আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবে গ্রামীনফোন...........সেীজনে্.বণিক বার্তা.....১০, ১১ মার্চ

দেশের শীর্ষস্থানীয় বিলিয়ন ডলারের এক কোম্পানি গ্রামীণফোন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্য ও প্রতারণা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আয়োজন। View this link ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণফোনের লাইসেন্স পেতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের লেটার হেডে মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালির পাশাপাশি তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠকও করেন। ‘গ্রামীণফোন হবে গ্রামের দরিদ্র নারীদের প্রতিষ্ঠান’— প্রধানমন্ত্রীকে এমনটা বোঝাতেও সক্ষম হয়েছিলেন ড. ইউনূস।

দরিদ্র নারীদের উন্নয়নের বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণফোনকে লাইসেন্স দেয়ার নির্দেশ দেন তত্কালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনায় গ্রামীণ কনসোর্টিয়াম অযোগ্য প্রমাণ হলেও নিয়ম লঙ্ঘন করে গ্রামীণফোনকে লাইসেন্স দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এতে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রামীণফোনও লাইসেন্স পেয়ে যায় সেলফোন অপারেটর হিসেবে। এ লাইসেন্স দেয়া নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তার অনুসন্ধানে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন এবং সে সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ বিষয়ে তত্কালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বণিক বার্তাকে বলেন, ওই সময় সেলফোনের লাইসেন্স দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় ও আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। তিনটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মূল্যায়ন কমিটি যাচাই-বাছাই করে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম চূড়ান্ত করে। সেখানে গ্রামীণফোনের নাম ছিল না। তখন ড. ইউনূস তার আন্তর্জাতিক লবি সক্রিয় করেন।

পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হন, তার কোম্পানিকে লাইসেন্স দিলে গ্রামের মানুষ উপকৃত হবে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করে গ্রামীণফোনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিএনপি সরকারের আমলে দেশে দ্বিতীয় দফায় সেলফোন অপারেটরের নতুন লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়।

দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে কারিগরি কমিটি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সক্ষমতা, টেলিযোগাযোগ খাতে সেবাদানের পূর্ব-অভিজ্ঞতা, আর্থিক সক্ষমতা অন্যতম। এরপর সরকারের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাবও চাওয়া হয়। এ সময় আবেদন জমা দেয় টেলিকম মালয়েশিয়া (একটেল), সেবা টেলিকম, টেলেস্ট্রা ও গ্রামীণ কনসোর্টিয়াম। প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদনের সঙ্গে তাদের যোগ্যতার বিস্তারিতও তুলে ধরে।

দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটি এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করে। এতে প্রথম তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল যথাক্রমে একটেল, সেবা ও টেলেস্ট্রা। এর মধ্য থেকে একটেল ও সেবাকে লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। লাইসেন্স দেয়ার নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় কারিগরি ও আর্থিক যোগ্যতার যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল, তার কোনোটিরই মানদণ্ডে গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামের আবেদন যোগ্য বিবেচিত হয়নি। এদিকে লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ার পর শুরু হয় গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামের অন্যতম অংশীদার টেলিনরের দৌড়-ঝাঁপ।

এ ক্ষেত্রে কনসোর্টিয়ামের আরেক অংশীদার ড. ইউনূস ব্যক্তিগত প্রভাব ও সুনাম ব্যবহার করে লাইসেন্স নেয়ার এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। তিনি নিজেও একাধিকবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ড. ইউনূসের উদ্যোগের ফলেই ১৯৯৬ সালে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়ামকেও লাইসেন্স দেয় তত্কালীন সরকার। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের চেয়ারম্যান মামুন উর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়ামের এ দরপত্রে অংশগ্রহণের যোগ্যতা ছিল না। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দরপত্র গ্রহণ করাটাই অবৈধ হয়েছে।

আবার দরপত্রে অংশগ্রহণের সময় ‘গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়াম’ নামে একটি কোম্পানি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ নামে তখন কোনো কোম্পানি ছিল না। অসত্য তথ্য দিয়ে তারা চুক্তি সই করে। লাইসেন্স পাওয়ার আগে তারা মন্ত্রণালয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছে, প্রভাব খাটিয়েছে। এর প্রমাণও রয়েছে।

গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামের নামে লাইসেন্স নেয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার পর আরো একটি অনিয়ম করতে মন্ত্রণালয়কে চাপ দেয় টেলিনর। তারা গ্রামীণফোন লিমিটেডের নামে এ লাইসেন্স দেয়ার জন্য তদবির শুরু করে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ প্রস্তাবে রাজি হননি। সে সময় মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, দরপত্রে যারা অংশগ্রহণ করেছে, শুধু তাদেরই নামে লাইসেন্স দেয়া যাবে। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়ামের নামেই লাইসেন্সটি দেয়া হয়।

তবে ১৯৯৯ সালে তা গ্রামীণফোন লিমিটেড নাম ধারণ করে। গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামের নামে লাইসেন্স নিলেও ১৯৯৬-৯৯ পর্যন্ত গ্রামীণফোন লিমিটেডের নামে ব্যবসা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ গ্রামীণফোনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামীণফোন লিমিটেড গঠন হয় ১৯৯৬ সালের ১০ অক্টোবর। আর একই বছরের ২৮ নভেম্বর লাইসেন্স পায় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ দেশে প্রথম জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন) প্রযুক্তির সেলফোনসেবা চালু করে গ্রামীণফোন।

এ বিষয়ে মামুন উর রশিদ বলেন, এটা সরাসরি কারচুপি। লাইসেন্স পেল এক নামে আর ব্যবসা করল আরেক নামে। সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, ওই চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, এ লাইসেন্স হস্তান্তরযোগ্য নয়। ফলে ১৯৯৯ সালে গ্রামীণফোন লিমিটেডের নামে লাইসেন্স হস্তান্তর করা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশও করা হয়েছে। এদিকে গ্রামীণফোনের প্রতি আস্থা ব্যক্ত করে টেলিনরের এশীয় অঞ্চলের পরিচালক (কমিউনিকেশন্স) গ্লেন ম্যান্ডেলিড বলেন, ‘১৯৯৬ সালে লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন সব ধরনের বাধ্যবাধকতা নিয়মানুযায়ী পূর্ণ করেছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। টেলিনর গ্রুপের সহায়তায় গ্রামীণফোন উন্নয়নের সাফল্য বজায় রেখেছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারকে রাজস্ব প্রদানকারী অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোয় তালিকাভুক্ত সবচেয়ে বড় কোম্পানি।

আর টেলিনর বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। ’ বর্তমান সরকার ও ড. ইউনূসের মধ্যকার বিরোধের কারণে বাংলাদেশে টেলিনরের বিনিয়োগে যে প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়েও সচেতন প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে গ্লেন ম্যান্ডেলিড বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় সরকার স্থানীয় আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চুক্তিও অনুসরণ করবে বলে টেলিনর আশা করছে। আর নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতে গ্রামীণফোন, এর গ্রাহক, কর্মী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় টেলিনর সম্ভাব্য সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেবে। ২য় পর্ব দেশের শীর্ষস্থানীয় বিলিয়ন ডলারের এক কোম্পানি গ্রামীণফোন।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্য ও প্রতারণা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আয়োজন। গ্রামীণফোন সম্পর্কে ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ কেটে যেতে শুরু করেছিল কয়েক বছর আগেই। ইকবাল কাদীর, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা— সবাই যে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানোর জন্য অবদান রেখেছেন, পরবর্তী সময়ে তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে টেলিনর। ইকবাল কাদীর, যিনি ছিলেন এ প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা, বহু আগেই গ্রামীণফোন থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি অযোগ্য একটি কনসোর্টিয়ামকে নিয়ম ভেঙে লাইসেন্স দেয়ার জন্য প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং অনেকটা বিনা পয়সায় রেলওয়ের অপটিক্যাল ফাইবার লাইন ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি তার সে অবদানের স্বীকৃতি দেয়নি।

আর অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বাস করে টেলিনরকে প্রাথমিক অবস্থায় কোম্পানিটি দাঁড় করানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার ভাবনায় ছিল— একসময় এ কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক হবেন গ্রামের দরিদ্র নারীরা। কিন্তু টেলিনরের পুঁজির দাপটে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তিনজনেরই। জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে প্রকল্পের প্রাথমিক ভাবনা দাঁড় করান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারটন থেকে স্নাতক ইকবাল কাদীর; যিনি সে সময় একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। তার ভাবনায় ছিল, সেলফোন হতে পারে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার।

