আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামার পরীক্ষা

নাদিয়া জামান মা আর ভাইয়া এই দুজনের যন্ত্রণায় মোটামুটি সারাটা দিনই আহিরকে অস্থির থাকতে হয়। পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম এসব নিয়ে সারাদিনই মা আহিরের পিছে লেগে থাকেন। ভাইয়ার জন্য না পারে নিজের পছন্দ মত কার্টুন দেখতে, না পারে খেলতে, না পারে চেঁচাতে। বাসায় একমাত্র বাবাই হলেন আহিরের সব চেয়ে প্রিয়। শুধুমাত্র বাবার কাছে থাকলেই আহির তার মন মত সব কিছু করতে পারে ।

বকা নেই, ঝকা নেই, নিষেধ নেই কি মজা! কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আহিরের বাবা একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন তাই শুক্রবার ছাড়া বাবাকে কাছে পাওয়া আহিরের জন্য অসাধ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আহির দেখে বাবা অফিসে যাবার জন্য রেডি আর ফেরেন সেই রাত নটায়। আহির মাঝে মাঝে ভাবে , এমন যদি হত মা রোজ সকালে অফিসে চলে যেতেন আর বাবা সারাদিন বাসায় থাকতেন তবেই মজা হত। ভাইয়ার স্কুল যদি দুপুর বারোটার পরিবর্তে বাবার মত রাত নটায় ছুটি হত, তাহলে তো কথাই ছিলনা। আহির যখন একমনে এসব ভাবতে থাকে তখন ই দেখা যায় মা একটা বই তার সামনে খুলে ধরেন পড়ার জন্য অথবা এক গ্লাস দুধ নিয়ে হাজির হন খাওয়ানোর জন্য।

এসব যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবার উপায় নেই । বাবা ছাড়াও আরও একজন অবশ্য আছেন যিনি থিক বাবার মত করেই আহিরের সমস্যা গুলো মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি আহিরের ছোট মামা। মা যেমন আহিরকে শাসনে রাখেন তেমনি মামাকেও বকা ঝকা করেন সুধু। আজ বিকেলেই মামা আসবেন তাই আহির নিজেই মামার থাকার ঘর গুছাতে বুয়াকে সাহায্য করছে । মামা হলেন মজার মানুষ।

গত দু তিন বছর ধরে এই সময়টাতে মামা এসে হাজির হন আহিরদের বাসায়। এই সময় মানে হল এইচ এস সি পরীক্ষার পর। পরীক্ষা দিয়েই মামা ঢাকায় চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করতে । খুব মনোযোগ দিয়ে কোচিং এ আসা যাওয়া করেন কিন্তু এইচ এস সির ফল প্রকাশের পর দেখা যায় মামার রোল নাম্বার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিয়ে অবশ্য মামার কোন চিন্তা নেই।

তিনি আবার নানাবাড়ি ফিরে কলেজে পড়া শুরু করেন। আহির মনে প্রাণে বিশ্বাস করে একদিন ঠিকই পত্রিকায় মামার রোল নাম্বার আসবে। মামার যে কত বুদ্ধি তা আর কেউ না জানলেও আহির জানে। বাবাও এ ব্যাপারে আহিরের সাথে একমত। সুধু মাকেই আহির বোঝাতে পারে না।

মা যখন খালা-মনির সাথে ফোনে কথা বলেন, তখন তো মামার নামটা পর্যন্ত বলেন না। গাধা আর উজবুক ডাকেন মামাকে। এই নিয়েও আহিরের ভীষণ দুঃখ। মামার আসার কথা ছিল বিকেলে কিন্তু দেখা গেলো দুপরেই মামা কাঁধে ব্যাগ আর হাতে কিছু পেট মোটা বই নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। মামার একটা মজার দিক হল তার হাতে সবসময় বই থাকবেই।

টিভি দেখার সময়, খাওয়ার সময়, বাসা থেকে বের হবার সময় এমন কি লুডু খেলের সময় ও হাতে বই ধরা থাকবে। এবার অবশ্য আরও একটা নতুন জিনিস আহির আবিষ্কার করলো আর তা হল মামার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মামাকে দেখেই ভাইয়া প্রথমে একটা হাসি দিল তারপর একটা ভেংচি কেটে নিজের রুমে চলে গেল। নানা-নানুর খোঁজ খবর নিয়ে মা রান্না ঘরে চলে গেলেন। সুধু আহির আর বাবা বসে গল্প করছিল মামার সঙ্গে।

মামা জানালেন তিনি গত এক বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছেন যারা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের বেশির ভাগেরই চোখে চশমা থাকে। তাই এবার ঢাকায় আসার আগেই মামা পাওয়ার ছাড়া একটা মোটা ফ্রেমের চশমা কিনেছেন। ইস! কি বুদ্ধি! আহির অবাক হয়ে যায়। রাতে খাবার টেবিলে যথারীতি মামা চোখে চশমা লাগিয়ে একটা বই হাতে নিয়ে খেতে বসলেন। মা তখন মামাকে বললেন "এবার যে কয়দিন থাকিস আহির তোর কাছেই পড়ুক।

" আহির মনে মনে খুব খুশি কারণ মামার সঙ্গে থাকলে অনেক কিছু শেখা যায়। পরদিন সকালেই আহির তার বই খাতা নিয়ে মামার রুমে হাজির। মামা আহিরেরে বইগুলো দেখে অবাক হয়ে বলেন, কিরে ,তুই ছড়া আর কমিক পড়িস না? ছবি আঁকিস না? আহির বলল মা একদম কমিক পড়তে দেন না আর সামনে ক্লাস ওয়ান এর ভর্তি পরীক্ষা তাই ছবি আঁকাও নিষেধ। আহিরের কথা শুনে মামা খুব ই কষ্ট পেলেন। বললেন তোর গল্পের বই গুলি নিয়ে আসতো।

