মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাঈল বললেন,
‘প্রভু, শাদ্দাদ নামক এক অত্যাচারী শাসক নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবি করে বসলো। যারা তাকে খোদা হিসেবে স্বীকার করতে রাজি হল না, তাদের উপর নেমে এলো নির্যাতন। যখন দেখলো নির্যাতন করে মানুষকে বশে আনা যাচ্ছে না, তখন সে কৌশল পাল্টালো। যুক্তি ও সমঝোতার পথ বেঁছে নিল। তাকে মানতে রাজি নয়-এমন লোকদের ডেকে একত্রে জমা করে বললো,
‘আচ্ছা, তোমরা বলছো আমি তোমাদের খোদা নই।
তোমাদের খোদা অন্য কেউ? সেই অন্যকেউ তোমাদের কী এমন দিতে পারেন যা আমি পারি না?’
তাঁরা জবাব দিলো, ‘আমাদের প্রতিপালক ভাল কাজ করলে এবং তাঁর আঁদেশ-নিষেধ মেনে চললে মৃত্যুর পর বেহেশত দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন?’
শাদ্দাদ বললো, ‘কী আছে তোমাদের বেহেশতে?’
তার সামনে বেহেশতের মোটামুটি একটা বর্ণনা তুলে ধরা হলো। সে বললো,
‘ও আচ্ছা, এই ব্যাপার? এমন বেহেশত তো আমি পৃথিবীতেই তোমাদের বানিয়ে দিতে পারি। ’
পুরোদমে শুরু হল বেহেশত তৈরির প্রস্তুতি। সারা দেশে ঘোষণা দেয়া হল যার ঘরে যা সোনা-দানা আছে, সবগুলো এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। সরকারের এই আদেশ অমান্য করলে মৃত্যুদণ্ড।
দেখতে না দেখতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্বর্ণের স্তুপ তৈরি হয়ে গেলো। তারপর শুরু হল বেহেশত তৈরির আনুষ্ঠানিক কাজ। হাজার হাজার শ্রমিক বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তৈরি করলো বেহেশত। শাদ্দাদের বেহেশত। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যাধুনিক এবং হৃদয় নন্দন একটি উদ্যান, একটি মনজুড়ানো প্রসাদ তৈরি হল।
তারপর...’
একটু থাকলেন আজরাঈল। মাথা নিচু করে কী যেন একটু ভাবলেন।
তারপর বললেন,
‘আল্লাহ, যদি সাহস দেন, তো একটি কথা বলি?’
আল্লাহ সম্মতি দিলেন। আজরাঈল বললেন,
‘প্রভু, আমি আপনার হিসাব বুঝি না। বছরের পর বছর পরিশ্রম করে বেহেশত তৈরি করার পর শাদ্দাদ যখন ব্যাপক আয়োজন করে রওয়ানা করলো তার স্বপ্নের বেহেশত দেখতে, সে যখন তার বেহেশতের প্রধান ফটকে একটি পা দিয়েছে মাত্র, ঠিক তখনি আমাকে আপনি আদেশ করলেন শাদ্দাদকে মেরে ফেলতে।
আমি আপনার আদেশ সাথে সাথেই পালন করলাম প্রভু। তবে হিসাব মিলাতে পারলাম না। ’
আল্লাহ বললেন, ‘কোন্ হিসাব? কেমন হিসাব?’
আজরাঈল বললেন, ‘প্রভু, এমন তো নয় যে, পৃথিবীতে একমাত্র শাদ্দাদই নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। আরো অনেকেই তো এমন ঔদ্বত্ব প্রদর্শন করেছে। আপনি তাদের করতে সুযোগ দিয়েছেন।
আমি একজনের কথা বলছি। তার নাম ছিল মিশরের প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় রামিসাস বা ফেরাউন। সে নিজেকে সবচে’ বড় খোদা বলে ঘোষণা করে বসলো।
লোকেরা তার কাছে গিয়ে বললো, ‘তুমি যদি সত্যিকারের খোদা হয়ে থাকো, তবে তো আকাশ তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা।
ফেরাইন বললো, ‘অবশ্যই আকাশ আমার নিয়ন্ত্রণেই আছে।
’
লোকেরা বললো, ‘তাহলে আমাদের জন্য একটু বৃষ্টির ব্যবস্থা করে দাও তো। যদি তুমি বৃষ্টি দিতে পার, তাহলে বুঝবো তুমি ঠিকই সব’চে বড় খোদা। ’
সে বললো, ‘কবে বৃষ্টি চাই?’
