আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে অশনি সংকেত

সুন্দর এক সুখী সমাজ গঠনের ডাক দিয়ে যাই

আমি নিজে গার্মেন্টসে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। তাই এ লেখাটি আমার খুবই ভাল লেগেছে। লেখক খুবই সুন্দর, সহজ ও প্রান্জল ভাষায় গার্মেন্ট শিল্পের একটি আশু দুর্যোগের কথা বলেছেন। লেখককে ধন্যবাদ তার এই ভাল লেখাটির জন্য। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এ বিষয়ে গভীর দৃষ্টিপাত করার জন্য।

মুল লেখাটি - একটি বিষ মাখানো অর্ঘ্য বস্ত্র শিল্প চারটি মৌলিক ও স্বতন্ত্র শিল্পের সমন্বিত রূপ। এর প্রথমটিকে বলা হয় স্পিনিং। এখানে কাপড় বুননের সুতা তৈরি হয়। দ্বিতীয়টিতে চলে কাপড় বুননের কাজ। উইভিং ।

তৃতীয়টিতে বুনন করা কাপড় বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রঙ করা হয়। এর নাম ডায়িং। টেক্সটাইলের চতুর্থ ধাপে চলে পোশাক তৈরির কাজ। এখানে রঙকরা কাপড় শরীরের মাপ অনুযায়ী কাটিং ও সুইং করে পরিধেয় পোশাক তৈরি করা হয়। চতুর্থ এ ধাপই হচ্ছে গার্মেন্টস।

‘তৈরী পোশাক শিল্প’ নামে যা সমধিক পরিচিত। টেক্সটাইল যেহেতু স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও গার্মেন্টস নিয়ে গঠিত, কাজেই এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গৌরবও এ চার সেক্টরের সমন্বিত প্রয়াসের ফল। এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির দরুন গোটা সেক্টরটিই এগিয়ে যাওয়ার বদলে অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। টেক্সটাইল নামক এ মহাশিল্পটি শুরু থেকে যেসব সঙ্কট মাথায় নিয়ে পথ চলছে তা কতকটা লুডুর সাপ-মই খেলার মতো। চারটি খাতের কোনো একটি মইয়ের দেখা পেলে তো আরেকটি পড়ছে সাপের মুখে।

আবার এ পরিস্খিতি উল্টে যেতেও সময় লাগছে না। গড়পরতায় গোটা শিল্পটিই ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। টেক্সটাইল বা বস্ত্রশিল্পটি যখন এজাতীয় সঙ্কটের বোঝা মাথায় নিয়ে পথ চলছে ঠিক সেই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান জিএসপি’র আরোপিত শর্ত তুলে নিয়ে গোটা খাতকে বিষাক্ত সাপের মুখে ঠেলে দিলো। আগে যে কারণে জিএসপি’র ওপর শর্তারোপ করা হয়েছিল, তার কারণ জানা গেলে বিষ দাঁতের সìধান পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে তৈরী করা পোশাক ইউরোপ কিংবা জাপানে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এই শর্তে পাবে যদি এ দেশের স্পিনিং, উইভিং/নিটিং, ডায়িং ও গার্মেন্টসে তা বানানো হয়।

অর্থাৎ সব স্তরের সার্টিফিকেট অব অরিজিন বাংলাদেশের হলে কেবল এ শর্তেই তৈরী করা পোশাকগুলো জিএসপি সুবিধা পেত। সম্প্রতি ইউরোপ ও জাপান এ শর্ত তুলে নেয়। ফলে গার্মেন্টসগুলোর ওপর স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের বাধ্যবাদকতা আর থাকলো না। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে যতটা মধুময় মনে হচ্ছে, এর সুদূরপ্রসারী ফল ততটাই বিষাক্ত। কেননা তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যেন তার গার্মেন্টস খাতকে টেইলারিংয়ের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ না রেখে ফেব্রিক্স অ্যান্ড টেইলার্সের ধারায় দাঁড় করাতে পারে­ এ ধারণা থেকেই রুলস অব অরিজিন নামের শর্তারোপের জন্ম।

এখন সেটি তুলে নেয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, অতীতে যারা শিল্প বিকাশের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছিল এখন এরা বিষয়টিকে সেই ফর্মে দেখতে চায় না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান তাদের আরোপিত শর্ত তুলে নিয়ে আরো একটি সন্দেহের জন্ম দিলো। যেটি আরো ভয়াবহ। বিষয়টি কতকটা গাছে উঠিয়ে দিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার মতো। এখন মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে শিল্প বিকাশের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য জিএসপি’র শর্তকে তারা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছে।

