খবরে ধান্দাবাজি
মানবসত্ত্বার একটা চিরকালীন দুঃখ আছে। সে দুঃখ থেকেই শিল্পের সৃষ্টি। যে চিত্ত সে দুঃখকে উপলব্ধি করে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করেছে, সে শিল্পী। তাই শিল্পের আরেক নাম প্রকাশ। নিজেকে বা নিজের উপলব্ধিকে প্রকাশই শিল্প।
সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্র, ভাস্কর্য, সিনেমা, নৃত্য, গান, যে কোনো মাধ্যমে এ প্রকাশ ঘটতে পারে। অনেকে বলেন, শিল্প শিল্পীর আনন্দলীলা। কথাটার মধ্যে বড় একটা ফাঁক রয়েছে। শিল্পী শিল্পচর্চা ছাড়া অন্য কাজে আনন্দ পান না, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাই তাকে আনন্দলীলা বলা যৌক্তিক নয়।
শিল্পচর্চার মূলে কারণ হিসেবে কাজ করে দুঃখানুভূতি।
এ দুঃখের আরেক নাম শিল্পীসত্ত্বার দুঃখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বলেছেন, ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন’ (রূপ নারানের কূলে, শেষলেখা)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো রোমান্টিক আশাবাদী কবিও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে হয়েছেন জর্জরিত। আদি কবি বাল্মীকি ক্রৌঞ্চের ব্যথায় সমব্যথী হয়ে বলেছেন, ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমাগতঃ শাশ্বতী সমাঃ।
/ যত ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্’ (ওরে নিষাদ, তুই শাশ্বতকালেও প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না/ তুই ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে কামমোহিত অবস্থায় বধ করেছিস)। বলা হয়, দুঃখই কবিতার জননী। আসলে যে-কোনো শিল্পের মূলে রয়েছে শিল্পীর দুঃখবোধ।
এই যে দুঃখের কথা বলা হচ্ছে, এ কীসের দুঃখ? কেন এ দুঃখ? এ দুঃখ না পাওয়ার বা না পারার। সাময়িক সুখ ব্যক্তিমনে সুখবোধ এনে দিতে পারে না।
একটি স্থায়ী দুঃখবোধ মানবমনকে তাড়িত করে। এই যে সুখস্থিতি না পাওয়ার দুঃখ। বস্তুগত বা অবস্তুগত যে-কোনো বিষয়ে এ না পাওয়ার অনুভূতি আসতে পারে। তবে শিল্পীসত্ত্বার দুঃখ আরেকটু ব্যাপক। সসীম নশ্বর মানবজীবন ছুঁতে চায় ঈশ্বরকে।
জগত-জীবন সম্পর্কের অজানা সব কথা সে জানতে চায়। সে চায় পূর্ণতা। প্রচলিত বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা নিয়ে সে সন্তুষ্ট নয়। সে চায় প্রমাণ। নিজের চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে চায়।
কিন্তু জগত-জীবন-ঈশ্বর সম্বন্ধে মৌলিক কোনো প্রশ্নের উত্তর সে জানতে পারে না। জন্মের আগে বা মৃত্যুর পরের জীবন সম্বন্ধে সে নিশ্চিত কোনো জ্ঞানে পৌঁছতে পারে না। এই যে দুঃখ। এ দুঃখবোধ ব্যক্তিকে শিল্পচর্চায় ধাবিত করে। কৌঞ্চের কান্নার সঙ্গে যুক্ত হয় সীতা-রাবণের দুঃখ।
অযোদ্ধা হয় রামহীন। ঋষি বাল্মীকি হন মহাকবি। রচিত হয় রামায়ণ।
অন্ধকবি হোমার। ক্ষণস্থায়ী নশ্বর মানব জীবনের চিরযন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
পরাজয়ের নানা মাত্রা নিয়ে লিখলেন ট্রয় ধ্বংসের কাহিনী। সফোক্লিসের ব্যক্তিজীবন খুব সুখের ছিল না। নিয়তি ছিল তার বিরূপ। তাই নিয়তির সন্তান হয়েও ইডিপাস অভিশপ্ত। আগেই বলা হয়েছে, নশ্বর মানবাত্মা অসীম ঈশ্বরকে ছুঁতে চায়।
পারে না। না পারার যন্ত্রণায় হৃদয় হয় ক্ষতবিক্ষত। সে তখন মানবাত্মারই জয়গান করে। মানবকেই করে বিকশিত। ইস্কিলাসও এ যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন।
