচুমানের গবেষক হিসেবে। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যা লিখেছেন তার অনেক কিছু মওদুদের ধারেকাছেও আসে না।
ডা. জেকিল এ্যান্ড মিস্টার হাইড বলতে যা বোঝায় মওদুদ আহমেদ ঠিক তাই। ’ (জনকণ্ঠ, ১৯ মার্চ ২০১২)
আমি এর আগে মওদুদকে বলেছিলাম বাদুড়পন্থী রাজনীতিবিদ। মামুনের মন্তব্য পড়ে মনে হয়েছে মওদুদের সঙ্গে তুলনা করে নিরীহ বাদুড়কে আমি অপমান করেছি।
মামুনের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গোলাম আযম সম্পর্কে মওদুদের মূল্যায়ন। মওদুদ না জানালে মামুনের মতো আমিও জানতাম না ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া যে সরকার গঠন করেছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল নূরুদ্দিন।
মামুন এ ধরনের আরও কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছেন মওদুদের বই থেকে, এর জন্য দুই লেখককেই ধন্যবাদ জানাব। মামুন না লিখলে অনেক পাঠকের কাছে মওদুদের এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি অজানা থেকে যেত। তবে জামায়াতের আমীর নির্বাচন সম্পর্কে মওদুদের বই থেকে মামুন যে তারিখ উল্লেখ করেছেন তা ঠিক নয়। মওদুদ লিখেছেন গোলাম আযম জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে। এ তথ্য সঠিক নয়।
সেই সময় পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত গোলাম আযম বাংলাদেশের সংবিধান লংঘন করে জামায়াতের আমীর হয়েছিলেন ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে।
সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর (১৯৯১)-এর দৈনিক সংবাদে। ঘটনাটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, প্রধানতঃ এরই প্রতিবাদে দেশব্যাপী সমালোচনা ও ক্ষোভের যে ঝড় উঠেছিল তারই যৌক্তিক পরিণতি ছিল ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন। নির্মূল কমিটির প্রধান দাবি ছিল অবিলম্বে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচার করতে হবে। নির্মূল কমিটি গঠনের ঘোষণায় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হয়েছিল সরকার যদি ২৫ মার্চের ভেতর গোলাম আযমের বিচার না করে তাহলে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে তার বিচার করা হবে।
আমার লেখা ‘গণআদালতের পটভূমি’ গ্রন্থটি আরম্ভ হয়েছে এই ঘটনা উল্লেখ করে। ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই গ্রন্থে আমি লিখেছিলাম
‘২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোট্ট এক কলাম সংবাদ বেরিয়েছেজামায়াতে ইসলামীর পাঁচ দিন ব্যাপী মজলিশে শুরার বৈঠকে গোলাম আযমকে দলের আমীর নির্বাচন করা হয়েছে। গোলাম আযম এই দলের আমীর আগেও ছিলেন। গত একযুগ ধরে তিনি জামায়াতের আমীরগিরি করছিলেন পর্দার আড়ালে থেকে।
প্রকাশ্যে কাজ চালাচ্ছিলেন আব্বাস আলী খান, অস্থায়ী আমীর হিসেবে। গোলাম এবার ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন।
একজন পাকিস্তানী নাগরিক, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য যে ব্যক্তি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্ররোচিত করেছিলেন এদেশের রাজনীতিতে ঘোষণা দিয়ে তার যোগদানে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।
সেদিন সকাল দশটার দিকে কর্ণেল জামান টেলিফোন করলেনÑ‘পত্রিকায় খবর দেখেছো?’
