পৃথিবীর জীববৈচিত্র হুমকির মধ্যে। জীবাস্ব জ্বালানী দেদারসে পুড়ছে, বায়ুমন্ডলে বাড়ছে কার্বনের মাত্রা। গ্রীণ হাউস গ্যাসের নির্গমনে ওজনের স্তর হালকা হয়ে ফুটো হয়ে যাচ্ছে। সুর্যের ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মিকে আর আটকাতে পারছে না ফুটো হয়ে যাওয়া কিংবা হালকা হয়ে যাওয়া ওজনের স্তর। ওই রশ্মি সরাসরি আসছে আমাদের প্রিয় ধরণীতে।
বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। গলছে মেরু অঞ্চলের রবফ, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বড়ছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো, হ্যারিকেন, সুনামী, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুকি বাড়ছে। পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন, জীবজগৎ হুমকির মধ্যে। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য ক্রমেই অনুপযোগি হয়ে উঠছে পৃথিবী।
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। দেশে মোট নদ নদীর সংখ্যা ছিল ৭ শতাধিক। জালের মত বিস্তৃত শাখা প্রশাখা খাল নালা দিয়ে দেশের প্রায় সব গ্রাম সব এলাকাকে বেধে ফেলেছিল নদী। শহরগুলো গড়েই উঠেছিল নদীকেই কেন্দ্র করেই। নদীই ছিল পরিহবনের প্রধান পথ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নদীপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, ২০১০ সালে তা কমে দাড়িয়েছে বর্ষা মৌসুমে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে এবং শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটারে।
এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, ৭০০টির নদীর মধ্যে ১১৮টি নদী আক্ষরিক অর্থেই মৃত। ৫০০টি নদী মরে যাওয়ার পথে আর ৪০৫টি নদী বেচে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। নদীগুলোর সেই যৌবন নেই, সেই শ্রোতের টানও আর নেই। নদীর অভিধান থেকে মুছে গেছে ’সর্বনাশা’ ’প্রমত্তা’, খরশ্রোতা, ’রাক্ষুসে’ প্রভৃতি শব্দগুলো।
শিল্পবর্জ্যে আর নগর ধোয়া নর্দমার দুষিত কালো জলে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে নদীর টলটলে কিংবা ঘোলা জল। শুষ্ক মৌসুমে দেশের অধিকাংশ নদীর বুকে পানি থাকে না। জলশূন্য এসব নদীতে এখন শাক সবজি ও ধান চাষ করেন চাষীরা। দখল হয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যূদের করাল গ্রাসে। দেশের পদতলে থাকা বিশাল বঙ্গোপসাগর, নদীর শ্রোত বেয়ে আসা দুষিত জলবর্জ্যে সেটিও এখন দুষণের শিকার।
বাংলাদেশের উজানে ভারত সরকারের দেওয়া ফারাক্কা, টিপাইমুখ সহ ৫২টি নদীর মুখের বাধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নদীর দু’পাড়ে সুউচ্চ ওয়াপদা বাধগুলো সবই নদীকে মেরে ফেলার আয়োজন। যোগাযোগের উন্নয়নের নামে চেপে বসসে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সহ বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়ন মডেল। যা দেশীয় জলবায়ু আবহাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশ বিবেচনাই করছে না। নদী মেরে তৈরি হচ্ছে ব্রীজ আর সড়ক যোগাযোগ। স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌছাতে পারছি বটে, তলে তলে যে নদীগুলো মরে যাচ্ছে তা খেয়াল করার সময় নেই।
