আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভোরের আগে রাত...

অনেকদিন আগে ব্লগটা খুলেছিলাম...অনেক কথা লেখার ছিল...কিন্তু লেখা হয়নি। এখন ভাবছি লিখব...আগেই লেখা উচিত ছিল!

জামিলের রাত... এই রাতের শিফট এলেই জামিলের ইচ্ছে হয় চাকরিটা ছেড়ে দিতে। প্রতি সপ্তাহে দু’দুটো রাত জাগা! দিনে কি আর সেভাবে ঘুম হয়! কিন্তু কি বা করার আছে...হোটেল ম্যানেজম্যান্টে পড়েছে নিজের ইচ্ছায়, হোটেলে কাজ করলে রাতের শিফট করতে হবে এ আর নতুন কি! ওর অবস্থা অনেকটা প্রেম করে বিয়ে করে পচতানো মেয়েদের মতো...না পারে প্রেম ফুরিয়ে গেলে সম্পর্কের বোঝা বইতে, না পারে বাবার বাড়ী গিয়ে বরের বা শ্বশুরবাড়ীর নালিশ করতে। সীমাহীণ যন্ত্রণা! ১১টার একটু আগে শিফটে এসে পিসিতে চোখ বুলিয়ে নেয় জামিল। প্রাণ জুড়োলো! আজ রাত ব্যস্ত যাবে না।

কোন এ্যারাইভাল নেই। আহা কি শান্তি! রাত ১২টা বেজে কুড়ি। আজ এই পাঁচতারা হোটেলের লবি অন্য দিনের চাইতে একদম ফাঁকা। আজ যে শুক্রবার মনেই ছিল না জামিলের, বার বন্ধ...তাই এই নির্জনতা। এত বড় লবিতে মাত্র ছ’জন মানুষ।

রিসিপশনে আছে জামিল আর ফয়সাল। একটু দুরের ডেস্কে আছে ডিউটি ম্যানেজার নাসের, কন্সিয়ারজে আছে নাইট পোর্টার রোজারিও, ওর পাশেই আছে সিকিউরিটি অফিসার। সবাইকে ছাপিয়ে যাকে সবচেইয়ে বেশী দেখা যাচ্ছে, সে রুপোলি পাড়ের গাঢ় ম্যাজেন্টা শাড়ী পরা একটা মেয়ে। জড়োসড়ো বসে আছে কোণার এক সোফায়। দেখতে আহামরি কিছু না, তবে বেশ দেখাচ্ছে মেয়েটিকে, পরিপাটি করে সাজা।

সাথে হ্যান্ড ব্যাগ ছাড়াও আছে ছোট একটা ট্রলি স্যুটকেস। বয়স বোঝা যাচ্ছে না, জামিল কখনোই মেয়েদের বয়স বোঝে না...২৫/২৬ হবে হয়ত! অনেক্ষণ ধরে বসে আছে, সেই শিফটের শুরু থেকে দেখছে জামিল। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে আছে...ফোন করছে কিছুক্ষণ পরপর, চাপা গলায় চলছে কথা, মাঝে মাঝে খানিক উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন...আবার নিরবতা। খানিক বাদে আবার ফোন চাপছে মেয়েটি...কিন্তু তাকে আর কোন কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না। এত রাতে কি আর কেউ ফোন ধরে! সময় ধীরে গড়ালেও থেমে থাকছে না।

এরই মধ্যে রাতের শিফটের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে জামিল আর ফয়সাল। হয়ে গেছে ওদের টী-ব্রেকও। খানিক বাদে রিসিপশনে উঠে এলো মেয়েটা। “ভাইয়া আমার ব্যাগটা একটু দেখবেন?...আমি এই আসছি!” বলে আর দাড়ালো না, শাড়ীর আচঁল, ঠিক করতে করতে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াল মেয়েটা। ডিউটি ম্যানেজার আঁড় চোখে দেখছে মেয়েটাকে...ডেস্ক থেকে ফোন তুলে ফয়সালঅকে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটির কথা।

