আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখের মতো কান্না-২

মানুষ সারাদিন যা ভাবে, রাতে সেই ভাবনাগুলো স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। এই ব্যাখ্যাও বাতিল। রুহান এই ধরণের উদ্ভট কোনো চিন্তা-ভাবনা সারাদিন কেন, সারা জীবনেও করে নি। তাহলে স্বপ্নটার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? অস্থির হয়ে উঠলো রুহান। বাকী রাত তাকে নির্ঘুম কাটাতে হলো।

ভোর হবার পর রুহানের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। স্বপ্নটা কাউকে বলা দরকার। এমন কাউকে, যিনি সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। যে কাউকে স্বপ্ন বলা ঠিক না। হিতে বিপরীতও হতে পারে।

আবার নিজের মনগড়া পথে স্বপ্নের ইঙ্গিত ধরে অগ্রসর হলে বিপদও হতে পারে। কিছুদিন আগে একটি বইয়ে তেমন একটি ঘটনার কথা পড়েছে রুহান। ঘটনাটি হল- এক গরীব কাঠুরিয়া স্বপ্নে দেখলো তার পরিচিত এক জঙ্গলের মধ্যখানে আগুনের লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। স্বপ্নটা দেখে ভীষণ ভড়কে গেলো সে! স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য সে গেলো ইবনে সিরীনের কাছে।

ইবনে সিরীন হলেন সম-সাময়িক যুগের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মনোবিজ্ঞানী। ‘স্বপ্ন’ ব্যাপারটির স্বরূপ ও প্রকৃতি নিয়ে একচল্লিশ বছর রিসার্চ করেছেন তিনি। স্বপ্ন বিষয়ে অসংখ্য বইও লিখেছেন। লোকেরা তাকে মিষ্টার সিরীন বলেই বেশি জানে। লোকটি মিষ্টার সিরীনের কাছে যেয়ে বিস্তারিত বলার পর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলেন মিষ্টার সিরীন।

তারপর বললেন, ‘স্বপ্নটা তো তুমি রাতে দেখেছো, তাই না?’ সে বললো, ‘হ্যাঁ। ’ ‘গভীর রাতে?’ ‘হ্যাঁ। ’ ‘এমন স্বপ্ন কি এর আগে কখনো দেখেছো?’ ‘না। ’ ‘স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিলে?’ ‘না। ’ আবারো নিরব হয়ে গেলেন মিষ্টার সিরীন।

তারপর বললেন, ‘ তোমার স্বপ্ন যে ইঙ্গিত বহন করে, তাতে আমি মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছি যে, তোমার ভাগ্য সু-প্রসন্ন হতে চলেছে। ভালকথা, তুমি কি সেই জায়গাটি চিনতে পারবে?’ লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন জায়গা?’ ‘অই যে! যেখানে আগুন দেখেছিলে। ’ লোকটি একটু ভেবে বললো, ‘হ্যাঁ, চিনতে পারবো। ’ মিষ্টার সিরীন বললেন, ‘তাহলে আর দেরি না করে অই জায়গায় চলে যাও। যেখানে আগুনের শিখা দেখেছিলে, এগজেক্ট সেই জায়গাটি খোঁজে বের করবে।

তারপর জায়গাটি খুঁড়তে থাকবে। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা যদি ভুল না করে, তাহলে তোমার সৌভাগ্যের ফুলটি ওখানেই পাপড়ি মেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ’ বিস্মিত হয়ে মিষ্টার সিরীনের দিকে তাকিয়ে রইলো লোকটি। বললো, ‘জনাব, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে অই গভীর জঙ্গলে গিয়ে গর্ত খননের কথা বলছেন?’ কিছুটা বিরক্ত হয়ে মিষ্টার সিরীন বললেন, ‘দেখো ছেলে, সত্যি সত্যি বলা আর মিথ্যে মিথ্যে বলা নিয়ে মাথা ঘামাতে তোমাকে কে বলেছে? তুমি আমাকে তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছো, সেটার উপর ভিত্তি করে আমার জন্য প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিকতা বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি আমার ব্যাখ্যা ও পরামর্শ দিয়েছি।