স্বাভাবিক বন্যার পথ এখন রুদ্ধ। এসব পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন মডেল এদেশের নদী সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে ।
কয়েক দশক আগেও দেশে যে পরিমান বৃষ্টিপাত হত, এখন সে তেমন বৃষ্টির দেখা মেলে না। নদীর মতই খাল বিল ঝিল নালা হাওড় বাওড় পগার পুস্করণী দীঘি প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। চার পাচ দশক আগেও ৭ থেকে ১০ দিন একটানা ভারী বর্ষনের দেখা মিলত।
বাঘ বন্য শুকরের মত প্রাণীর দেখা মিলত গ্রামের ঝোপঝাড়ে জঙ্গলেই। শকুন বেজি গুইসাপ, বাঘডাসা, বনবিড়াল, নেউল, সহ কত শত প্রাণী। এদের অনেকেই এখন বিলুপ্তির খাতায়।
পাকিস্তানের তদানিন্তন সেনা শাসক জেনারেল আইউব খান এক ফরমানে গ্রামের ঝোপঝাড় কেটে পরিস্কার করতে বলেছিলেন। বাঙালী তার ফরমান এখনো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছে।
বাড়ির ঝোপঝাড় পরিস্কার করে সেখানে শোভা পাচ্ছে পরিবেশ বিপর্যায়কারী ইউক্লিপটাস গাছ। এখন নদী আর বৃষ্টির দেশে ভূগর্ভস্থ উৎসের পানির সেচ দিয়ে কৃষিকাজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। নীচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর, দেশ এগুচ্ছে মরুকরণের দিকে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুকি বাড়ছে, সেই সঙ্গে আরসেনিকের ঝুকি। নিজেদের সৃষ্ট বাতাস পানি মাটি ও শব্দ দুষনেই আমাদের বসবাস।
দেশিয় ২৬০টি প্রজাতি মাছের ৬২টি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত। বাকি অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। তদ্রুপ পাখি বন্যপ্রাণী বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। মানুষের মনোভাব এমন যে, যে উদ্ভিদ ও প্রাণী তার প্রয়োজন মেটাতে পারে কিংবা অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, কেবল সেই সেই প্রজাতিগুলোকেই সে টিকিয়ে রাখতে চায়। যেন সেগুলোই টিকে থাকলেই সে খুশি, বাকিগুলো বিলুপ্তি হলে যেন তার কিছু যায় আসে না।
পৃথিবীটা যেন মানুষের একার। সেখানে কারো অধিকার অবস্থান মেনে নিতে নারাজ সে।
এজন্য প্রকৃতি থেকে আহরণযোগ্য সম্পদ ধ্বংস করে কৃত্রিম উপায়ে চাষ করার প্রবণতা বেশি। মানুষ নদী মেরে ফেলে পুকুরে চাষ করে মাছ খেতে চায়। সাগরের জল দুষিত করে পুকুরে ইলিশ চাষের পদ্ধতি আবিস্কারে কারি কারি টাকা ঢালে।
অবাধে আহরণযোগ্য প্রকৃতির এজমালি সম্পত্তি থেকে সাধারণের অধিকার বিছিন্ন করতে চায় বাণিজ্যিক মানুষ। এজন্য নদী পাহাড় বন সাগর দখল করেই ক্ষান্ত নয়, এগুলো ধ্বংস করতে চায়। পরে বাণিজ্যিকভাবে তা আহরণ করে টাকার পাহাড় গড়তে চায় তারা। এতে প্রাণির খাদ্যচক্র ভেঙ্গে পড়ছে, তৈরি হচ্ছে বন্যপ্রাণিদের খাবার সংকট। তারা ক্ষুধার জ্বালায় বন ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।
প্রতিবছর বনে খাবার না পেয়ে হাতির দল লোকালয়ে ছুটে এসে তান্ডব চালাচ্ছে।
কার্বন নির্গমনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে শিল্পোন্নত দেশ, এসব দেশ অবকাঠামোগত দিক থেকে খুবই শক্তিশালী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এইরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া সহ ধনকুবের আরব দেশসমূহ। উন্নতদেশের অবকাঠামো উন্নত হওয়ায় এসবদেশের নাগরিকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে খুবই সুরক্ষিত। অপরদিকে অনুন্নত দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নত নয়, তাই এসব দেশের নাগরিকদের কাপালে জোটে পরাভোগ।