ফয়সালঃ ব্যাগ দেখতে বলল, বাথরুমে গেছে। আজতো কোন এ্যারাইভালও বাকী নেই! নাসের ভাই দেখেনতো মেয়েটার কেস কি...অনেক্ষণ ধরে বসে আছে... মিনিট পাচেঁক পরে মেয়েটি ফিরে গেল আগের সোফায়। নাসের সিকিউরিটি অফিসারকে আসতে বলল ওয়াকি-টকিতে। সিকিউরিটি অফিসার আসতেই নাসের এগিয়ে গেল... নাসেরঃ “এক্সকিউজ মি ম্যাডাম! আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?” মেয়েটির চোখে বিরক্তি...একটু ঘুরে বসলো কিন্তু কোন কথা বলল না। নাসেরঃ “ম্যাডাম, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি নাসের বলছি, এই হোটেলের ম্যানেজার অন ডিউটি।

এভাবে আসলে লবিতে বসে থাকা যায় না...আপনাকে কি কোন ভাবে হেল্প করতে পারি?” কোন উত্তর নেই। সিকিউরিটি অফিসারঃ “ম্যাডাম, আপনি কি শুনছেন?” “ভাই আপনারা কেন বিরক্ত করছেন? আমি তো কোনো...” ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটি। নাসের, সিকিউরিটি অফিসার দুজনই অপ্রস্তুত! একটু গুছিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রিসিপসনে এগিয়ে এলো মেয়েটি। “ভাইয়া আপনাদের এখানে একরাতের রুম ভাড়া কত?” জামিলঃ “ডিলাক্স রুম ১৭০ ডলার। ভ্যাট, সার্ভিস চার্জসহ ১৯৫ ডলার...” “এতো অনেক...কত হয় টাকায়? এটাই কি সব’চে সস্তা রুম?” ক্যালকুলেটর চেপে জামিল বলল, “জি ম্যাডাম, টাকায় আসছে প্রায় ১৪ হাজার” “অত টাকা...” কি একটু ভাবতেই আবার কেঁদে ফেলল মেয়েটা! নাসের রিসিপসনে এগিয়ে এলো।

জামিলঃ “ম্যাডাম আপনি বসুন। আমি দেখছি কি করা যায়!” মেয়েটি সোফায় ফিরছে আর হাত ব্যাগে কি যেন খুঁজছে...কতো টাকা আছে দেখছে হয়তো! জামিলঃ “নাসের ভাই কি করা যায় বলেনতো! দিস ইস ক্লিয়ার যে রুম নেবার মত টাকা উনার কাছে নেই। আর আমার দেখে মনে হচ্ছে না যে উনি মিথ্যা বলছেন...” নাসেরঃ “এটাই দোষ তোমাদের বয়সের! মেয়েদের চোখের পানি দেখলে আর ঠিক থাকতে পারো না!” জামিলঃ “বাদ দেন ফালতু পেচাল...থিঙ্ক পসিটিভ। এখন কি করা যায় সেটা বলেন। হিউম্যানিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!” নাসেরঃ “হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি।

এখন রুম নিতে না পারলে আমি কি করবো? হাইয়েস্ট ৪৫ ডলার কমাতে পারি...কিন্তু আমার মনে হচ্ছে না উনি সেটাও এ্যাফোর্ট করতে পারবেন!” জামিলঃ “কিন্তু মেয়েটাকে তো সকাল পর্যন্ত বসে থাকতে দেয়া যেতে পারে, তাই না? এত রাতে আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারি না যে রুম না নিতে পারলে বেরিয়ে যান!” নাসের একবার জামিলের দিকে তাকালো...কি যেন ভাবল...সিকিউরিটি অফিসারকে নাসের মেয়েটিকে চোখে চোখে রাখতে বলে এগিয়ে গেল নিজের ডেস্ক এ। আর এদিকে জামিল এগিয়ে গেল মেয়েটি যেখানে বসে আছে... জামিল কি ভেবে সেই ৪৫ ডলার কমানোর কথা আর বলল না। “ম্যাডাম, আপনি চাইলে অপেক্ষা করতে পারেন ভোর হয়া পর্যন্ত। আপনাকে কেউ আর বিরক্ত করবেনা!” মুখ তুলে তাকালো মেয়েটি! জল ছাপিয়ে চোখে ফুঁটছে কৃতজ্ঞতার ছায়া। মানুষের চোখের ভাষা এত দ্রুত, মূহুর্তে বদলাতে এই প্রথম দেখল জামিল... হোটেলের বাইরে-ভেতরে তখন প্রচন্ড নিরব রাত্রি।