এখন তোমার ব্যাপার। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি জঙ্গলে যাবে, ইচ্ছা না হলে যাবে না। বাড়ি গিয়ে ডবল কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নাই। ’ লোকটি আর কথা বাড়ালো না।

বাড়ি এসে দুইদিন অনেক ভাবলো। সিরীন সাহেবের কথামত জঙ্গলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। এই সময়ে কি আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক এই পথে পা বাড়ানো উচিৎ? অনেক ভেবে অবশেষে লোকটি কাউকে কিছু না জানিয়ে পা বাড়ালো জঙ্গলের দিকে। রহস্যের সন্ধানে মানুষের কৌতূহল বিজ্ঞান সমর্থিত। এই যুক্তিতে সিরীন সাহেবের পরামর্শের শেষটা দেখে নেয়া যায়।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে স্বপ্নে দেখা জায়গাটা খুঁজে বের করলো সে। তারপর ধুরু ধুরু বুকে কুপ দিলো মাটিতে। দেড় থেকে দুই ফিট গভীরে যাওয়ার পর কুদালের আঘাতে ঠাস করে একটা শব্দ হল। পাথরের সাথে পাথরের ঘর্ষণে যেমন শব্দ হয়, তেমন শব্দ। আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুলো।

কিছুটা ভয় পেয়ে গেল লোকটি। কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। আর আগানো ঠিক হবে কি না ভাবতে লাগলো। পরে সিদ্ধান্ত নিল, ‘যা হবার হবে। কাজটি যখন শুরুই করেছি তখন এর শেষটাও দেখে ছাড়বো।

’ আরো কয়েকটি কুপ দেয়ার পর কী যেন চক্ চক্ করে উঠলো। সাবধানে মাটি সরানোর পর সে যা দেখলো, তাতে তার আক্কেল গুড়–ম অবস্থা! স্বর্ণের একটি টুকরো পড়ে আছে! ওজন দুই তিন কেজির কম হবে না! অতি যত্নে টুকরোটি তুলে আনলো সে। এবং বলাই বাহুল্য এর পর তার দিন বদলে গেলো। বারাক ওবামার চেঞ্জ না। শেখ হাসিনার দিনবদল না।

লোকটির সত্যিকারই দিন বদল হলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গরীব কাঠুরিয়া এই অঞ্চলের অন্যতম বিত্তশালী ব্যক্তিতে পরিণত হল। আর দেখতে না দেখতেই লোকজনও জেনে গেলো কাঠুরিয়ার বিত্তশালী হবার গোপন রহস্য। এটা সেই যুগের গল্প, যখন সভ্যতা খুব একটা উঁচু পর্যায়ের না থাকলেও মানুষের মধ্যে হিংসা ও হিংস্রতা ছিল কম। আর এখনকার মত রাষ্ট্রীয় রেসট্রিকশনও এত কড়া ছিল না, যাতে করে কুঁড়িয়ে পাওয়া স্বর্ণের টুকরোলেক ‘রাষ্ট্রের সম্পদ’ দাবি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে যাবার নাম করে সরকারের প্রভাবশালী কিছু লোক ভাগ করে নিয়ে যাবে।

আর অনুসন্ধান করে স্বর্ণ বের করা লোকটিকে সোনা চোরাচালান মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে জেলের ভেতরে। এই ফাঁকে পাঠককে জানিয়ে রাখি, বর্তমান যুগকে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তখনকার যুগের বিজ্ঞান আরও উন্নত ছিল। হাজার হাজার বছর আগে নির্মিত মিশরের পিরামিডের মমিগুলো কিভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা সেটা বুঝতেও পারছেন না। কাঠুরিয়ার এই ঘটনার কিছুদিন পর এই এলাকার অন্য আরেক লোক প্রায় হুবহু স্বপ্ন দেখলো এবং যথারীতি খুন্তি-কুদাল নিয়ে ছুটে চললো জঙ্গলের দিকে। এমন স্বপ্নের ব্যাখ্যা তো তার জানাই আছে।