তার প্রমিথিউস আগুন চুরির অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত। একি নিছক আগুন চুরি! নাকি জগত সৃষ্টির কৌশল জানা! সেই প্রমিথিউসকেই শাস্তি থেকে মুক্তি দেন শেলি। তিনি নিরীশ্বরবাদী। তার প্রমিথিউস মুক্ত। নশ্বর মানবাত্মা কর্তৃক অসীম কল্পিত শক্তির পরাজয়।
জগত-জীবন-স্রষ্টাবিষয়ক ভাবনা সক্রেটিসকে করেছিল সংসার উদাসীন। সোফিস্টদের প্রচলিত জ্ঞানচর্চার পথে তিনি না হেঁটে হয়েছেন ভিন্নমতাবলম্বী। সীমাবদ্ধ মানবসত্ত্বার সীমা তাঁর জানা ছিল। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘আমি এটা বুঝি যে, আমি কিছুই জানি না। ’ মহান বিজ্ঞানী নিউটন।
মধ্যাকর্ষণতত্ত্ব নামে আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। কিন্তু, বিশ্বজগতের অনেক বিষয় অজানা রয়ে গেল। নিউটন বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আমাকে কি মনে করে জানি না, কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় আমি এক বাচ্চা ছেলের মতো সমুদ্রতীরে খেলাচ্ছলে মাঝে মধ্যে দুই একটা মসৃণ পাথরেরর টুকরা অথবা দুই একটা সুন্দর ঝিনুক কুড়িয়েছি মাত্র। জ্ঞানের বিরাট সাগর আমার সামনে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। ’
দুঃখ-জরা-মৃত্যু ভাবনায় জর্জরিত রাজপুত্র সিদ্ধার্থ হয়েছেন ধ্যানী গৌতম বুদ্ধ।
সংসার উদাসীন মুসাফির হয়েছেন যিশু খ্রিস্ট। রাখাল বালক হেরা গুহায় ধ্যান করে হয়েছেন হযরত মুহাম্মাদ। তারা সবাই জীবনশিল্পী। জীবনকে বিকশিত করার সবচেয়ে সহজ ও সুন্দর পথ আবিষ্কারই তাদের শিল্প। তাদের আবিষ্কৃত ধর্মীয় পথের অপপ্রয়োগ অনেক সময় মানবধ্বংসের কারণ হয়েছে।
যেমনটি ঘটেছে বিজ্ঞানীদের ।
গৌতমবুদ্ধ আবিষ্কৃত পন্থায় জগত-জীবনের স্বরূপ উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন চর্যাপদের কবিরা। তাদের একজন কাহ্নপা। একটি কবিতায় কাহ্নুপা দুঃখ করে বলেছেন, ‘আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা। / তা দেখি কাহ্নু বিমন ভইলা।
। ’ (চর্যা-৭, অর্থ: জ্ঞানপথ আলো আঁধারে ঢেকে গেছে। তা দেখে কাহ্নুপার মন খারাপ। )সুফিরা অসীম পরমাত্মা তথা স্রষ্টাকে প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করে তার সঙ্গে মিলিত হতে চান। তারা চান ফানাফিল্লাহ বা আল্লাহতে লীন হতে।
জীবাত্মারূপ লাইলি রাতের আঁধারে পরমাত্মারূপ মজনুর কাছে ছুটে আসে। কিন্তু মজনুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। চিরদুঃখী লাইলি মৃত্যুবরণ করে নিঃসঙ্গ। শেখ সাদী জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন জগত-জীবন সম্পর্কে জানতে। ওমর খৈয়াম ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
বিশাল বিশ্বের বিচিত্র রূপ দেখে হয়েছেন বিস্মিত। জানতে চেয়েছেন গূঢ় রহস্য। সবটা জানতে পারেন নি। তাই তারও রয়েছে দুঃখ। তিনি স্থায়ী দুঃখকে ভুলতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিত্য আনন্দের মধ্যে ডুব দিয়েছিলেন, ‘আত্মা আমার খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস/ মুক্ত পাখায় দেবতা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ’।
(১৪, রূবায়াত ই ওমর খৈয়াম, কাজী নজরূল ইসলাম। )
বৈষ্ণবেরাও অসীম ঈশ্বর পরমাত্মা রূপ কৃষ্ণকে পেতে চেয়েছেন। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের ব্যাকুলতায় রাধা চির দুঃখী। একি রাধার দুঃখ নাকি বৈষ্ণবের দুঃখ। বৈষ্ণবেরা বুঝেছিলেন, কৃষ্ণ ধ্যানের চেয়ে মানুষ ধ্যানই সত্য।
চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহে মানুষ ভাই। / সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই॥’ এ কথা মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক্ব’ (আমিই সত্য) তত্ত্বের সমপর্যায়ের। জগত-জীবন-জন্ম-মৃত্যু-ঈশ্বরবিষয়ক ভাবনায় বাউলেরা টালমাতাল। প্রথাগত ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও তার প্রয়োগে হৃদয় ফেটে চৌচির। তারা জটিলতা এড়িয়ে সহজ পথের সন্ধান করেন।
পরম তথা পরমাত্মাকে খুঁজতে গিয়ে বৃথা সময় নষ্ট করেন না। তারা মনে করেন, জীবাত্মা পরমাত্মার মধ্যেই বিদ্যমান। তারা জীবাত্মার স্বরূপ উপলব্ধির চেষ্টা করেন। অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানোর মতোই অবস্থা তাদের। লালনের আর্তি, ‘কথা কয়রে/ দেখা দেয়না।
/ নড়ে চড়ে হাতের কাছে/ খুঁজলে জনম-ভর মেলে না॥’ অথবা রাধার মুখ দিয়ে বিদ্যাপতির উক্তি, ‘এ সখি হামারি/ দুখের নাহি ওর’ (ওগো সখি, আমার দুঃখের সীমা নেই)। আসলে বিদ্যাপতিরও দুঃখের সীমা নেই। মানবাত্মার এই যে দুঃখ, এই যে কান্না। অসীমকে ধরার এই যে আকূতি। মধুসূদনের রাবণে তারই প্রতিফলন।
সে চায় অসীমকে পরাজিত করতে। না পারার দুঃখবোধেই রাবণ পরাজয়ের কাহিনী ‘মেঘনাদবধকাব্য’। এজিদ পরাজয়ের কাহিনি মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’। নোরার আর্তনাদ হেনরিক ইবসেনের ‘পুতুলের সংসার’।
মানবাত্মার চিরকালীন হাহাকারের যথার্থ রূপ দিতে পেরেছেন গ্যেটে।
তাঁর ফাউস্ট দুঃখী ও অস্থির। পূর্ণতা আকাক্সী চিরকালীন মানবাত্মার প্রতীক সে। গ্যেটে দেখালেন মানুষ পূর্ণ অসীম ঈশ্বরত্ব উপলব্ধির জন্য ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রভৃতি মাধ্যমে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। তিনিই প্রথম দেখালেন বিজ্ঞানচর্চার মূলেও রয়েছে মানবাত্মার দুঃখবোধ।
জগত-জীবনের স্বরূপ উপলব্ধির আকাঙা।
শিল্পের যতগুলো মাধ্যম রয়েছে বিজ্ঞান তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক। বিজ্ঞানে জগত-জীবনবিষয়ক গবেষণা চলছে নিরন্তর। দৃশ্যমান উপাদান নিয়েই বিজ্ঞানচর্চা করা হয়। মৃত্যু, জন্মের আগে বা মৃত্যুর পরের অবস্থা, স্রষ্টাবিষয়ক গবেষণা বিজ্ঞানে হয় না বললেই চলে।
যা হয় তা দার্শনিকদের মতো অনুমেয়, প্রমাণীত নয়। গত শতাব্দীর আলোচিত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন। আইনস্টাইনও বিজ্ঞানচর্চা করে পরম তথা অসীমের স্পষ্ট দর্শন লাভ করতে পারেন নি। তিনি একবার বলেছেন, ‘বিজ্ঞানচর্চার চেয়ে পথে পথে বেহালা বাজানো ভালো ছিল। ’
আলবেয়র কাম্যুর ‘দ্য আউটসাইডার’ এবং ফ্রানতয কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ ও ‘প্লেগ’ মানুষের সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বের করুণ ভাষ্য ।
জীবনান্দ দাশের ‘বোধ’ ও ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় এ দুঃখবোধের একটি শিল্পীত রূপ দেওয়া আছে। এ কারণেই জীবনানন্দ দাশ পরজন্মে শঙ্খচিল বা শালিখ হতে চেয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকাথা’র শশী ডাক্তার এ দুঃখেরই পথিক। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’র গায়েন মানবসত্ত্বার চিরকালীন দুঃখের প্রতিনিধি চরিত্র। সে যখন বলে, ‘হায়, জীবন এত ছোট কেনে?/ এ ভুবনে?’ তখনই ভেসে ওঠে তার ভেতরের আসল রূপটি।
আনিসুল হকের ‘আমার একটা দুঃখ আছে’ উপন্যাসের নায়ক গল্পের ফেরিওয়ালার দুঃখ এ দুঃখেরই অংশবিশেষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।