ওই বছরেরই অক্টোবরে তিনি দেশে ফেরেন এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। কিন্তু এর আগে একই বছরের মে মাসে ড. ইউনূস যখন ওহাইওতে সম্মানসূচক ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলেন, তখন ইকবাল কাদীর ড. ইউনূসের কাছে নিজের এ ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ডিসেম্বরে দুজনের আবার দেখা হয়। ইকবাল কাদীর কীভাবে তারবিহীন ফোন বাংলাদেশের উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে পারে, সে চিন্তা বিস্তারিত তুলে ধরেন অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা না করলেও ১৯৯৪ সালে কাদীরের লিখিত পরিকল্পনা পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেন।

কিন্তু প্রাথমিক লগ্নি করার জন্য তেমন আগ্রহ দেখাননি তিনি। তবে কাদীর ছিলেন নাছোড়বান্দা। নিজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে আবারো ফিরে যান নিউইয়র্কে। মার্কিন এক ধনী ব্যক্তিকে বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গণফোন। কিছু অর্থ হাতে আসার পর তিনি ফিনল্যান্ডের টেলিকন কোম্পানিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন।

উদ্দেশ্য ছিল এ পরামর্শক কোম্পানির মাধ্যমে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর সেলফোন অপারেটরদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক স্থাপন। অবশেষে ১৯৯৪ সালের শেষ দিকে তিনি সুইডিশ কোম্পানি টেলিয়া, গণফোন ও গ্রামীণ ব্যাংকের একটি কনসোর্টিয়াম স্থাপনে সফল হলেন। পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ সরকার নতুন লাইসেন্সের জন্য দরপত্র আহ্বান করলেই তাতে অংশ নেয়া। এরপর প্রাথমিকভাবে একটি লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করবে।

পাশাপাশি আরেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে, যারা এ কোম্পানির কাছ থেকে পাইকারি দামে কথা বলার সময় কিনে তা গ্রামের দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রি করবে। অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানের নাম হবে গ্রামীণ টেলিকম। কিন্তু ছয় মাস পর টেলিয়া এ কনসোর্টিয়াম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ইকবাল কাদীর এতে কিছুটা মুষড়ে পড়েন; কিন্তু হাল না ছেড়ে আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন নরডিক অঞ্চলে। তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় এ প্রকল্পে যোগ দিতে রাজি হয় টেলিনর।

কিন্তু পুঁজি জোগানোর লড়াইয়ে টেলিনরের কাছে হার মানে সবাই। প্রাথমিকভাবে কনসোর্টিয়ামে চার অংশীদার ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের বিনিয়োগে একমত হয়। এতে সিংহভাগ ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয় টেলিনর, ৩৫ শতাংশ গ্রামীণ টেলিকম, সাড়ে ৯ শতাংশ জাপানের মারুবিনি আর ৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার দিয়ে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয় ইকবাল কাদীরের গণফোন। এত অল্প শেয়ারে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে জায়গা হয় না তার। তবু দরপত্রের কাগজপত্র জমা দেয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই করতে হয়েছে তাকে।

১৯৯৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি সশরীরে দরপত্র জমা দেন। যদিও সেদিন তার সঙ্গে টেলিনরের কয়েকজন কর্মকর্তা দলিলপত্র জমাদানের সময় উপস্থিত ছিলেন। ছিয়ানব্বইয়ের পট পরিবর্তনে তাদের সব উদ্যোগই ভেস্তে যেতে বসেছিল। যদিও নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরনো দরপত্র বাতিল না করে যথাযথ দলিল যাচাই করে যোগ্য তিনটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়ার জন্য টেলিকমমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ায় অযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল গ্রামীণ কনসোর্টিয়াম।

সে সময় ড. ইউনূস এ লাইসেন্স পেতে ব্যক্তিগত সুনাম ও প্রভাব ব্যবহার করেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকও করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন, অন্য সবাই ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক লাভের জন্য ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু গ্রামীণফোন দরিদ্র ও ভূমিহীন নারীদের জন্য। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে নাড়া দেয়।

লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে তিনি ড. ইউনূসকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। অতঃপর গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামকে লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে টেলিফোনে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ গ্রামীণ যাত্রা করে। যাত্রার প্রথম বছর ৭০ লাখ ও পরের বছর ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার লোকসান হয় গ্রামীণফোনের। শুরু হয় অর্থ জোগাড়ের দৌড়ঝাঁপ।

