আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবিধান নিয়ে দেশে চলমান সংকট আর গনপরিষদ গঠনের দাবীর যৌক্তিকতা

Set sail, ye hearts~ into the sea of hope..

‘পযান্ডোরার বাক্স’ নামের একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে বাজারে, যার উৎস সেই গ্রীক মিথলজী। একবার দেবরাজ জিউস মানবজাতিকে শায়েস্তা করার জন্যে প্যান্ডোরা নামের এক নারীকে সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টিকালে দেবতাদের কেউ তাকে উপহার দিয়েছেন রূপ, কেউ প্রেম, কেউ আকাঙ্ক্ষা…এসব মানবীয় গুন। সবশেষে এপিমেথিয়াসের সাথে প্যান্ডোরার বিয়ে অনুষ্ঠানের পর জিউস এই নবদম্পতিকে একটি বাক্স উপহার দেন। আর সাথে এটাও বলে দেন যে এই বাক্স যতদিন বন্ধ থাকবে ততদিন তোমরা সুখে শান্তিতে ঘর করতে পারবে।

কিন্তু দেবরাজের উপহার দেখার কৌতূহল সামলাতে না পেরে প্যান্ডোরা এক সময় বাক্সটি খুলে ফেলে। আর তখনি ঘটে যায় বিপত্তি! সেই বাক্সের ভেতর থেকে একে একে বের হয়ে আসতে থাকে অন্যায় আর অনৈতিকতা, খুন, হিংসা, বিদ্বেষ, মিথ্যা সহ মানবজাতির অশান্তির আরও সব উপাদান। সেই থেকেই প্যান্ডোরার বাক্স সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুর সমার্থক হয়ে গেছে। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি প্যান্ডোরার বাক্স খোলা হয়েছে, আর সেই বাক্সটি হলো আমাদের সংবিধান। এর শুরুটা হয়েছিলো পঞ্চম সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে দায়ের করা মামলার রায় নিয়ে, সেই ঐতিহাসিক রায়ে আদালত ১৯৭৬ এর পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত চলা সামরিক শাসন ও জেনারেল জিয়ার আমলে আনা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেন।

এর পর সেটি সহ সংবিধান নিয়ে তিনটি রায়ে আদালত একে একে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তা, ধর্মীয় রাজনীতি, আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন বিষয় আর সবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতামত প্রদান করেছেন। ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট বোধগম্য কারণেই উল্লাসিত এমন একটি সুসময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরে, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়ে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করেছে তারা। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে এটা ভালোই, যে দলটির নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তাদের নেতৃত্বেই দেশ পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এর অনেকটাই বিপরীত। ১৯৭২ সালের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েই সংবিধানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে, তাই যে স্লোগান-ই দেয়া হোক, ১৯৭২ এর সংবিধানে ফেরার পথ নেই।

এছাড়া পরবর্তী সংশোধনীগুলোর ভেতর অনেক যুগোপযোগী আর প্রয়োজনীয় বিষয় আছে, যেগুলো বাদ দেয়া হবে একেবারেই অবাস্তব পদক্ষেপ। আর বিরোধী দলের সম্পৃক্ততাও প্রয়োজন এরকম স্পর্শকাতর একটি কাজে। কিন্তু সরকারের উপর আস্থাহীন বিরোধী দল মিডিয়ার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা কমিটিতে উপস্থিত হবেন না। সোজা কথায় এর অর্থ হলো একপক্ষীয় ভাবেই সব দায়ভার কাঁধে নিয়ে সংশোধনের কাজ করতে হবে সরকারকে। এমনকি ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রস্তাবনার শুরুতে বিসমিল্লাহ সহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় বিএনপি ক্ষমতায় আসলে নিজের মত করে পরিবর্তন করার আগাম ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ।

যদি সরকার এই সংশোধনী নিজে নিজেই করে ফেলে তাহলে কি হবে? বিরোধী দলের মনোভাব তো একটু আগেই উল্লেখ করেছি, আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা অবশ্যই কবুল করবেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের ঘোষণা একেবারেই ফেলনা নয়। গত বিশ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে ক্ষমতা পরিবর্তনের ধারা। তাই ২০০১ সালের মতো দুই-তৃতীয়াংশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসে বিএনপি চাইলে সহজেই আবার পরিবর্তন করতে পারবে এই সংবিধান। তা-ই যদি হয় তাহলে সহসা এই সমস্যার সুরাহা মিলার আশা নেই। হাইকোর্টের এই রায়ের পর থেকে আরেকটি বিতর্ক উঠেছে যে, দেশ এখন কোন সংবিধানে চলছে? পুরনো সংস্করণ বাতিল করেছে স্বয়ং আদালত, এবছর ফেব্রুয়ারিতে পুনর্মুদ্রিত সংবিধান বিতর্কিত হয়েছে আদালতের রায় পাশ কাটিয়ে নতুন সংশোধনী আনার দোষে আর একটি খসড়া সংস্করণ আছে যাকে এখনো কার্যকর করা হয়নি, পরবর্তীতে হয়তো কার্যকর করা হবে।

তাই সভা সমাবেশে যে ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’র কথা শুনছি, সেই অভিযোগকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। তার মানে পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, বর্তমানে দেশে আসলেই কোনও সংবিধান নেই। আর যে খসড়া সংবিধান শীঘ্রই পাশ করা হবে সেটি এতদিন ধরে চলে আসা সংবিধানের মতো হবে না, বরং নতুন করে বিন্যাস করা হবে মৌলিক বেশ কিছু উপাদান। এর সমাধান হিসেবে সাম্প্রতিক কালে আলোচনায় এসেছে একটি গণপরিষদ গঠনের দাবী। যার মূল কথা হলো বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন করতে হবে, যাদের কাজ হবে নতুন করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা।

নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করা হলে পুরনো বিতর্ক গুলো এড়ানো সম্ভব হবে। আর যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণীত হচ্ছে তাই এর গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে প্রশ্নাতীত। আমার মনে হয় এই দাবীটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) নতুন সংবিধানের দাবী তুলেছে, আর বিশেষ কমিটির সঙ্গে সংলাপে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গণপরিষদ গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন, এমনকি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী পর্যন্ত সংশোধনের চিন্তা বাদ দিয়ে কোরআনের আলোকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবী জানিয়েছেন। যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস জনগণ তাই সংবিধানের বিভিন্ন বিষয় জনমতের ভিত্তিতেই রচিত হচ্ছে, অন্তত এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলেও, নির্বাচিত গণপরিষদের দ্বারা নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবী।

ফেসবুক ফ্যানপেজ: ১৯৭২ নয়, ২০১১ সালের সংবিধান চাই (মূল লেখাটি প্রকশিত হয়েছে উইন্ডচাইম ব্লগে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.