জানতাম তিনি কোন খবরের কথা বলছেন। জবাব দিলাম, ‘দেখেছি।
’
‘তুমি কালই কেন্দ্রের জরুরি বৈঠক ডাকো। আমরা এটাকে আনচ্যালেঞ্জড যেতে দিতে পারি না। ’*
নির্মূল কমিটি যারা গঠন করেছিলেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা নন। গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের মতো উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে এ বিষয়টি প্রথম থেকেই আমাদের বিবেচনায় ছিল। যে কারণে নির্মূল কমিটি গঠনের প্রথম দশ দিনের ভেতর জামায়াত ছাড়া সকল দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা শেষ করেছিলাম।
আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলো প্রথম থেকেই আমাদের কর্মসূচী সমর্থন করেছিল। গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচী সফল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে আমরা ১১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করি।
নির্মূল কমিটি এবং সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তখন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাসদের কাজী আরেফ আহমেদকে এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কর্মসূচীর সমালোচনা করেছে, যদিও গণআদালতের তহবিলে বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য অর্থপ্রদান করেছিলেন।
চট্টগ্রামে ছাত্রদল জাহানারা ইমামের জনসভায় এসে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। জাতীয় পার্টির প্রধান নেতা জেনারেল এরশাদ তখন কারাগারে। জেলের বাইরে দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা তখন মওদুদ আহমেদ, যার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তার কাছে যখন গণআদালতের কর্মসূচীর পক্ষে জাতীয় পার্টির সমর্থন চাইলাম তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি এখন (১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারিতে) বিএনপি সরকারের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে।
গণআদালত সমর্থন করার অর্থ হচ্ছে জামায়াতের বিরুদ্ধে যাওয়া। আমরা শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে চাই না। তোমরা তোমাদের আন্দোলন নিয়ে এগিয়ে যাও। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাদের সমর্থন করব না, বিরোধিতাও করব না।
সমন্বয় কমিটির কোন কোন বাম নেতা বিএনপির সঙ্গে আলোচনার পক্ষে থাকলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার পক্ষে ছিলেন না।
মওদুদের বক্তব্যে তারা স্বস্তিবোধ করেছিলেন।
জঙ্গী হামলার আশঙ্কায় গত ১২ মার্চ (২০১২) বিএনপির ঢাকা চলো কর্মসূচী সরকার যেভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে আমি তা সমর্থন করিনি। আগের দিন টেলিভিশনের এক আলোচনায় আমি এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনাও করেছি। তবে মওদুদ আহমেদ সহ বিএনপির নেতারা যেভাবে সরকারকে তুলোধুনো করেছেন তাদের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে বলেছি। ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কর্মসূচী বানচাল করার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল তা ১২ মার্চের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল।
তখন দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধ করে মহাসড়কে কাঁটাতারের বেরিকেড দিয়ে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। আগের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় পাঁচশ মাইকের হর্ণ ঝোলানো হয়েছিল সেগুলো পুলিশ জব্দ করেছিল। ২৬ মার্চ মাইক ছাড়া গণআদালতের রায় ঘোষিত হয়েছিল। ১৪৪ ধারা সহ সকল বাধা উপেক্ষা করে, বেরিকেড ভেঙে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছিলেন। জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়েছিল, যদিও আমরা বলেছিলাম, আমাদের কর্মসূচী সরকারের বিরুদ্ধে নয়।
বিএনপি সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সমার্থক বিবেচনা করেছিল।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সারা দেশে সমর্থন ও উত্তেজনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন খবরের কাগজে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিলাম জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সবাই ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে এমন অভূতপূর্ব গণজাগরণ অতীতে কখনও দেখা যায় নি।
গণআদালতের দুদিন আগে সরকার গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছিল।
