আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখের গল্প

আমার কথা সিরিয়াসলি নিয়া বাঁশ খাইলে নিজ দায়িত্বে বাঁশ খাইয়েন

আয়নার সামনে বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। বাসা থেকে কঠিন আইন জারি হয়েছে। যতবার আমি ঐ ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে যাবো,আমাকে সাজগোজ করে যেতে হবে। অবশ্যই এবং অবশ্যই শাড়ি পড়তে হবে। সালোয়ার কামিজ পরে গেলে চলবেনা।

আমার সাজগোজ করতে কখনই খারাপ লাগেনা। আয়নায় নিজেকে পরিপাটি অবস্থায় দেখে আমার ভিতরে একটা আত্মবিশ্বাস কাজ করে। কিন্তু কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য সাজগোজ করতে ভাল লাগে না। পরিস্থিতির চাপে পরে আমাকে এখন সেটাই করতে হচ্ছে। যার সাথে দেখা করার জন্য আমাকে সাজতে হচ্ছে আমি তার বাগদত্তা।

ভদ্রলোকের নাম জাবির আদনান। বয়স ৩১ বছর। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। আমি জানি না,যদি বাবার ব্যবসার হালই ধরতে হবে তাহলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কি দরকার ছিল?আমি সেসব বিষয় নিয়ে অবশ্য তেমন মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ বিয়েটা পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়েছে।

ছেলে সুদর্শন,শিক্ষিত,বাপ-দাদার অনেক টাকা আছে। আমাদের মত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের জন্য এটাতো রাজকপাল। আমার অবশ্য চেহারা ছাড়া তেমন কোনো গুন নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাকে বেজায় রূপবতী করে জগতে পাঠিয়েছেন। এই রূপের কারণেই আমার এত ভাল বিয়ে ঠিক হল।

সৃষ্টিকর্তা্র কাছে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারিনা। আমি আবার আয়নায় নিজেকে দেখি। এতটা রূপবতীদের সাজগোজের প্রয়োজন পরেনা। তবুও উপরের আদেশ বলে কথা!অমান্য করলে ঘোর বিপদ। আমি খুব সাবধানে চোখে আইলাইনার দেয়া শুরু করি।

আইলার দিতে গেলেই আমার হাত কাপে। চোখের চারপাশে কালি ছড়িয়ে যায়। তবে আজ কিভাবে যেন এক টানেই আইলাইনারটা দিয়ে ফেললাম। বেনী খুলে চুলটা ছেড়ে দিলাম। গালে হালকা একটু ব্লাসন ছড়িয়ে দিলাম।

লাল-কালো রঙের শাড়িতে আমাকে এখন স্বর্গের অপ্সরীদের চেয়ে কম কিছু লাগছে না। আমার এই চেহারা-সাজসজ্জা দেখে কে বলবে আমার বাবা একটা বেসরকারী অফিসের তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী? সাজগোজ শেষ করে বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম কালো রঙের টয়োটা দাঁড়িয়ে আছে। জাবির সাহেব তার সাথে দেখা করার আগে গাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে গাড়ি পাঠাতে হবে না,আমি রিক্সায় করেই চলে যেতে পারব। তিনি আমাকে জবাব দিলেন, “সারা জীবন তো রিক্সা আর লোকাল বাসেই চড়েছো।

এখন যেহেতু গাড়িতে চড়ার সুযোগ পেয়েছো-এটা মিস কোরোনা। ” লোকটার কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। কিন্তু ক্ষেপে গেলে চলবেনা। আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিয়েটা কোনোভাবে যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।

আর মাথা গরম করেই বা লাভ কি?কিছুদিন পরে তো ঐ টয়োটার মালিক আমিই হব। তখন চড়াও যা,এখন চড়াও তাই! গাড়িতে উঠে বসতেই একটা মিষ্টি ঘ্রান নাকে এসে লাগে। এসির ঠান্ডা বাতাস আর সাথে এয়ারফ্রেশনারের এই মিষ্টি ঘ্রান নাকে লাগতেই আমার ছোটবোন বন্যার কথা মনে পরে গেল। ও ক্লাস সিক্সে পড়ে। প্রথম দিকে জাবির সাহেবের সাথে দেখা করার সময় ওকে একবার সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম।

গাড়িতে এসির বাতাস আর সাথে এয়ারফ্রেশনারের ঘ্রান পেয়ে সে যেন স্বর্গীয় অনুভূতি পেয়েছিল। বাড়িতে ফিরে সে সেই গল্পই বারবার এরওর কাছে করেছে। এরপর আমি যখনই জাবির সাহেবের সাথে দেখা করতেই যাই বন্যাও আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু আমার সাথে অনাহুত মানুষের আগমন জাবির সাহেবের ঠিক পছন্দ না। বন্যাকে নিয়ে যাওয়ার পরের বার যখন আমাকে আবার তিনি দেখা করতে বললেন তখন সাথে বলে দিলেন যেন আমি একাই আসি।