লোকেরা বললো, ‘আগামী কাল। ’
সে বললো, ‘তাই হবে। ’
যে যার বাড়ি চলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
কেবল জেগে রইলো ফেরাউন। রাত যখন গভীর হয়েছে, আড়াইটা/তিনটা হবে, তখন সে উঠে চুপি চুপি চলে গিয়েছিল তূর পাহাড়ের চূঁড়ায়। তারপর উপরদিকে হাত উঠিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেছিল,
‘হে আল্লাহ, হে আকাশের মালিক আল্লাহ, মুখে আমি যাই বলি, যাই দাবি করি, আমি তো জানি তুমিই একমাত্র খোদা। আকাশের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা তো তোমারই হাতে। আমি মেঘ দেব কোত্থেকে? আমার কি সেই ক্ষমতা আছে নাকি? একথা তুমি যেমন জানো, তেমনি আমিও জানি।
কিন্তু লোকদের সামনে তোমার উপর ভরসা করে একটি কথা বলে ফেলেছি। এখন তুমিই কেবল পার আমার ইজ্জত বাঁচাতে।
হে আল্লাহ, মরণের পরে আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিও। শুধু পৃথিবীতে আমাকে বেইজ্জতির হাত থেকে রক্ষা করো। আগামীকাল একটু বৃষ্টি দিয়ে দাও।
’
চোখের পানি ছেড়ে ছেড়ে দো’আ করে সে বাড়ি আসলো। আর পরদিন আপনি ঠিকই বৃষ্টি দিয়ে দিলেন। আপনি ফেরাউনের মত অবাধ্য শাসকের আপনার বিরুদ্ধে ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ পূর্ণ করার ক্ষেত্রে আপনি সাহায্য করলেন অথচ শাদ্দাদকে একটি মুহুর্তও সময় দিলেন না। আমি আপনার হিসাব বুঝতে পারলাম না আল্লাহ। ’
স্রষ্টার মুখে আবারো হাসি ফুটে উঠলো।
তিনি বললেন, ‘তুমি ওসব বুঝবে না আজরাঈল। আমি আমার সৃষ্টদের এত বোঝার ক্ষমতা দেই নি। ততটুকু ক্ষমতাই দিয়েছি, যতটুকু তারা গ্রহণ করতে পারবে। ’
আজরাঈল বললেন, ‘স্যরি আল্লাহ। ’
আল্লাহ বললেন, ‘না ঠিক আছে।
এতে তোমার স্যরি হবার কিছু নেই। আচ্ছা আজরাঈল, অই যে, যে বাচ্চাটিকে সাগরের মধ্যখানে অসহায় অবস্থায় রেখে এসেছিলে, সেই ছেলেটির কী হলো? তুমি কি তার কোনো খোঁজ নিয়েছিলে?’
অপরাধী চোখে তাকালেন আজরাঈল। বিনীতভাবে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন প্রভু। সেটাতো আমার দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। ’
স্রষ্টা বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো, তোমাকে আমি সে দায়িত্ব দেই নি।
সে জন্য সেটা তোমার দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। কিন্তু আমার দায়িত্বের আওতায় পড়ে। তুমি কি সেই ছেলেটির পরবর্তী অবস্থা জানতে চাও?’