মওদুদ আহমেদ লিখেছেন ১৯৬৪ সালের ‘ফরেনার্স এ্যাক্ট’-এর ৩ নং সেকশন অনুযায়ী সরকার গোলাম আযমকে ১৯৯২-এর ২৪ মার্চ গ্রেফতার করেছিল। অর্থাৎ ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদেশী নাগরিক হিসেবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গোলাম আযম ‘ফরেনার্স এ্যাক্ট’ লংঘন করেছেন ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে, যখন জিয়াউর রহমানের বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখনও আমরা তাকে গ্রেফতার করতে বলেছিলাম, করা হয়নি। খালেদা জিয়া প্রথম ক্ষমতায় এলেন ১৯৯১-এর ২০ মার্চ।
ফরেনার্স এ্যাক্টে তিনি গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছেন এক বছর পর। এর উদ্দেশ্য ছিল গণআদালতকে কেন্দ্র করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির মতো ধূমায়িত জনতার রুদ্ররোষ থেকে তাকে রক্ষা করা। জামায়াতকে সন্তুষ্ট করার জন্য এরপর খালেদা জিয়া আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ২৫ মার্চ (১৯৯২) এক সরকারি প্রেসনোটে আমাদের সম্পর্কে বলা হয়েছিল
‘সরকার এটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চান যে তথাকথিত গণআদালতের নামে নৈরাজ্য, বিশৃংখলা, সন্ত্রাস ও ঘৃণা সৃষ্টি করে যারা স্বাভাবিক জীবনকে বিঘœ সৃষ্টি করার অসৎ তৎপরতার সঙ্গে জড়িত হবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রেসনোটে বলা হয়, সরকার আশা করেন যে, অধ্যাপক গোলাম আযমকে কেন্দ্র করে বেআইনী তৎপরতার প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন সমাজের সকল সচেতন জনগণ তার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা দেবেন।
প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় যে, দেশের আইন অনুযায়ী গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছেন এবং আটক রেখেছেন। এতে বলা হয়, সরকার গত মঙ্গলবার এক প্রেসনোটের মাধ্যমে সংবিধান-বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্যে তথাকথিত গণআদালতের উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকারের এই আহ্বান সত্ত্বেও তথাকথিত গণআদালতের উদ্যোক্তারা গণআদালত নিয়ে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, সরকার এর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে এই মর্মে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন যে, বেআইনী ও অবৈধ তৎপরতার জন্যে কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে না। কয়েকজন উদ্যোক্তা নোটিশের জবাব দিয়েছেন কিন্তু বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
‘প্রেসনোটে বলা হয়, দেশে বর্তমানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত। এই সরকার দেশে সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘এতে বলা হয়, তথাকথিত গণআদালতে যে কোনো বিচার হলে তা হবে সংবিধান মতে প্রতিষ্ঠিত আদালত ও আইনকে অস্বীকার করা। ’*
এর জবাবে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন
সরকারের সাথে আমাদের কোন সংঘাত নেই। গণআদালত বেআইনী বা সংবিধান পরিপন্থী নয়।
গণআদালত প্রচলিত বা সাংবিধানিক কোনো আদালত নয়। জনমত প্রকাশ করা। যাতে সরকার এই জনমতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পারে। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে আমরা গণআদালত বসাতে চাই সরকার গণআদালত বানচাল করার জন্য কোনো দুর্বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে না। সরকার যদি গণআদালতের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় তবে তা মোটেও শুভকর হবে না।
’**
এপর গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সমগ্র বিশ্বের নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মওদুদ আহমেদ ও খালেদা জিয়ারা এখন গোলাম আযম সহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিজেদের অবস্থান স্থায়ী করেছেন।
মুনতাসীর মামুনের লেখা যেদিনই পত্রিকায় ছাপা হোক সবার আগে ওটাই পড়তে হয়। মামুনের কলামের অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠকের ভেতর আমিও একজন। পড়া শেষ করে মামুনকে ফোন করে বলি, কোন প্রসঙ্গ ভাল লেগেছে, কোনটি আরও ভাল হতে পারত।
অনেকের মতো আমিও বলি মামুনের লেখা তথ্যের ভাণ্ডার। ব্যক্তি ও ঘটনা সম্পর্কে মামুনের তীর্যক মন্তব্য তার লেখার প্রধান আকর্ষণ। মামুনের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য সমরতন্ত্র, স্বৈরাচার, আমলাতন্ত্র, মৌলবাদ ও সা¤প্রদায়িকতা। মামুনের ধারালো মন্তব্য জামায়াত, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা সমচরিত্রের দলগুলোকে যেমন মাংশের কিমার মতো কুচি কুচি করে কাটে, অনেক সময় আওয়ামী লীগকেও রেহাই দেয় না।
জনকণ্ঠে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো বরেণ্য কলামিস্ট থেকে আরম্ভ করে আমার মতো অভাজনদের লেখাও ছাপা হয়।
কোন লেখা কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে সম্পাদকরা তা জানেন। মুনতাসীর মামুন বাংলাদেশে একমাত্র কলাম লেখক যার লেখা ছবি সহ দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। এতে সমগোত্রীয়দের কেউ ঈর্ষা বোধ করেন বৈ কি, আমি বন্ধুগর্বে গর্বিত হয়ে অন্যদের পড়ে শোনাই। কাউকে না পেলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া পুত্র অর্পণকে বলি শোন, তোর মামুন কাকা কী লিখেছে।