আমিও একাই গিয়েছি। আমি জানি,ও বাড়ীতে চলে গেলে তারা আর আমাকে এ বাড়ীর সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতে দেবেন না। তাই এখন থেকেই আমি মায়া কমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। জাবির সাহেব যে রেস্টুরেন্টে যেতে বলেছেন সেটা আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে। ঘন্টাখানেক সময় লাগে যেতে।

আমি এই সময়টা বেশ উপভোগ করি। গাড়ীর ভিতব ঠান্ডা বাতাসে বসে বসে বাইরের মানুষজন-কোলাহল দেখার অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। লোকালবাসে ভীড়ের মধ্যে বসে এটা ঠিক উপভোগ করার যায়না। ব্যাপারটা ঠিক এমন যে আমি আলিশান সোফায় বসে বসে এলসিডি মনিটরের টিভিতে কোনো নাটক উপভোগ করছি। জাবির সাহেব আমাকে সবসময় সন্ধ্যায় দেখা করতে বলেন।

শহুরে সন্ধ্যাও যথেষ্ট চমৎকার । রাস্তার সন্ধ্যাবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তার পাশে ফুটপাতে দেখলাম কিছু মেয়ে বসে আছে। অদ্ভুত আচার-আচরণ আর অঙ্গ-ভঙ্গি তাদের। সাথে উৎকট সাজগোজ।

ভদ্রসমাজ এদের কলগার্ল বলে ডাকে। টাকার বদলে মানুষকে ইম্প্রেস করতে এদের জুড়ি নেই। গাড়িটা যায়গা মত চলে এসেছে। আমি রেস্টুরেণ্টের ভিতরে গিয়ে দেখলাম মোমবাতির নিভু-নিভু আলোতে জাবির সাহেব বসে আছেন। লোকটার মুখে কেমন একটা কঠোরতা আছে।

প্রতিদিন আমি গিয়ে প্রথমে তার সামনে দাড়াই। তিনি বসতে বলার পর বসি। কিন্তু আজ আমি তার মুখোমুখি চেয়ারটায় গিয়েই ঘুপ করে বসে পড়লাম। আমার এই বসে পড়ায় জাবির সাহেব কি অবাক হলেন?আমি তার চেহারার দিকে তাকিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করলাম। নাহ,তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।

তিনি এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। সম্ভবত আমার আজকের সাজগোজ খুব বেশী ভাল হয়েছে। -কেমন আছো বৃষ্টি? -জ্বি ভালো। আপনি? -হুম ভালোই! তিনি আমার দিকে মেনুটা ঠেলে দিলেন। -কি খাবে অর্ডার দাও।

-আপনি অর্ডার দিন। আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাব। -কেন তুমি অর্ডার দিলে সমস্যা কি?খাবারের নাম উচ্চারণ করতে কি তোমার কষ্ট হয় নাকি?দেখো বৃষ্টি,আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তোমার লাইফ-স্টাইল বেশ বদলে যাবে। নানান পার্টিতে যেতে হবে। আমি চাই তুমি এখনই সেই সবের উপযোগী হও।

আমি জাবির সাহেবের কথায় আজকে তেমন অপমানিত হলাম না। তার সাথে দেখা করতে আসলেই আমাকে এসব কথা শুনতে হয়। আমি ছোটো ঘরের মেয়ে এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে তিনি কখনই দ্বিধা করেন না। আমি মেনুটা নিয়ে গোটা দশেক আইটেমের অর্ডার দিয়ে বসলাম। এবার জাবির সাহেব কিছুটা অবাক হলেন।

আমি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে বললাম-অবাক হয়েছেন? -কেন? -এই যে এক সাথে এত গুলো খাবারের অর্ডার দিয়েছি? -এতে অবাক হওয়ার কি আছে বলবে? -নেই? -নাহ্। একটু মিডেল ক্লাস মেয়েদের স্বভাব হল মানুষ খশানো বুঝলে?তুমি এতদিন খশাওনি তাতেই আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। -তাই?আপনি দেখছি মেয়েদের ভালই টেস্ট করে দেখেছেন তাহলে! -এভাবে কথা বলছো কেন? -দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না। আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আপনাকে আমার কোনোভাবেই রাগিয়ে দেয়া চলবেনা।