সে তার নিশ্চিত সাফল্যের কথা ভেবে আনন্দে প্রায় আত্মহারা হবার উপক্রম। জঙ্গলে গিয়ে মাটি খুড়াখুড়ি শুরু করতে যাবে, ঠিক সেই মুহুর্তে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল বাঘ। আক্রমণ করলো তাকে। লোকটি এমন অতর্কিত হামলার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বাঘের আক্রমণে লোকটি দিশেহারা হয়ে গেল।

রক্তাক্ত অবস্থায় কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হল সে। প্রায় দুই মাস তাকে কাটাতে হল হাসপাতালে। দুই মাস পর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সে গেলো সিরীন সাহেবের কাছে। গিয়ে কৈফিয়ৎ তলবের সুরে বললো- ‘স্বপ্নের কেমন ব্যাখ্যা শিখেছেন আপনি?’ তিনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে? ‘কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন না?’ মিষ্টার সিরীন ইতস্তত করে তাকালেন লোকটির দিকে। পঁচিশ/ ছাব্বিশ হবে বয়স।

সুঠাম দেহ। দাড়ি রাখেও নি আবার দীর্ঘদিন সেভও করে নি বলে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যান্ডেজ দিয়ে প্যাঁছানো। মিষ্টার সিরীন বললেন, ‘কে আপনি? আর আপনার এ অবস্থা হল কেমন করে?’ লোকটি বললো, ‘আপনার বাতলানো ব্যাখ্যার কারণেই তো আজ আমার এই দুর্গতি। ’ লোকটি তার ব্যান্ডেজ দেখালো।

সিরীন বললেন, ‘কিন্তু কই! আমি আপনাকে চিনতে পারছি না কেন? কখনো দেখেছি বলেও তো মনে করতে পারছি না। আর আমি আপনাকে কী ব্যাখ্যা দিলাম আর কখনই বা দিলাম, যার কারণে আপনি বলছেন আপনার এই করুণ অবস্থা। ’ লোকটি তখন পুরো ঘটনা খুলে বললো। বললো, ‘আমার পাশে গ্রামের একলোক একই স্বপ্ন দেখেছিল। তাকে আপনি পরামর্শ দিয়েছিলেন জঙ্গলে গিয়ে মাটি খুঁড়তে।

সে আপনার কথামতই কাজ করেছে। আর আজ সে এই অঞ্চলের সবচে' বিত্তশালী লোকে পরিণত হয়েছে। গত দুই মাস আগে আমিও একই স্বপ্ন দেখলাম। যেহেতু স্বপ্ন একই, সুতরাং ব্যাখ্যাও তো অভিন্ন হওয়ার কথা। তাই আমি আপনার ব্যাখ্যা মত জঙ্গলে গিয়েছিলাম।

আর তার পরের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ’ হেসে ফেললেন মিষ্টার সিরীন। লোকটি বললো, ‘আপনি হাসছেন? আমার করুণ কাহিনী শুনে আপনি হাসছেন?’ অনেক চেষ্টা করে হাসি থামিয়ে সিরীন বললেন, ‘স্যরি ভাই, আমি তোমার কাহিনী শুনে হাসছি না। হাসছি তোমার বোকামী আর ব্যাখ্যা ডাইভার্ট করার অবস্থা দেখে। ’ সিরীন সাহেবের মনে লোকটির জন্য মায়া তৈরি হয়ে গেছে।