পরিবেশবাদীদের দাবি, জীবজগৎ বাঁচাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ে নিয়ে যেতে হবে। খুবই ন্যায্য দাবি, এর সঙ্গে কোনো বিতর্কই চলে না। কারণ এসব প্রশ্নের সঙ্গে মানুষসহ জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগতের অস্তিস্তে¡ বিষয়টি জড়িত। তাছাড়া আমাদের মতে, জীবনটা শুধু ভোগের নয়, উপভোগের, আনন্দের এবং স্বস্তি¡র। আমরা যদি একমত হই, পৃথিবীকে বাচানো দরকার।
তাহলে এখনি উঠেপড়ে লেগে যেতে হবে। সঠিক পথ এখনি খুজে বের করতে হবে। সময় নস্ট করার সময় নাই। সময় যতই গড়াবে পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে পড়বে। এসময় গেলে আর সাধন হবে না।
সময়ের এক ফোড় আর অসময়ের দশ ফোড়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা কি আদৌ শিল্প বিপ্লবের আগের দশায় ফিরে যাওয়া সম্ভব ? সম্ভব হলে তা কীভাবে ? সেক্ষেত্রে বাধা কি ? এসব প্রশ্নে উত্তর আগে জানা চাই। বলা হয়েছে, এই মুহুর্ত থেকে যদি পৃথিবীর তাবৎ কার্বন নির্গমন বন্ধ করা হলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ওই কাঙ্খিত পর্যায়ে নিতে ৪০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ? জ্বালানী না পুড়িয়ে কী সভ্যতা বাচবে ? প্রযুক্তি ছাড়া তো সভ্যতা অচল, তাহলে আমাদের বাচাঁবে কে ? খাওয়াবে কে ? মানুষ কি দিশেহারা হয়ে যাবে না? আমরা কি বনে ফিরে যাব? প্রযুক্তি ও সভ্যতার ঈশ্বর ছাড়া আমাদের এক মুহুর্তও চলবে না। আবার এই অনিবার্য ঈশ্বরই পৃথিবী ধ্বংসের মূল কারণ।
প্রকৃতি ও ওই অনিবার্য ঈশ্বর এখন মুখোমুখি, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পক্ষে দাড়াবো? প্রকৃতি নাকি প্রযুক্তি ও সভ্যতার অনিবার্য ঈশ্বর? এর ফয়সালার সময় এসেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে শাসকদের ভাবনা, এনজিও-ওয়ালাদের ভাবনা এবং সাধারনের ভাবনার সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। যাাদের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন তাদের কাছ থেকে মুষ্ঠিভিক্ষা নিতে দৃষ্টিকটু কর্ষত করে যাওয়া হল এদেশের শাসকদের ভাবনা। ওই মুষ্ঠিভিক্ষার উচ্ছিষ্ট খেতে কাজ করে যাওয়াটাই হল এনজিও-ওয়ালদের ভাবনা। আমাদের মতে, ওই মুষ্টিভিক্ষা ও তার উচ্ছিষ্ট নিয়ে কামড়া কামড়ি করা উত্তরণের পথ নয়, এতে মধ্যে কোনো সমাধান নেই।
আমাদের মতে, যারা সভ্যতার আলো দেখেনি, লেংটি পড়ে, দামি বন্ত্রে শরীরের সৌন্দর্য ঢাকে না, জ্বালানি পুরিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করতে শেখে নাই এমন মানুষের কাছেই জীবন হল সুখের আনন্দের ও স্বস্তি¡র। সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, সাধারণ বিজ্ঞান সহ যে কোনো বিষয়েই আলোচনায় প্রকৃতির বিষয়টি এখন বিবেচনায় রাখা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সমাধানের রাজপথ ছেড়ে অলিগলি হাটা সমাধান নয়। দায়ীদের কাছে সমাধান খোঁজা, তাদের কাছেই পরিত্রাণ চাওয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না।