আমি দেখলাম জাবির সাহেব একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা আমার প্রতিদিনের আচরণের সাথে আজকের আচারণ মেলাতে পারছেনা। আমিও কথা না বলে চামচ দিয়ে প্লেটে আস্তে আস্তে বাড়ি মেরে টুনটুন শব্দ করতে লাগলাম। -বৃষ্টি তোমার এই অতি অভিনয়ের কারণ কি বলবে? -দেখুন জাবির সাহেব,আমি আসলে আপনাকে ইম্প্রেস করতে চাচ্ছি। -ফাজলামী করছো নাকি? -ফাজলামী মনে হলে ফাজলামী।

আর এইটুকু অধিকার তো নিশ্চয়ই আমার আছে। তাই না? জাবির সাহেব কোনো কথা বললেন না। আমি তাই আবার বলতে শুরু করলাম। -আসলে জাবির সাহেব,আমি আপনাকে ইম্প্রেস করতে করতে বেশ ক্লান্ত। আমার এখন নিজেকে কলগার্ল মনে হয় বুঝলেন?আপনি নিশ্চয় কলগার্ল চেনেন! কথা বলতে বলতে দেখলাম ওয়েটাররা খাবার নিয়ে হাজির।

খাবার আসতেই আমি নিজের প্লেটে খাবার তুলে খেতে শুরু করলাম। প্রতিদিনের মত আজ আর তার প্লেটে আগে তুলে দিলাম না। -জাবির সাহেব আজকের এই ঘটনার পর নিশ্চয়ই আপনি আমাকে আর বিয়ে করবেন না। আসলে আমিই আজকে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে এসেছি। জাবির সাহেব আমার কথায় বেশ অবাক হলেন।

তিনি ভাবতেও পারেন নি আমি বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে পারব। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন লাথি-গুতো খেয়ে হলেও আমি তার পা ধরে ঝুলে থাকবো। বেচারা খুব কাতর কন্ঠে বললেন-এসব কি বলছো বৃষ্টি? এই প্রথম লোকটার কন্ঠে আমি অনুনয় শুনলাম। -বিয়েটা আসলে ভেঙ্গে না দিয়ে পারছি না। আমার একটা এ্যাফেয়ার আছে বুঝলেন!ছেলেটা আমাকে বেশ ভালবাসে।

আমার লোয়ার মিডেল ক্লাস ফ্যামিলি নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যাথা নেই। অবশ্য সেও আপনার মত তেমন বড়লোক না। আমার কাছে অবশ্য অত বড় লোক ভালোও লাগে না। বড়লোকেরা গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে বোধহয় ট্রফি বানিয়ে শোকেজে সাজিয়ে রাখার জন্য। তাইনা?আমার ওরকম শোপিস হওয়ার ইচ্ছা নেই।

আমি নিজের মত সম্মান নিয়ে থাকতে চাই। আপনি আমার রেজাল্ট হয়ত জানেন না। আমি বেশ ট্যালেণ্ট। আপনার মত বড়লোককে বিয়ে না করলেও হয়তো আমার জীবন থেমে থাকবে না। আমার কথা শুনে জাবির সাহেব কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন।

লোকটাকে বেশ দূর্বল করে দিয়েছি। এরকমটা তার আশাতীত ছিল। অনেকক্ষন পর বললেন -এ্যাফেয়ার থাকার পরও এতদিন দেখা করতে এসেছিলে কেন? -বাসার চাপে এসেছিলাম। বোঝেনই তো আমার পরিবারটা একটু গরীব। আপনার মত বড়লোক দেখে আমার বাবা-মার মাথা ঠিক ছিল না।

আমি জানি এতে আপনার বেশ লস হয়েছে। প্রতিদিন সময় খরচ করে দামী রেস্টুরেন্টে আমার সাথে ডিনার করেছেন। টাকাও খরচ হয়েছে। তবে আমার মত সুন্দরীর সাথে কাটানো সময়টা নিশ্চয়ই আপনার খারাপ কাটেনি। -তাহলে এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন? -জি এটাই ফাইনাল।

আপনি দয়া করে বাসায় আজ ফোন করে বিয়ে ভাঙ্গার খবরটা দিয়ে দেবেন। আর একটা কথা,ডান পাশের টেবিলে একটা সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোক বসে আছে। ওর নাম আশিক। আমি আজ ওর সাথে পালিয়ে বিয়ে বসব। এটাও পারলে বাসায় জানিয়ে দেবেন।

জাবির সাহেব হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছেন না। আমিও আর সময় নষ্ট না করে উঠে দাড়ালাম। পাশের টেবিলে বসে থাকা আশিকও আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আশিক এই কয়েকটা দিন যথেষ্ট চিন্তায় ছিল।

ওকে আর টেনশনে রাখার মানে হয় না। আমি জানি,ও আমাকে কখনও অসুখি করবেনা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।