১৯ মার্চ জনকণ্ঠে মামুনের লেখা ‘বিএনপির বিরুদ্ধে মওদুদের অভিযোগ’ পড়ে যথারীতি ফোন করেছি।
কয়েকটি তথ্যগত ভুল ও অসম্পূর্ণতার কথা উল্লেখ করেছি। ভুল সম্পর্কে মামুনের বক্তব্য বিএনপির প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের বইয়ে ওভাবে বলা হয়েছে। অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে মামুন আমাকে লিখতে বলেছেন।
হাসিনা, খালেদা, এরশাদের পর মামুন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন মওদুদ আহমেদ সম্পর্কে। এবার মামুন লিখেছেন মওদুদের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ঃ এ স্টাডি অব দি ডেমোক্রেটিক রেজিমস’ সম্পর্কে।
মওদুদের এ বইটি না পড়লেও অন্য বই পড়েছি। লেখক ও রাজনীতিবিদ মওদুদের দ্বৈতচরিত্র সম্পর্কে মামুন যে মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোন সুযোগ নেই। মামুন লিখেছেন
‘যে ক’জন বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন তার মধ্যে মওদুদ একজন। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি তাঁকে বর্জ্য মনে করি। অবশ্য তাতে তার কিছু আসে যায় না।
কিন্তু তিনি যখন লেখেন তখন বাংলাদেশের যে কোন ভাল একামেডিশিয়ানের চেয়ে খারাপ লেখেন না, সঙ্গে সঙ্গে ভাবি, তাঁর যদি উচ্চাশা কম থাকত তাহলে তিনি আজ সামাজিক স্বীকৃতি পেতেন উঁচুমানের গবেষক হিসেবে। কারণ, আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যা লিখেছেন তার অনেক কিছু মওদুদের ধারেকাছেও আসে না। ডা. জেকিল এ্যান্ড মিস্টার হাইড বলতে যা বোঝায় মওদুদ আহমেদ ঠিক তাই। ’ (জনকণ্ঠ, ১৯ মার্চ ২০১২)
আমি এর আগে মওদুদকে বলেছিলাম বাদুড়পন্থী রাজনীতিবিদ। মামুনের মন্তব্য পড়ে মনে হয়েছে মওদুদের সঙ্গে তুলনা করে নিরীহ বাদুড়কে আমি অপমান করেছি।
মামুনের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গোলাম আযম সম্পর্কে মওদুদের মূল্যায়ন। মওদুদ না জানালে মামুনের মতো আমিও জানতাম না ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া যে সরকার গঠন করেছিলেন তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল নূরুদ্দিন। মামুন এ ধরনের আরও কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছেন মওদুদের বই থেকে, এর জন্য দুই লেখককেই ধন্যবাদ জানাব। মামুন না লিখলে অনেক পাঠকের কাছে মওদুদের এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি অজানা থেকে যেত। তবে জামায়াতের আমীর নির্বাচন সম্পর্কে মওদুদের বই থেকে মামুন যে তারিখ উল্লেখ করেছেন তা ঠিক নয়।
মওদুদ লিখেছেন গোলাম আযম জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে। এ তথ্য সঠিক নয়। সেই সময় পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত গোলাম আযম বাংলাদেশের সংবিধান লংঘন করে জামায়াতের আমীর হয়েছিলেন ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে।
সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর (১৯৯১)-এর দৈনিক সংবাদে। ঘটনাটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, প্রধানতঃ এরই প্রতিবাদে দেশব্যাপী সমালোচনা ও ক্ষোভের যে ঝড় উঠেছিল তারই যৌক্তিক পরিণতি ছিল ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন।
নির্মূল কমিটির প্রধান দাবি ছিল অবিলম্বে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচার করতে হবে। নির্মূল কমিটি গঠনের ঘোষণায় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হয়েছিল সরকার যদি ২৫ মার্চের ভেতর গোলাম আযমের বিচার না করে তাহলে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে তার বিচার করা হবে।
আমার লেখা ‘গণআদালতের পটভূমি’ গ্রন্থটি আরম্ভ হয়েছে এই ঘটনা উল্লেখ করে। ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই গ্রন্থে আমি লিখেছিলাম
‘২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোট্ট এক কলাম সংবাদ বেরিয়েছেজামায়াতে ইসলামীর পাঁচ দিন ব্যাপী মজলিশে শুরার বৈঠকে গোলাম আযমকে দলের আমীর নির্বাচন করা হয়েছে।
গোলাম আযম এই দলের আমীর আগেও ছিলেন। গত একযুগ ধরে তিনি জামায়াতের আমীরগিরি করছিলেন পর্দার আড়ালে থেকে। প্রকাশ্যে কাজ চালাচ্ছিলেন আব্বাস আলী খান, অস্থায়ী আমীর হিসেবে। গোলাম এবার ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন।
একজন পাকিস্তানী নাগরিক, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য যে ব্যক্তি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্ররোচিত করেছিলেন এদেশের রাজনীতিতে ঘোষণা দিয়ে তার যোগদানে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।
সেদিন সকাল দশটার দিকে কর্ণেল জামান টেলিফোন করলেনÑ‘পত্রিকায় খবর দেখেছো?’