তিনি তাকে আপন ভাবতে শুরু করেছেন। আর আপনজনদের সাথে তিনি তুমি করেই কথা বলেন। তিনি বললেন- ‘শোনো ছেলে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা বড়ই জটিল একটা ব্যাপার। অনেক দিক বিবেচনায় নিয়েই ব্যাখ্যা করতে লাগে। ভাল কথা, তুমি তো স্বপ্নটা দিনের বেলা দেখেছিলে?’ লোকটি বিস্মিত হয়ে জবাব দিল, ‘জ্বী।

’ ‘আমিও তাই অনুমান করেছিলাম। যা হোক, ভবিষ্যতে কখনো এমন বোকামী করতে যেও না। ’ লোকটি বললো, ‘আমার ক্ষেত্রে স্বপ্নের এই রি-অ্যাকশন হলো কেন?’ সিরীন বললেন, ‘দেখো ছেলে, স্বপ্ন দেখলেই হয় না। দেখতে হয় স্বপ্নটা কে দেখেছে? কীভাবে দেখেছে? কেন দেখেছে? আরো দেখতে হয় পারি-পার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল? মৌসুমের দিকটাও মাথায় রাখতে লাগে। এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তারপর দেখতে হয় স্বপ্নের তিন প্রকারের মধ্যে এই স্বপ্ন কোন পর্যায়ে পড়ে।

তারপরেই কেবল একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। জঙ্গলে আগুনের শিখা দেখতে পাওয়া যে লোককে আমি বলেছিলাম জঙ্গলে চলে যেতে, সেই লোক স্বপ্নটি দেখেছিল রাতে। সময়টা ছিল সম্ভবত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। আবার এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা এর আগে তার মাথায়ও ছিল না। লোকটি আগুন দেখেছিল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।

আর সাধারণত রাতে আর শীতে আগুন মানুষের উপকারী বন্ধু হয়ে থাকে। এই দিক মাথায় রেখে এবং আরো বেশকিছু আনুসাঙ্গিক ব্যাপার বিবেচনা করেই আমি অই লোককে পরামর্শটি দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ...’ হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটি তুলে নিলেন মিষ্টার সিরীন। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেছে তাঁর। বয়স হয়েছে, শরীরের ষ্ট্যামিনা কমে গেছে।

পানি পান করে তিনি বললেন, ‘কিন্তু তুমি তো স্বপ্নটা দেখেছো দিনের বেলা। আবার গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমের মৌসুমে। সঙ্গত কারণেই এই সময় আগুন কারো বন্ধু হয় না। এই সময় সবাই আগুন থেকে দূরে থাকতে চায়। তুমি যদি আমার কাছে আসতে, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে জঙ্গলে যাবার পরামর্শ দিতাম না।

বরং তোমার এমন ইচ্ছার কথা জানলে বাধা দিতাম। ’ লোকটি তার বোকামির কারণে নিজের চুল টানতে লাগলো। রুহানকে অবশ্য ইবনে সিরীন ওরফে মিষ্টার সিরীনের মত কাউকে খুঁজতে যেতে হল না। তার বাবা রায়হান চৌধুরী স্বপ্নের ভাল ব্যাখ্যা করতে পারেন। রুহানদের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি বিশাল আম গাছ আছে।

সকাল ন’টা থেকে এগারটা পর্যন্ত রুহানের বাবা ইজি চেয়ার নিয়ে ওখানে শুয়ার মত বসে থাকেন। গরমের দিনে সকাল ন’টার পর সূর্যের তাপে শরীরে এক ধরণের ফিঙফিঙে জ্বালাপুড়া ভাব অনুভূত হয়। বাবার অই আমগাছতলাটি এই ভাব থেকে মুক্ত। শরীর মন জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতির অটো সিস্টেম এয়ার কন্ডিশন্ড সুবিধা।

রুহান নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো বাবার সামনে। কী যেন একটি বই-এ ডুবেছিলেন রায়হান। বই থেকে মুখ না তুলেই তিনি বললেন, ‘বসো রুহান। ’ রুহান বসলো না। দাঁড়িয়েই থাকলো।