রাত কাটছে তার নিজের নিয়মে। কন্সিয়ার্জে গল্প করছে, আর ভোরের দৈনিক গুছাচ্ছে রোজারিও আর সিকিউরিটি অফিসার। মুখ থুবরে টেবিলে পরে ঘুমোচ্ছে ডিউটি ম্যানেজার। ফয়সাল ব্যাক অফিসে টেলিফোন অপারেটরের রুমে টিভি দেখছে। রিসিপসনে একা দাঁড়িয়ে বই পড়ছে জামিল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “মনের মানুষ”...বেশ লাগছে! আফসোস হচ্ছে কেন ও মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “মনের মানুষ” ছবিটা দেখলো না, যেটা এই বই অবলম্বনে তৈরী। মাঝরাতে জয়া... কতদিন গেছে এই পাঁচতারা হোটেলের পাশ দিয়ে কিন্তু কোনদিন ভেতরটা দেখা হয়নি! দেখা বলতে ওই বিশালাকার মিলনায়তন, যেখানে প্রায়ই বিভিন্ন মেলার আয়োজন করা হয়। আজ সন্ধ্যায় কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে যখন জয়া, মির্জা আর দুজন বন্ধু এখানে খেতে এলো...জয়ার মনটাই জুড়িয়ে গেল! ডোর ম্যানের অভ্যর্থনা, সুন্দর, শান্ত, ঝকঝকে লবি...ঠিক যেন ছবিতে দেখা বিদেশের মতো! রেস্টুরেন্টের হোস্টেস দেখতে আমাদের অনেক দেশী মডেলদের চাইতে ভালো। কিন্তু খাবারের কি দাম বাবা! একেকজনের বুফ্যে ডিনার দু’হাজার টাকা! নাহ আজ আর জয়া মির্জাকে বাধা দেয়নি। করুক না একটু খরচা...টাকা নেই তো কি!...আজ যে ওদের বিয়ের দিন! না হয় ঘটা করে কিছু হয়নি, কিন্তু দিনটা তো আর স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না! চিরকাল মনে থাকবে... হাসি, ঠাট্টা, গল্পে সময় যে কখন ১০টার কাটা পেরিয়েছে বোঝা যায়নি।

উঠে গেল ওদের বন্ধু দুজন। মা’র বাসায় বাচ্চা রেখে এসছিল, তাই রাত করেনি ওরা। ওরা যেতেই ফোন বেজে উঠলো মির্জার। উঠে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে কি বলছে মির্জা? কার সাথে কথা বলছে! বুঝতে চেষ্টা করলো জয়া...নাহ...বোঝা যাচ্ছে না! জয়া ডেজার্টে মন দিল। কি দারুণ এদের আইসক্রিম! ঠিক যেন প্রথম প্রেমের অনুভূতি! আচ্ছা বাইরে এমন পাওয়া যায় না কেন? নাকি যায় কোথাও...জয়ারই যাওয়া হয়নি... তাড়াহুড়ো করে বিল মিটিয়ে মির্জা খানিকটা ছুটে এলো।

“জয়া আমার এক্ষুণি যেতে হবে...খুব সমস্যা হয়ে গেছে...” শেষ করতে দেয় না জয়া... “কি, হয়েছে কি! আহা...বল না এমন হাপাঁচ্ছো কেন?” মির্জাঃ “অত কথা বলার সময় নেই, আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি...তুমি প্লীজ লবিতে বা কোথাও বসো। প্লীজ রাগ করোনা...আমি যাবো আর আসবো” মির্জা ছুটতে লাগলো...জয়া ডাকছে পেছন থেকে... “মির্জা...মির্জা...” রেস্তোরার বাকীরা ঘুরে তাকাচ্ছে জয়ার দিকে! জয়া সামলে নেয়। ওই রকম অবস্থাতেও জয়ার অবচেতন মন বুঝতে পারে এখানে যারা আসে তারা জোরে কথা বলায় বা শোনায় অভ্যস্ত নয়। লবিতে বসে অনেক কথা ভাবে জয়া। শঙ্কা-আশঙ্কায় ভরে উঠে মন।