আমাদের মতে, এ সংকটের জন্য দায়ী পুজিঁবাদী সভ্যতা, বিশেষত পশ্চিমা পুজিঁবাদী সভ্যতা।
। পুজিঁতন্ত্র শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণ করেই বাচেঁ। এই সভ্যতা মুনাফার ওপর ভর করেই দাঁড়ায়। দুর্নীতি ও লুটপাট তার অনুসঙ্গ। শোষণমূলক মুনাফা ভিত্তিক ও লুটপাটের অনুপুরক রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাই এ সংকটের জন্য যেখানে দায়ী, সেখানে তার কাছে সমাধান সম্ভব নয়।
সমাধানের দায় নিজেদের হাতে তুলে নেয়া শিখতে হবে। এজন্য ওত বই পড়ার দরকার নেই, দরকার সাধারণ কান্ডজ্ঞান।
আমাদের মতে, একটি বিষয়ের ফয়সালা পয়লা করা দরকার, তা হল মানুষ প্রকৃতির প্রভু নাকি সে নিজেই প্রকৃতির অংশ। আমাদের মতে মানুষ প্রকৃতির অংশ, বড় জোড় সচেতন অংশ।
পুজিঁবাদী সভ্যতা মানেই গণহত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধ, সংঘাত, অগ্নিসংযোগ এবং হিংস্রতা।
ওই সভ্যতা মানেই অপ্রেম নিষ্ঠুরতা এবং ভোগবাদ সর্বস্ব বিকৃতি, এক শ্রেণির ওপর আরেক শ্রেণির শোষণ, এক জাতির ওপর আরেক জাতির, এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায়ের আধিপত্য ও নির্যাতন। এই সভ্যতা মানুষকে বিভক্ত করে, শত্রুতা বাড়ায়, পরস্পরের মুখোমুখি করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ সব কিছুর মুলে রয়েছে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা টিকিয়ে রাখতে ওরা সত্য খোঁজে, মিথ্যার আশ্রয় নেয়, সত্যকে মিথ্যা বলে এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালায়। একই কারণে তারা ধর্মকে পদদলিত করে আবার ধর্মের ধ্বজা ধরে রাখে।
সভ্যতা মানেই হল, প্রকৃতির ওপর মানুষের খবরদারি। প্রকৃতির ওপর মানুষের খবরদারি করে ধর্মও টিকে থাকে। ধর্ম হল সেই যুগের সভ্যতা। দীর্ঘদিনের পুরোনো সভ্যতা অন্ধভাবে মানতে গেলে তা ধর্ম হয়ে যায়। পুজিঁবাদী সভ্যতা পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার চেয়ে হাজারগুন শক্তিশালী, এজন্য প্রকৃতির ওপর তার খবরদারি করার ক্ষমতাও হাজারগুন বেশি।
এই খবরদারি করে সে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে। যার কারণে পুজিঁবাদী সভ্যতা মানুষকে পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর করে ফেলে। পুজিঁতান্ত্রিক সভ্যতায় মানুষ প্রযুক্তি ছাড়া অসহায়, প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াইতে অক্ষম। পুজিঁতন্ত্রের কাছে মানুষ হল তার পণ্য ও প্রযুক্তির খরিদদার। সুতরাং মানুষকে প্রযুক্তি নির্ভর প্রাণি হিসেবে তৈরি না করে পুজিঁবাদ টিকে না।
তাই প্রযুক্তি নির্ভরতা তার মন মনন মনস্তত্ত্বে সংস্কৃতিতে আচরণে অভ্যাসে এমনভাবে গেথে দেওয়া হয় যে, যেন প্রযুক্তি ছাড়া তার একমুহুর্তও চলবে না। অথচ মানুষ ভুলে যায়, তার সভ্যতার ইতিহাস মাত্র ৫ হাজার বছরের, তার আগে তথাকথিত প্রযুক্তি ছাড়াই লাখ লাখ বছর টিকে ছিল মানুষ।
প্রকৃতিবন্ধব সভ্য মানুষের জন্য ওত যন্ত্রপাতির দরকার নেই, তার দরকার সবুজ গাছপালা, সুনির্মল হাওয়া ঢেউ তোলা বহতা নদী আর জীবজগতের সঙ্গে সুগভীর মিতালী। প্রকৃতির অংশ হওয়ার মানে হল মহাজগতেও অংশ হওয়া। সেই সঙ্গে তার যত ভালমন্দের অংশিদার হওয়া, তার আনন্দের বেদনার অংশ ভাগ করে নেয়া।