জানতাম তিনি কোন খবরের কথা বলছেন। জবাব দিলাম, ‘দেখেছি। ’
‘তুমি কালই কেন্দ্রের জরুরি বৈঠক ডাকো। আমরা এটাকে আনচ্যালেঞ্জড যেতে দিতে পারি না। ’*
নির্মূল কমিটি যারা গঠন করেছিলেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা নন।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের মতো উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে এ বিষয়টি প্রথম থেকেই আমাদের বিবেচনায় ছিল। যে কারণে নির্মূল কমিটি গঠনের প্রথম দশ দিনের ভেতর জামায়াত ছাড়া সকল দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা শেষ করেছিলাম। আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলো প্রথম থেকেই আমাদের কর্মসূচী সমর্থন করেছিল। গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচী সফল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে আমরা ১১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করি।
নির্মূল কমিটি এবং সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তখন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গেও কথা বলেছিলাম।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাসদের কাজী আরেফ আহমেদকে এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কর্মসূচীর সমালোচনা করেছে, যদিও গণআদালতের তহবিলে বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য অর্থপ্রদান করেছিলেন। চট্টগ্রামে ছাত্রদল জাহানারা ইমামের জনসভায় এসে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। জাতীয় পার্টির প্রধান নেতা জেনারেল এরশাদ তখন কারাগারে। জেলের বাইরে দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা তখন মওদুদ আহমেদ, যার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে।
তার কাছে যখন গণআদালতের কর্মসূচীর পক্ষে জাতীয় পার্টির সমর্থন চাইলাম তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি এখন (১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারিতে) বিএনপি সরকারের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। গণআদালত সমর্থন করার অর্থ হচ্ছে জামায়াতের বিরুদ্ধে যাওয়া। আমরা শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে চাই না। তোমরা তোমাদের আন্দোলন নিয়ে এগিয়ে যাও।
আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাদের সমর্থন করব না, বিরোধিতাও করব না।
সমন্বয় কমিটির কোন কোন বাম নেতা বিএনপির সঙ্গে আলোচনার পক্ষে থাকলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার পক্ষে ছিলেন না। মওদুদের বক্তব্যে তারা স্বস্তিবোধ করেছিলেন।
জঙ্গী হামলার আশঙ্কায় গত ১২ মার্চ (২০১২) বিএনপির ঢাকা চলো কর্মসূচী সরকার যেভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে আমি তা সমর্থন করিনি। আগের দিন টেলিভিশনের এক আলোচনায় আমি এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনাও করেছি।
তবে মওদুদ আহমেদ সহ বিএনপির নেতারা যেভাবে সরকারকে তুলোধুনো করেছেন তাদের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে বলেছি। ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কর্মসূচী বানচাল করার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল তা ১২ মার্চের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল। তখন দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধ করে মহাসড়কে কাঁটাতারের বেরিকেড দিয়ে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। আগের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় পাঁচশ মাইকের হর্ণ ঝোলানো হয়েছিল সেগুলো পুলিশ জব্দ করেছিল। ২৬ মার্চ মাইক ছাড়া গণআদালতের রায় ঘোষিত হয়েছিল।
১৪৪ ধারা সহ সকল বাধা উপেক্ষা করে, বেরিকেড ভেঙে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছিলেন। জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়েছিল, যদিও আমরা বলেছিলাম, আমাদের কর্মসূচী সরকারের বিরুদ্ধে নয়। বিএনপি সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সমার্থক বিবেচনা করেছিল।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সারা দেশে সমর্থন ও উত্তেজনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন খবরের কাগজে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিলাম জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সবাই ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে এমন অভূতপূর্ব গণজাগরণ অতীতে কখনও দেখা যায় নি।