যদিও বাবা তাকে খুব বেশি ভালবাসেন, এটা সে জানে। অনেকটা বন্ধুর মত আচরণ করেন তার সাথে। তারপরও বাবার সামনে বসতে বরাবরই সে জড়তায় ভোগে। পাঁচ-সাত মিনিট এভাবে কেটে যাবার পর রায়হান সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। রুহান এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

আল্লাহপাক তাকে বারোটি ছেলে দিয়েছেন। এদের মধ্যে রুহান ছেলেটি তাঁর সবচে' প্রিয়। আহারে! কী মায়াবী চেহারা! তাকালে শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চায়। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। রায়হান সাহেব হলফ করে বলতে পারেন তাঁর এই ছেলেরচে' সুন্দর কোনো ছেলে জীবনেও দেখেন নি তিনি।

এটা তাঁর নিজের সন্তান বলে নয়, বাস্তবেও তাই। তিনি ছেলেকে বললেন- ‘রুহান, কিছু বলবে?’ মাথা নিচু করে আগের মতই দাঁড়িয়ে রইলো রুহান। চুপ করে। কিছুই বললো না। রায়হান সাহেব আবারো জিজ্ঞেস করলেন- ‘কী হয়েছে রুহান, মা বকেছে?’ রুহান ‘না’ সূচক মাথা নাড়লো।

‘ভাইয়েরা মেরেছে?’ আবারো ডানে-বামে মাথা নাড়লো রুহান। ‘শরীর খারাপ?’ ‘না, বাবা। ’ ‘তাহলে কী হয়েছে? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও। ঠিক?’ রুহান এবারে উপর নিচে মাথা নাড়লো। এর অর্থ সে কিছু বলতে চায়।

রায়হান সাহেব বললেন, ‘বলে ফেলো। ’ ‘ভয় করছে বাবা। ’ ‘ভয়?’ ‘হ্যা, বাবা। ’ ‘কিসের ভয়?’ ‘জানি না। ’ রায়হান সাহেব বললেন, ‘দেখো রুহান, কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো।

খামাখা ভয় পাবার তো কিছু নেই। ’ রুহান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হান সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হাত রাখলেন ছেলের কাঁধে। এই হাত ভরসার, এই হাত নির্ভয়তার, এই হাত নির্ভরতার।

তিনি বললেন, ‘বলো কী হয়েছে?’ রুহান বললো, ‘বাবা, আমি একটা স্বপ্ন দেখি। ’ হেসে উঠলেন রায়হান সাহেব। বললেন, ‘স্বপ্ন তো সবাই দেখে এক মাত্র আল্লাহপাক ছাড়া। আল্লাহ তো কখনো ঘুমান না, তাই আল্লাহর স্বপ্ন দেখার প্রশ্নও উঠে না। এছাড়া সব মানুষই কম-বেশি স্বপ্ন দেখে।

তুমি স্বপ্ন দেখেই ভয় পেয়েছে?’ রুহান বললো, ‘হ্যাঁ বাবা। ’ রায়হান সাহেব হেসে বললেন, ‘পাগল ছেলে। স্বপ্ন দেখে ভয় পাবার কী আছে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্নে কেউ একজন তোমার গলায় ধারালো চাকু ধরলো। সে তোমাকে মেরে ফেলতে চায়।

তুমি চিৎকার করতে চেষ্টা করছো, অথচ গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। তুমি বেঁচে থাকার জন্য ছটফট করছো, তবুও ছাড়া পাবার উপায় দেখছো না। গলাটা কেটে ফেলার জন্য চাকু হাতের লোকটি উদ্যত। যে কোনো মুহুর্তেই সে তোমার গলায় পোঁচ বসাতে পারে। এক সময় সে তোমার গলায় ছুরি চালিয়ে দিল... এটা একটা ভয়ংকর স্বপ্ন।