প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতে শেখে সে। প্রভুরূপী মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে প্রকৃতিকে বশ মানাতে চায় আর প্রকৃতিবান্ধব মানুষ তাকে পোষ মানাতে চায়।
শ্রমের উদ্ধৃত্ত্ব শোষণ এবং অবাধ মুনাফা ছাড়া পুজিঁতন্ত্রের অভিধানে আর কোনো শব্দ নাই। ধর্ম দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস নৈতিকতা সাহিত্য নন্দনতত্ত্ব সবকিছুই ওই একটি শব্দের অধীন। মানুষকে মনে করে তার পণ্যের ও সেবার খদ্দের।
তাই জনসংখ্যা যত বাড়বে তার খদ্দের তত বাড়বে। তার পণ্যের কিংবা সেবার খদ্দেরের বাইরে মানুষকে অন্য কিছু বিবেচনা করে না সে। তাছাড়া কারখানার জন্য তো শ্রমিকের দরকার। একজন শ্রমিক মজুরি না পেয়ে, না খেয়ে মারা যাক, তাতে কী তার সন্তানটা অন্তত বেচে থাকুক। কারণ তাতে কারখানার জন্য আরেকজন শ্রমিক জমা থাকল।
সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার তার এত দায় কোথায়? এছাড়া অগ্রসর দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের জনসংখ্যাকে দেখে তার কারখানার কাচামাল (শ্রমিক) হিসেবে। প্রকৃতি ধ্বংস হোক তার কাচামাল চাই। মুনাফা চাই। পণ্যের খদ্দের চাই। নিজেদের ভোগের জন্য বাকিদের মারতে ওদের বুক কাপে না।
বরং তাদের বাঁচানোর নামে আরেক দফা ব্যবসা ফেদে বসে সে। মানুষের দারিদ্রতাকে নিয়ে, কষ্ট নির্যাতন নিয়েও ব্যবসা করে তারা।
প্রকৃতির অংশ হয়ে ওঠা মানুষ প্রকৃতির চক্রক্রমিক ভারসাম্যে তার খাদ্য ও আশ্রয় নিরাপত্তার জায়গাটি খুজে নিতে শেখে। প্রকৃতির চক্রক্রমিক ভারসাম্যে প্রতিটি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রাণির খাদ্য আশ্রয় ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিধানের একটা ক্ষমতা রয়েছে। প্রকৃতি নিজে থেকেই এর মাত্রা নির্ণয় করে দেয়।
প্রকৃতি যে সংখ্যকে নির্ণয় করে দেয়, তার হের ফের করা হলে খোদার ওপর খোদকারি করা হয়। ক মানুষের খাদ্য আশ্রয়ের বিধান দিতে পারে তাকেই আদর্শ মান হিসেবে নিতে হবে। একমাত্র সেই মান বিন্দুতই পণ্যের খদ্দের দশা হওয়া মুক্তি মিলবে। সেই খাদ্য সংকট থেকে চিরতরে মুক্তি মিলবে তার। শিল্প বিপ্লবের আগের পৃথিবীর জনসংখ্যা হল আদর্শ মান হিসেবে ধরা যায়।
ওই সময়ের জনসংখ্যাই প্রকৃতির চক্রক্রমিক ভারসাম্যের বিবেচনায় সিদ্ধ। ওই স্তরেই যেতে হবে মানুষকে। শিল্প বিপ্লবের আগের মানুষ অনেকটাই ছিল প্রকৃতি অংশ হয়ে ওঠা মানুষ। তখনও প্রযুক্তি নির্ভর পুজিতন্ত্রের দাসে পরিণত হতে শেখেনি মানুষ। কারণ তখন পুজিবাদ বিকাশের প্রারম্ভকাল।
এদেশের জনসংখ্য কত ? নি:সন্দেহে ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের (পুর্ববাংলার) জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোিিট। ১৯০১ সালে ২ কোটি, ১৯৫১ সালে ৪ কোটি ৪০ লাখ, ১৯৮১ সালে ৮ কোটি ৭০ লাখ, ২০০০ সালে ১৪ কোটি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৫০ সালে ছিল ১ কোটি, তার দুই শ বছর পর ১৮৫১ সালে এসে দাড়ায় ২ কোটি ৩ লাখ।
১৬৫১ সালে এদেশের জনসংখ্যা ছিল দেড় কোটি, এই এক কোটি জনসংখ্যার ভরণ পোষণের দায় প্রকৃতি নিজে থেকেই নিতে সক্ষম।
