আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয় কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ। আমাদের নজরুল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক শতসহস্র বছর।

অস্থির এই সময়ে কিছু স্বস্তির সুবাতাস ছড়াতে চাই, আমি ক্রমঃশ আপনারে বিলিয়ে যাই তুমি সুখী হবে বলে... বিদ্রোহী কবি বলছেন- আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন! আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর! আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া। আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন। ” কাজী নজরুল ইসলাম (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬/ মে ২৫, ১৮৯৯ -- ১৪ই ভাদ্র ১৩৮৩/ আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। এই মহান প্রাণ একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। যিনি আজীবন মানুষের অত্যাচার এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, প্রতিবাদ করেছেন।

ইমাম বাবার ছেলে নজরুল জন্মেছিলেন চুরুলিয়া গ্রামে, যেটা আজকের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলে। মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের মাধ্যমে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কিন্তু মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সে প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়, বেঁচে থাকার জন্য নজরুলকে পথে নামতে হয়। দশ বছরের বালক নজরুল তখন মসজিদে মুয়াজ্জিন, মাজারে সেবক, মক্তবে শিক্ষক ইত্যাদি নানা পরিচয়ে জীবিকা অর্জন করেছেন। কিন্তু এসব কাজে তিনি বেশী দিন ছিলেন না, লোকশিল্প তখন তাঁকে হাতছানি দিচ্ছে।

নজরুল গিয়ে লেটো দলে নাম লেখালেন। লেটো দল হচ্ছে- বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল। বাংলার রাঢ় অঞ্চল মানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত একটি বিস্তৃত সমভূমি অঞ্চল। এর সীমানা পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তভাগ থেকে পূর্বে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। সে সময় চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ; সেইসাথে আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষা জানতেন।

শুরু হল নজরুলের একাধিক ভাষার সাথে পরিচয় হওয়ার প্রক্রিয়া। এই সময় থেকেই নজরুলের সাহিত্য চর্চা শুরু, এসময় তিনি এই দলের সাথে অনেক জায়গায় যেতেন, অভিনয় শিখতেন, এবং নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। আশপাশ আর নিজের যোগ্যতায় নজরুল বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য পড়া শুরু করেন, একই সাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহ পড়ার সুযোগ পান। রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ ইত্যাদি তাঁর সেসময়ের রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য লোকসঙ্গীত। ১৯১০ সালে নজরুল স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতা এ যাত্রা তাঁকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পার করে আবার কর্ম জীবনে ফেরত পাঠায়।

প্রথমে যোগ দিলেন বাসুদেবের কবিদলে, তারপর জনৈক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা, অবশেষে আসানসোলের রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ। এখানে পরিচয় হয় আসানসোলের দারোগা রফিজুল্লাহ’র সাথে যিনি নজরুলের প্রতি সদয় হয়ে তাঁকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। নজরুল পরের বছর আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। স্কুলে পড়ার সময় নজরুল চারজন শিক্ষকের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় আড়াই বছরের সৈনিক জীবনে তিনি অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন করাচি সেনানিবাসে, সেখানকার এক পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে ফারসি ভাষা শিখেছেন। সহ-সৈনিকদের সাথে গান ও বাদ্য যন্ত্রের চর্চা করেছেন আর রচনা করেছেন অনেক গদ্য আর পদ্য। তাঁর প্রথম গদ্য- বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী, প্রথম প্রকাশিত কবিতা- মুক্তি, গল্প- হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি করাচি বসেই লেখা। তখন তিনি নিয়মিত কলকাতার বিভিন সাহিত্য পত্রিকা পড়তেন, সাথে কিছু বই জোগাড় করেছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের।

মূলত এসময় থেকেই নজরুলের সাহিত্য জীবন শুরু। সৈনিক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন, ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষে তাঁর রেজিমেন্ট ভেঙ্গে গেলে তিনি সৈনিক জীবনের ইতি টেনে কলকাতা ফিরে যান। কলকাতায় নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। শুরুতে মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়।

এর মধ্যে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতাবোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্‌ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দম্‌ অন্যতম। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় যার প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। সে থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। এসময় কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আফজালুল হক, অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করেন।

তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।

সে বছর তাঁর প্রবন্ধ "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?" প্রকাশের জন্য পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। একইসাথে মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যাওয়ার ফলে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল সেই সাথে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন।

এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"। প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই দেখা হয় প্রমীলা দেবীর সাথে, যার সাথে তাঁর প্রথমে প্রেম ও পরে বিয়ে হয়েছিল।

প্রথমে অবশ্য নজরুলের বিয়ে হয়েছিল আলী আকবর খানের বোন নার্গিস আসার খানমের সাথে, কিন্তু কাবিনের শর্ত নিয়ে বিরোধের ফলে সে বিয়ে বাসর অব্দি গড়ায়নি। তখন অসুস্থ নজরুল গিয়ে ওঠেন বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে এবং সেখানে প্রমিলা দেবী অসুস্থ নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে প্রেম এবং অতঃপর তারা বিয়ে করেন। তখন দেশজুড়ে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, নজরুল তখন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী, তাঁর কাজ হচ্ছে সভায়, মিছিলে গান গাওয়া। এমন এক সময়ে, ১৯২১ সালের শেষ দিকে নজরুল লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি- বিদ্রোহী।