মামার কাছে আহিরের ট্রেনিং ভালোই চলতে লাগলো। পড়ার বইয়ের ভেতরে নিয়ে কি ভাবে গল্পের বই পড়তে হয় তা মামা সুন্দর করে শিখিয়ে দিলেন। প্রথম প্রথম অবশ্য দুটি বই একসাথে ধরতে আহিরের বেশ কষ্ট হতো কিন্তু এখন আর তেমন সমস্যা হয়না। দুধ খাওয়ার ঝামেলাও মামার বুদ্ধিতে সমাধান হয়ে গেছে। আহিরের রুমের বারান্দায় রাখা ফুলের টবে দুধের গ্লাস উপুড় করে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।

একেবারেই যে মামা আহিরকে পড়ান না তা কিন্তু ঠিক না। বাংলা আর ইংরেজির থেকে অংক ই আহিরের কাছে বেশি কঠিন মনে হয়। বিশেষ করে ইংরেজির 2, বাংলার ২, ইংরেজির 8, বাংলার ৪ এগুলো একদম উলট পালট হয়ে যায়। মামা আহিরকে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের পড়াও বেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। রোজ সকালে কোচিং এ যান।

দুপুরে ফিরে এসে কিছুক্ষণ ঘুমান। তারপর বিকেলে ভাইয়ার সাথে বসে লুডু অথবা দাবা খেলেন এবং সন্ধ্যায় আহিরকে নিয়ে পড়তে বসেন। তখন তার হাতে থাকে একটা মোটা বই এবং তার ভেতরে তিন গোয়েন্দার নতুন কোন ভলিয়্যুম। এভাবে মামার দিন বেশ ভালোই কাটছিল। আর মাত্র দু এক দিনের মধ্যে মামার রেজাল্ট বের হবে কিন্তু আহির এই নিয়ে মামার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখল না।

রেজাল্ট বের হবার দিন ভোরবেলা আহির দেখল মামা বাসায় চারটা পত্রিকা নিয়ে এসেছে। একটাতে বাবা খুঁজবে, একটাতে মা, একটাতে ভাইয়া আর একটাতে আহির খুঁজবে। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে লাগলো আহিরের। এমন একটা কাজ আহিরকে মামা দেবেন সে ভাবতেই পারেনি। আহির বাবার রুমে গিয়ে দেখল বাবা রেজাল্টের পাতার উপর খেলার পাতা রেখে পড়ছেন।

আর ভাইয়া ছোটদের পাতা পড়ছে। আহির নিজের রুমে গিয়ে মামার লিখে দেয়া রোল নাম্বারটা পত্রিকায় খুঁজতে লাগলো। একটা নাম্বারে চোখ আটকে গেল আহিরের, মামার রোল নাম্বার খুঁজে পেয়েছে সে। আহিরের চেঁচামেচিতে সবাই তার রুমে এসে হাজির। কাওকে কিছু বলতে হল না, সবাই বুঝে গেল কি হয়েছে।

মামা এক দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন, ভাইয়া বোকার মত তাকিয়ে রইল আর মা ফোন করে সবাইকে জানাতে লাগলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই মামা ফিরে এলেন। এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট এর এক হাতে চকলেটের বাক্স। বাবাকে কিছুই বলতে হল না, তিনি এরই মধ্যে মিষ্টির প্যাকেট খুলে বসেছেন আর ভাইয়া আহিরের চকলেটের বাক্সের দিকে ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে। মামা আহিরকে কোলে নিয়ে ঘোষণা করলেন, পত্রিকায় মামার রোল নাম্বারটা লাল মার্কার দিয়ে দাগানো হবে তারপর রেজাল্টের পাতার এক কোনায় আহিরের ছবি লাগানো হবে এবং সবশেষে রেজাল্টের পাতাটা বাঁধাই করা হবে।

মামার কথামত মার্কার, আহিরের ছবি, আঠা আর পত্রিকা আনা হল। আহির রোল নাম্বারটা বের করে দিতেই মামা মার্কার দিয়ে তা দাগিয়ে ফেললেন। কিন্তু নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে মামার মুখটা হঠাৎ ভার হয়ে গেল। মামার রোল নাম্বার ছিল ৬৩৪৭৫ আর পত্রিকায় এসেছে 63875 সবই তো ঠিক আছে সুধু "চার" ইংরেজিতে না হয়ে বাংলায় ছাপা হয়েছে। আহিরের যুক্তি শুনে মামা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ততক্ষণে তার চকলেটের বাক্সে ভাইয়া হাত দিয়েছে। সমস্যাটা কোথায় হয়েছে তা বুঝিয়ে বলার পরে আহিরের এত মন খারাপ হল যা আর বলার মত না। পরদিন সকালে আহির দেখল মামার রুম ফাঁকা,সুধু টেবিলে পড়ে আছে সেই মোটা ফ্রেমের চশমা। আহির তার বই খাতা নিয়ে ভাল মেয়ের মত পড়তে বসলো। সে যদি ঠিক মত পড়াশোনা করতো তবে আজ এত বড় ভুল কিছুতেই হত না।

সামনের বছর মামার রোল নাম্বার মিলাতে যেয়ে ভুল করতে চায়না আহির। কিন্তু মামা আবার পরীক্ষা দেবেন কিনা সেটাই সে বুঝতে পারছে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।