বর্তমানে দেড় কোটির বেশি মানুষ এই রাজধানী ঢাকাতেই আছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বাস করে ভারতে, ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ বাস করে চীনে, ওই দু’দেশেই সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া ব্রাজিল পাকিস্তান বাংলাদেশ এবং জাপানের মোট জনসংখ্যার সমতুল্য মানুষ বাস করে ভারতে। ভারতে মোট জনসংখ্যা ১২২ কোটি। বাংলাদেশে প্রতিবর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৯০১ সালে ২১৬ জন, ১৯৫১ সালে ৩১২ জন, ১৯৮৮ সালে ৮২১ জন এবং ২০০০ সালে ১০০০ জন।
অর্থাৎ প্রাচ্যেই বেশির ভাগ মানুষের বাস।
পশ্চিমের দায়, পুবের দায়
পশ্চিমের দায় জিবাস্ব জ্বালানি কমানো আর পুবের দায় জনসংখ্যা কমানো। পশ্চিমকে তার জীবাস্ব জ্বালানি কমাতে কমাতে পর্যায়ক্রমে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এভাবেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লবের আগের স্তরে নামিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবেন তারা। অপরদিকে পুবের দায় হল, তার জনসংখ্যা কমিয়ে শিল্প বিপ্লবের আগের জায়গায় নামিয়ে আনতে হবে।
আমাদের মতে, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, আশ্রয় নিরাপত্তা আর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিধান করার দায় শুধু সমাজের আর রাষ্ট্রের নয়। কাগজে কলমে যতই লেখা থাকুক, নিন্মবর্গের মানুষকে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও আশ্রয়ের অধিকার দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ। বরং রাষ্ট্রকে সেই দায় থেকে মুক্তি দেয়া দরকার। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে ক্ষমতাহীন ও অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে হবে। প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের সমস্যার সমাধান খুজে পেতে শিখতে হবে।
জনসংখ্যা প্রকৃতির ধারণ ক্ষমতার বেশি হলেই ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখনই প্রকৃতির ওপর খবরদারির দরকার হয়। এতে প্রকৃতির চক্রক্রমিকভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে বিযুক্ত করে প্রভু হয়ে ওঠে মানুষ।
খবরদারির ব্যাপারে মানুষের মধ্যেও দুইটি শ্রেণি রয়েছে।
সেখানে একটি শ্রেণিই তাদের খবরদারি বজায় রাখে। প্রকৃতির ওপর খবরদারি করতে গিয়ে মানুষের একটি শ্রেণি নিজ প্রজাতির আরেক শ্রেণির ওপর সেটাই আরোপ করে। খবরদারির সুফল ভোগ করে স্বল্প সংখ্যকেরা। এই স্বল্প সংখ্যকেরা যেমন প্রকৃতির ওপর তেমনি নিজ প্রজাতির অধিকাংশের ওপর তাদের শোষণ আর খবরদারির বিস্তার করে রাখে। তারাই শোষক, নিজেদের বাচাতে এবং প্রকৃতিকে বাচাতে এদের বিরুদ্ধ্ েদাড়ানোর পথ খোজা দরকার।
এদের উচ্ছেদ করা দরকার। প্রকৃতির ওপর ওদের খবরদারির দায় আমাদের মোটেই নেয়া উচিৎ নয়। বিজ্ঞানের কোনো আবিস্কার হল সেই খবরদারির সনদ, তাতে অধিকাংশের ওত উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এত ভোগ বিলাসের এত আয়োজনের অধিকাংশের দরকার নেই। কারণ আমরা জেনেছি, জীবনটা ভোগের নয়, উপভোগের, আনন্দের, সুখের এবং শান্তির।
জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধির, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার। ####
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।