আর এ ফাঁদে পড়ে এ দেশের শিল্পপতিরা গার্মেন্টসকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প হিসেবে ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত স্পিনিং মিল গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যেহেতু আলপিনটিও উৎপাদনে অক্ষম, স্বভাবত এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নত প্রযুক্তির মেশিন কিনতে হয়েছে, যার বেশির ভাগই ইউরোপ ও জাপানের। জিএসপি সুবিধার এ সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে তাদের বানানো মেশিনপত্র দিয়ে পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পকে ঢেলে সাজানোর কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে। এখন এ শিল্পটি সেচুরেটেড পর্যায়ে আছে। উপরন্তু গ্যাস সংযোগের অপ্রতুলতা ও ব্যবসায়ের পরিস্খিতি সঙ্কটময় হওয়ার কারণে নতুন কোনো স্পিনিং মিল গড়ে তোলার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের ভীত শক্ত করানোর ধুয়া তুলে হাজার হাজার কোটি ডলার ও ইউরোর মেশিন বিক্রয়ের পর্ব যখন শেষ এবং নতুন কোনো সম্ভাবনার দুয়ারও যখন আর খোলা নেই, ঠিক তখনই তারা তাদের আরোপিত শর্ত তুলে নিলো। এ কথা প্রাসঙ্গিক, তারা বস্ত্র ব্যবসায় ছেড়ে অস্ত্র ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়েছে অনেক আগেই। এখন লজ্জা নিবারণের দায় চাপিয়েছে আমাদের ওপর। সেটিকে কত কম খরচায় সারিয়ে নেবে এটাই এখন তাদের মূল পলিসি। তাদের এ পলিসি বাস্তবায়নের ভারও চাপিয়েছে আমাদের কাঁধে।

কেননা, এ দেশে উমিচাঁদ ও জগৎ শেঠ গংদের যে অভাব নেই সেই ইতিহাসের সাথে বর্তমান বাস্তবতার যে পুরোপুরি মিল সেটি তারা ভালোভাবেই বুঝে পেয়েছে। শর্তারোপের ফাঁদে ফেলে পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের মেশিন ক্রয়ে বাধ্য করানোর পর শর্ত তুলে নেয়ার বিষয়টি বড় ধরনের প্রতারণার শামিল। গরিব দেশের সাথে এ অবিচার শুধু প্রতারণার পর্যায়েই পড়ে না, তা মানবতা পরিপন্থীও বটে। কিন্তু তারা যাই করুক, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আমাদের। ইউরোপ ও জাপানের জিএসপি’র শর্ত শিথিলায়নের বিষতুল্য এ অর্ঘ্য যদি এ দেশের ব্যবসায়ীসমাজ মেনে নেয়, তবে সেটি হবে লুডুর তিন ধাপ মইয়ের বিনিময়ে বিশাল অজগরের মুখে পড়া।

সময়ে যদি সাবধান হওয়া না যায় তাহলে শিল্প বিকাশের পথে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছিল সাপের এক ছোবলে আবার তা লেজের গোড়ায় এসে পড়বে। কাজেই এ কথা স্পষ্ট, ইউরোপ ও জাপানের দেয়া এ অর্ঘ্য গ্রহণ হবে বিষ গ্রহণের শামিল। গার্মেন্টসের পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্পিনিং মিলগুলোর সুতা ব্যবহার না করে বিদেশ থেকে সুতা আমদানির বিষয়টি হবে এ দেশের লাখ লাখ টন আখ ক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখে চিনিকলের জন্য আখ বিদেশ থেকে আমদানি করার মতো। বাংলাদেশের চটকলগুলো যদি নিজেদের সুতলি ফ্যাক্টরিতে ফেলে রেখে সুতলি বিদেশ থেকে আমদানি করে এবং নীতি নির্ধারকেরা যদি বিষয়টিতে সায় দেন তাহলে এর চেয়ে দু:খজনক বিষয় আর কী হতে পারে। তাই এ দেশের সব ব্যবসায়ীর প্রতি বিনীত অনুরোধ তারা যেন বিষতুল্য এ অর্ঘ্যরে ফাঁদে পা না দেন।

নিট কম্পোজিটের সাথে স্পিনিংয়ের সুতার রেট সংক্রান্ত যে দূরত্ব তা সঠিক নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। কোনো শিল্প টেকসই ভিতের ওপর দাঁড়ানোর পথে বড় অন্তরায় হচ্ছে কাঁচামালের অপ্রতুলতা। এর সহজলভ্যতা কেবল স্বদেশী কাঁচামালই নিশ্চিত করতে পারে। এ বিষয়টির কঠিন ভুক্তভোগী এ দেশের স্পিনিং মিলগুলো। কাঁচামালের জন্য তাদের শতভাগ বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।

এ দুর্বলতাকে কাজে লাগায় দেশী-বিদেশী মাফিয়া চক্র। তাদের ব্যবসায় প্রতিকূল কার্যকলাপের শিকার হয়ে অনেকেই আজ নি:স্বপ্রায়। কাজেই গার্মেন্টস শিল্প যেন বিদেশী কাঁচামালের ফাঁদে পা না দেয় এ জন্য শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ রইল। লেখক : অরবিন্দ রায় একটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সুত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, মে ১৭, ২০১১

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.