নিজেদের বিনিয়োগ ১ কোটি ৭৫ লাখ থেকে চার অংশীদার প্রায় ৫ কোটি ডলারে উন্নীত করে। আরো সিদ্ধান্ত হয় গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম ব্যবহার করে আইএফসি, এডিবি ও কমনওয়েলথ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের কাছ থেকে সাড়ে ৫ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার। অধ্যাপক ইউনূস এ প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানোর জন্য হয়ে পড়েন বেপরোয়া। তখন এ ঋণ নিশ্চিত করতে গ্যারান্টি দেয় গ্রামীণ ব্যাংক। ড. ইউনূসের আত্মবিশ্বাস ছিল, উভয়ের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, তাতে পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ টেলিকম ও এর দরিদ্র নারী সদস্যরাই লাভবান হবে।

প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালের পর থেকে সাফল্যের মুখ দেখতে থাকে। সে বছর গ্রামীণফোন ৩০ লাখ ডলার মুনাফা করে। ২০০১ সালে দেশের সেলফোন গ্রাহকের ৬৯ শতাংশই চলে আসে গ্রামীণফোনের দখলে। ২০০২ থেকে ২০০৪— এ সময় একদিকে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে অর্থ জোগাড়ের লড়াই, অন্যদিকে শুরু হয় টেলিনর ও গ্রামীণ টেলিকমের নিয়ন্ত্রণ লড়াই। উভয় লড়াইয়ে ইকবাল কাদীর ও মারুবিনি তাদের অংশের শেয়ার বেচে দিয়ে কোম্পানি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন।

২০০২ থেকে ২০০৪— এ পুরো সময়ে চলে গ্রামীণফোন নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ লড়াই। কিন্তু বিনিয়োগ সক্ষমতা ও দক্ষতার জোরে টেলিনরের সঙ্গে অন্যদের মতো অধ্যাপক ইউনূসকেও হার মানতে হয়। ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে টেলিনরের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, কনসোর্টিয়ামের সমঝোতা চুক্তিতে টেলিনর ছয় বছরের মধ্যে তাদের শেয়ার ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের যেকোনো পক্ষের শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে প্রাথমিক আপত্তি জানানোর অধিকার পাবে গ্রামীণ টেলিকম।

কিন্তু সমঝোতা চুক্তি মেনে শেয়ার ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে অস্বীকৃতি জানায় টেলিনর। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও চিঠি চালাচালি হলেও টেলিনর গ্রামীণফোনের মতো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি। এ বিষয়ে তত্কালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বণিক বার্তাকে বলেন, লাইসেন্স পাওয়ার পর টেলিনর গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামের জনগণের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ড. ইউনূসও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। গ্রামীণফোন গ্রামীণ মানুষের প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

গ্রামীণ মানুষের কোনো কল্যাণে আসেনি প্রতিষ্ঠানটি। গত ১৫ বছরের পুরনো দলিল ও কাগজপত্র পরীক্ষা করে টেলিনরের এসব প্রতারণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন। সে সময় গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সরল বিশ্বাসে। লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় যোগ্যতার বিচারে বাদ পড়েছিল টেলিনর। বাদ পড়ার বিষয়টি জেনে লাইসেন্সের জন্য বিভিন্নভাবে তদবির শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

একসময় সরকার এ দরপত্র বাতিল করারও চিন্তা করে। তখন বিশ্বব্যাংকের সে সময়কার কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রধানমন্ত্রীকে দরপত্র বাতিল না করে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ার অনুরোধ জানান। কমিশনের চেয়ারম্যান মামুন উর রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘টেলিনরের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক ও সরকার সরল বিশ্বাসে চুক্তি করেছিল। কিন্তু সরল বিশ্বাসে তো আর ব্যবসা হয় না। ব্যবসা করতে হলে পাকাপোক্ত চুক্তি লাগে।

চুক্তিতে লেখা ছিল, টেলিনর ১৬ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে। এটা ইউনূস সাহেব দুঃখের সঙ্গে বলেছেন; নরওয়েতে গিয়ে ১৬ শতাংশের জন্য প্রেস কনফারেন্সও করেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু টেলিনর তার অবস্থান থেকে নড়েনি। নামিদামি কোম্পানি বলে তাদের বিশ্বাস করা হয়েছিল। টেলিনর সে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে।

’ তবে কমিশনের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন টেলিনরের এশীয় অঞ্চলের পরিচালক (কমিউনিকেশন্স) গ্লেন ম্যান্ডেলিড। তিনি বলেন, স্থানীয় আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চুক্তিরও সব রীতিনীতি অনুসরণ করেছে টেলিনর। ফলে সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে সংশ্লিষ্ট নয় টেলিনর। এসব বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকম ও অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য জানার জন্য লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব পাননি প্রতিবেদকরা।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.