অথচ এই স্বপ্ন দেখার পরও তুমি জেগে উঠে কিন্তু গলায় ছুরির একটা আচড়ও পাবে না। আচ্ছা রুহান, তোমার স্বপ্নটা কি এরচে’ও ভয়ংকর?’ রুহান বললো, ‘না বাবা। ’ ‘তাহলে ভয় পাবার কী আছে?’ রুহান কিছু না বলে চুপ করে রইলো। রায়হান সাহেব ছেলেকে আদর করে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন- ‘ঠিক আছে রুহান।

বলো কী স্বপ্ন দেখো তুমি? স্বাভাবিক হয়ে বসেই বলো। টেনশন করার তো কোনো কারণ দেখছি না। ’ রুহান তবুও নিরবে দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হান সাহেব লক্ষ্য করলেন রুহান ঘামছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।

পাঞ্জাবীর কোণা দিয়ে আলতো আদরে ছেলের কপালের ঘাম মুছে দিলেন তিনি। ‘বলো রুহান, কী স্বপ্ন দেখো তুমি?’ রুহান বললো, ‘বাবা, আমি একগ্লাস পানি খাবো। ’ রায়হান সাহেব নিজ হাতে জগ থেকে একগ্লাস বরফ শীতল পানি ঢেলে দিলেন গ্লাসে। পানি পান করে রুহান তাকালো বাবার দিকে। রায়হান সাহেব চোখের পাতা আস্তে আস্তে বন্ধ করে আবার খুলে ধরলেন আর একটু মাথা ঝাঁকালেন।

এর অর্থ বলো। রুহান বললেন, ‘বাবা, পরপর তিন রাত একই স্বপ্নটা দেখেছি আমি। ’ রায়হান সাহেব বললেন, ‘প্রথম কবে দেখলে?’ ‘গত পরশু। ’ ‘রাত কত হবে তখন?’ ‘জানি না বাবা, ঘড়ি দেখি নি। ’ ‘ঠিক আছে, বলে যাও।

’ রুহান বললো, ‘দ্বিতীয়বার দেখলাম তার পরের দিন অর্থাৎ গতকাল। আর শেষবার দেখেছি গত রাতে। গতরাতে জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি। তিনটা বাইশ মিনিট। ’ রায়হান সাহেব বললেন, ‘হুবহু একই স্বপ্ন?’ ‘হ্যাঁ, বাবা।

একই স্বপ্ন। ’ ‘কী দেখেছো?’ কিছুটা ইতঃস্থত করলো রুহান। তারপর বললো, ‘বাবা, আমি স্বপ্নে দেখলাম কোনো এক বিস্তির্ণ খোলা মাঠে একাকি দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার সামনে তারকাখচিত একটি আসন। আসনটি কার জন্য-আমার জানা নেই।

চতুর্দিকে সুনসান নিরবতা। হঠাৎ দেখলাম....’ আবার থেমে গেল রুহান। ভরসার চোখে তাকালেন রায়হান। ‘তারপর?’ রুহান বললো, ‘তারপর দেখি আকাশের চন্দ্র সুর্য এবং কয়েকটি তারকা এসে আমার পায়ের সামনে মাথা নত করার মত পড়ে আছে!’ রায়হান সাহেব চমকে উঠলেন? প্রচন্ড ভয় পেয়ে মানুষের চেহারা যেমন দেখায়, রায়হান সাহেবকেও এখন তেমন দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘রুহান, তুমি কি তোমার স্বপ্নের কথা আর কাউকে বলেছো?’ ‘না বাবা।

’ ‘গুড। ভেরি গুড। কাউকে বলার দরকার নেই। বিশেষ করে তোমার ভাইরা যেন না জানে। ’ রুহান অসহায়ের মত তাকালো বাবার দিকে।

পিঠে আলতো করে দু'টো থাবা দিলেন রায়হান সাহেব। বললেন, Dont worry my son, take it easy. রুহান ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে। চলবে সুখের মতো কান্না-১  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।