আজরাঈল অতি আগ্রহের সাথে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আল্লাহ বললেন-
‘আমি সেই ভাসমান কাঠের টুকরাটিকে নিয়ে ভেড়ালাম এক জঙ্গলের পাশে। অবশ্য সমুদ্রের হাঙর, কুমিররা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো বাচ্চাটির দিকে।
আমি তাদেরকে নিষেধ করে দেওয়ায় ওরা আর শিশুটির গায়ে একটি আচড়ও দেয় নি।
কাঠের টুকরাটি জঙ্গলের পাশে গিয়ে থেমে যাবার পর জঙ্গলের একটি স্ত্রী বাঘকে পাঠিয়ে বাচ্চাটিকে জঙ্গলে নিয়ে আসলাম। বাঘের কোলে বাঘের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো বাচ্চাটি, বাঘের মত সাহসী ও শক্তিশালী হয়ে। একদিন সে বড় হয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সমাজের মানুষের সাথে মিশে গেলো। আমি তাকে রাজত্বও দান করলাম।
আচ্ছা আজরাইল। একটু বলো দেখি, অই অসহায় অবস্থা থেকে শিশুটিকে বাঁচিয়ে এনে বাঘের কোলে লালন পালন করানো, অতঃপর রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পর সে যদি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের স্থলে কৃতঘ্নতা প্রদর্শন করে উল্টো আমাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে, নিজেকে আমার সমকক্ষ দাবি করে বসে, তাহলে তার সাথে আমার কেমন আচরণ করা উচিৎ?’
আজরাঈল বললেন, ‘প্রভু। আমার তো মনে হয় সাথে-সাথেই আমাকে আপনার নির্দেশ দেয়া উচিৎ পৃথিবীর সবচে' যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু নিয়ে ওর কাছে চলে যেতে। এমন অকৃতজ্ঞ নিমকহারামের এই পৃথিবীতে এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। থাকা উচিৎও নয়।
’
স্রষ্টা বললেন, ‘এগজেক্টলি। তবে আমি কিন্তু সাথে সাথে অ্যাকশনে গেলাম না। তাকে আরেকটু ঢিলে দিলাম। বললাম দেখি, আর কী করতে পারে? আর কত অবাধ্যতা করতে পারে। শেষে যখন সে সরাসরি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে আমার সাথে ক্ষমতার প্রদর্শনীর জন্য প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলো, ঠিক তখনি আমি তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে আনলাম।
’
আজরাঈল বললেন, ‘প্রভু, আপনি আমাকে অই বেঈমানটাকে একটু পরিচয় করিয়ে দিলেন না কেন?’
স্রষ্টা বললেন, ‘কেন? তাহলে কী করতে তুমি?’
আজরাঈল বললেন, ‘এত ভয়াবহ কষ্ট ও যন্ত্রণা দিয়ে আমি তার আত্মা বের করে নিয়ে আসতাম যে, এত যন্ত্রণা আর কাউকে দেই নি। ’
‘শোনো আজরাঈল। যার যা প্রাপ্য, আমি তাকে তারচে' বেশি শাস্তি দেই না। ’
আজরাঈল বললেন, ‘স্যরি আল্লাহ। আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।
’
স্রষ্টা বললেন, ‘না না, ঠিক আছে। এখানে তোমার স্যরি বলার কিছু নেই। তুমি আমার প্রতি তোমার আনুগত্যের নির্দশন হিসেবেই এ কথা বলেছো। ’
আজরাঈল জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই নিমকহারামটা কে ছিল প্রভু?’
স্রষ্টা নির্লিপ্তভাবে বললেন, ‘তার নাম হলো- শাদ্দাদ!’
আজরাঈল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
চলবে
সামুতে টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে ৪/৫ দিন লহ ইন করা যায়নি।
কিন্তু ধারাবাহিকটি অন্য ঠিকানায় এগিয়ে চলেছে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার স্বার্থে পর্ব ১০ই থাকলো। মধ্যখানের অংশের প্রতি কারো আগ্রহ থাকলে উনার জন্য
কষ্ট করে অখানে গিয়ে
পড়ে আসার অনুরুধ থাকলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।