১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ধূমকেতু সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকাকে শুভকামনা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। ’ পত্রিকার প্রথম পাতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথের এই বাণী লেখা থাকতো।

নজরুলের রাজনৈতিক কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হওয়ায় ধূমকেতুর সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। সে বছর ২৩ নভেম্বর তাঁর যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে জবানবন্দী দেন যা বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন- '‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।

... আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...’' বিচারে নজরুলকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তখন বন্দী জীবন কাটছে নজরুলের; সহসা এই সুখবরে তিনি বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে তৎক্ষণাৎ আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন। ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন, সে সময় তাঁকে হোমিওপ্যাথিক ও আয়্যুর্বেদিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ঐ সময় ইয়োরোপে নিয়ে গিয়ে নিউরো সার্জারি করাতে পারলে হয়ত তিনি সুস্থ হয়ে যেতেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেখানে বাঁধা হয়েছিল।

সে বছরের শেষ দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার পর থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কবি এবং কবি পরিবার মোটামুটি ভারতের লোকচক্ষু ও চেতনা থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন, সহসাই নজরুল চিকিৎসা কমিটি গঠিত হওয়ায় কবির চিকিৎসা পুনরায় শুরু হয়। তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জিও নজরুলের চিকিৎসার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেন। প্রথমে কবি ও কবিপত্নীকে পাঠানো হয় রাঁচি’র একটি মানসিক হাসপাতালে। পরের বছর- ১৯৫৩ সালের মে মাসে চিকিৎসার জন্য তাদেরকে লন্ডন পাঠানো হয়, তখনকার প্রখ্যাত চিকিৎসকেরা নজরুলের জন্য বিশেষ মনযোগী হন।

একাজে ব্রিটেন, জার্মানি, ভিয়েনা সহ চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত দেশের ডাক্তারেরা এগিয়ে আসেন। ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফ প্রথমবারের মতো নিশ্চিত হয়ে বলেন নজরুল নিউরন ঘটিত রোগ- ‘পিকস ডিজিজ’ এ আক্রান্ত, যার চিকিৎসা তখনো অনাবিষ্কৃত ছিল। শূন্য হাতে অবশেষে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ নজরুল ও তাঁর সফরসঙ্গীরা ইউরোপ ত্যাগ করে দেশের পথ ধরেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ সালে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারিস্ট কাজী অনিরুদ্ধ মারা যায়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে।

সেই বছর ২৯ আগস্ট তিনি পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কবির লেখা বানী- ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই...’ স্মরণ করে তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা ও সুর করেছিলেন যা নজরুলগীতি বা নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত। নজরুল মূলত কবি ছিলেন, তাঁর লেখনির মূল উপাদান ছিল- ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ, তাঁর রচিত কবিতার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়। ইসলামি সঙ্গীত বা গজল বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অনবদ্য অবদান।

১৯২১ সালে রচিত দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম নজরুলকে নজরুল বানিয়েছিল, বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার পেছনে এই দুটি রচনা বিরাট অবদান রেখেছিল। নজরুল জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় হন বিদ্রোহী কবিতার জন্য; সমসাময়িক আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা। ১৯২২ সালে তার সর্বাধিক বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টি করে, এই অগ্নিবীণা’র হাত ধরেই বাংলা কবিতার জগতে পালাবদল ঘটে।

অগ্নিবীণা’র সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: "প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্‌-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা" ইত্যাদি। ১৯২২ সালে নজরুলের গল্প সংকলন ব্যথার দান প্রকাশিত হয়, একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়। নজরুল অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তিনি ব্যাক্তিগতভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন কিন্তু সেসময় এই দুটি সংগ্রামই ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শের সাথে পরিচিত ছিলেন, তাঁর অনেক লেখায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব উঠে এসেছে।

সমকালীন কামাল পাশা তৎকালীন তুরস্কের মৌলবাদীদের উৎখাত করে যে আধুনিক, ধর্ম নিরপেক্ষ তুরস্ক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছিলেন নজরুল তাতেও বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ১৯২০ এর দশকে নজরুল জাতীয় পরিষদের নির্বাচন করেন। প্রথমে যদিও তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেন, সে চেষ্টা সফল না হওয়ায় স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে নজরুল সফল হতে পারেননি, এরপর থেকে তাঁর রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ কমে যায়, বরং লেখার মাধ্যমেই রাজনৈতিক চিন্তা আরও গভীরে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রতিবাদি কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি।

একজন আমার আগের পোস্টে মন্তব্য করেছেন- ‘...নজরুলীয় গন্ধ পাই মনে হইল। ’ আমি খুব বেশী দিন ধরে লিখছি না, হিসেব করলে দশ বছর চলছে। অনেক পাঠকের অনেক ধরণের মন্তব্য পেয়েছি কিন্তু ব্লগে এসে এত্ত তাড়াতাড়ি এমন কথা শুনবো ভাবিনি। মন্তব্য প্রদানকারী ব্লগার ভাইকে আমার সালাম এবং ধন্যবাদ। আমার লেখাই আজকাল বলে আমি নজরুলের ভক্ত, আমাকে আলাদা করে বলে দিতে হয় না।

প্রিয় কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ। আমাদের নজরুল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক শতসহস্র বছর। তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, এভারগ্রিনবাংলা ছবিঃ ইন্টারনেট ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.