গণআদালতের দুদিন আগে সরকার গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছিল। মওদুদ আহমেদ লিখেছেন ১৯৬৪ সালের ‘ফরেনার্স এ্যাক্ট’-এর ৩ নং সেকশন অনুযায়ী সরকার গোলাম আযমকে ১৯৯২-এর ২৪ মার্চ গ্রেফতার করেছিল। অর্থাৎ ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদেশী নাগরিক হিসেবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গোলাম আযম ‘ফরেনার্স এ্যাক্ট’ লংঘন করেছেন ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে, যখন জিয়াউর রহমানের বিএনপি ক্ষমতায় ছিল।
তখনও আমরা তাকে গ্রেফতার করতে বলেছিলাম, করা হয়নি। খালেদা জিয়া প্রথম ক্ষমতায় এলেন ১৯৯১-এর ২০ মার্চ। ফরেনার্স এ্যাক্টে তিনি গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছেন এক বছর পর। এর উদ্দেশ্য ছিল গণআদালতকে কেন্দ্র করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির মতো ধূমায়িত জনতার রুদ্ররোষ থেকে তাকে রক্ষা করা। জামায়াতকে সন্তুষ্ট করার জন্য এরপর খালেদা জিয়া আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
২৫ মার্চ (১৯৯২) এক সরকারি প্রেসনোটে আমাদের সম্পর্কে বলা হয়েছিল
‘সরকার এটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চান যে তথাকথিত গণআদালতের নামে নৈরাজ্য, বিশৃংখলা, সন্ত্রাস ও ঘৃণা সৃষ্টি করে যারা স্বাভাবিক জীবনকে বিঘœ সৃষ্টি করার অসৎ তৎপরতার সঙ্গে জড়িত হবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রেসনোটে বলা হয়, সরকার আশা করেন যে, অধ্যাপক গোলাম আযমকে কেন্দ্র করে বেআইনী তৎপরতার প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন সমাজের সকল সচেতন জনগণ তার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা দেবেন। প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় যে, দেশের আইন অনুযায়ী গোলাম আযমকে গ্রেফতার করেছেন এবং আটক রেখেছেন। এতে বলা হয়, সরকার গত মঙ্গলবার এক প্রেসনোটের মাধ্যমে সংবিধান-বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্যে তথাকথিত গণআদালতের উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকারের এই আহ্বান সত্ত্বেও তথাকথিত গণআদালতের উদ্যোক্তারা গণআদালত নিয়ে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, সরকার এর আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে এই মর্মে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন যে, বেআইনী ও অবৈধ তৎপরতার জন্যে কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে না। কয়েকজন উদ্যোক্তা নোটিশের জবাব দিয়েছেন কিন্তু বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
‘প্রেসনোটে বলা হয়, দেশে বর্তমানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত। এই সরকার দেশে সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘এতে বলা হয়, তথাকথিত গণআদালতে যে কোনো বিচার হলে তা হবে সংবিধান মতে প্রতিষ্ঠিত আদালত ও আইনকে অস্বীকার করা।
’*
এর জবাবে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন
সরকারের সাথে আমাদের কোন সংঘাত নেই। গণআদালত বেআইনী বা সংবিধান পরিপন্থী নয়। গণআদালত প্রচলিত বা সাংবিধানিক কোনো আদালত নয়। জনমত প্রকাশ করা। যাতে সরকার এই জনমতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পারে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে আমরা গণআদালত বসাতে চাই সরকার গণআদালত বানচাল করার জন্য কোনো দুর্বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে না। সরকার যদি গণআদালতের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় তবে তা মোটেও শুভকর হবে না। ’**
এপর গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সমগ্র বিশ্বের নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মওদুদ আহমেদ ও খালেদা জিয়ারা এখন গোলাম আযম সহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিজেদের অবস্থান স্থায়ী করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।