রাত বারোটা বাজতে চলল...সেই যে গেল...কিন্তু ফিরছে না কেন? ফোন বেজে চলেছে ওপাশে, ফোনও ধরছে না! দৌড়ে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেনিতো মোবাইলটা! জানানো হয়েছে ওই দুজন বন্ধুকেও, ওরাও চেষ্টা করছে। কিন্তু কই মির্জা...মির্জাতো নেই কোথাও! এরই মধ্যে স্যুটেড-বুটেড দুজন লোক এসে জিজ্ঞেস করছে কোন হেল্প লাগবে কিণা! আরে কি যন্ত্রণা...কি হেল্প চাইবে জয়া! ও কি বলবে যে হ্যাঁ, আমাকে যে কয়েক ঘন্টা আগে বিয়ে করেছে সে হারিয়ে গেছে! খুঁজে পাচ্ছিনা! রাগে-দুঃখে ওর চোখ জলে ভরে উঠে। ছুটে যায় রিসিপসনে। সাহস করে রুম ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই কর্পূরের মতো সব সাহস উবে যায়! এতো টাকা...রুমতো নিতে পারবেনা। তবে কি ওরা হোটেল থেকে বের করে দিবে? আবার চোখ ভেঙ্গে জল গড়ায় গালে...আতি-পাতি করে খুঁজে দেখে ব্যাগে, জোর আট হাজার টাকা হবে।

সাথে কিছু গোল্ড আছে, ওগুলো রেখে কি রুম নেবে রাতের জন্য! এখানে কি ওভাবে রুম পাওয়া যায়! জয়া ফিরে আসে সোফায়। হাত-পা অসার হয়ে আসে জয়ার। কি করবে বুঝতে পারেনা! দু’হাত চেপে ধরে মুখে...এত জল কোত্থেকে বেরোচ্ছে...এও কান্নাও জমে ছিল! খানিক বাদে রিসিপসনের ছেলেটা ফিরে এসে জানায়, “ম্যাডাম, আপনি চাইলে অপেক্ষা করতে পারেন ভোর হয়া পর্যন্ত। আপনাকে কেউ আর বিরক্ত করবেনা!” জয়া বাস্তবে ফিরে আসে! তবু ছেলেটার কথা যেন দৈব বাণীর মতো শোনায়! হেসে ধন্যবাদ জানাতে চায় কিন্তু বিস্ময় কাটে না...ছেলেটাও সে সুযোগ দেয়না। বলেই পা বাড়ায় রিসিপসনে! ফোনটা ব্যাগে রেখে আচঁল টেনে জড়সড় হয়ে বসে জয়া।

রাতে কি এখানে তাপমাত্রা আরও কমিয়ে দেয়া হয়, নাকি মানুষ-জন নেই বলে এই শীতলতা! এলোমেলো অনেক কথা ভাবে জয়া...কি হলো, কি হচ্ছে এখানে বা কি হচ্ছে ওখানে, যেখানে মির্জা আছে! আশপাশের দেয়ালে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি খুঁজে জয়া। কোথাও ঘড়ি নেই কেন? ক’টা বাজে? মনে পড়ে, ব্যাগ খুলে মোবাইলে দেখলেই তো হয়! কিন্তু আর ব্যাগ খুলতে ইচ্ছে হয়না...কেউতো ওর অপেক্ষায় নেই! হায়রে সময়, যখন দরকার তখন পাওয়া কঠিন, আর যখন সময় পেরনোটাই মুখ্য তখন সময় স্থির! সারাদিনের ধকলে তন্দ্রামত এসে যায় জয়ার। জানেনা কতোটা সময় পেরিয়েছে...বাইরে থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযানের ধ্বনি...কেটে যায় জয়ার তন্দ্রা। উঠে গিয়ে জল দিয়ে আসে চোখে মুখে। আয়নায় নিজেকে কেমন অদ্ভূত দেখায়, ফোলা চোখ-মুখ, বীভৎস! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে ওয়াসরুম থেকে।

ব্যাগ নিয়ে রিসিপসনে এসে দাঁড়ায়। রিসিপসনের সেই ছেলেটা তখনো দাঁড়িয়ে, কি যেন পড়ছে। ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলের গ্লাসডোর পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় জয়া। আলো না ফুটলেও পাখির কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেছে। বাইরে তখন হালকা শীতল বাতাস।

কেঁপে উঠে জয়া...ভাবে কোথায় যাবে সে! মা-বাবা নেই...ঢাকায় থেকেছে বড় চাচার বাসায়! ওখানে তো ফেরা যাবে না...'আর ফিরছিনা' জানিয়ে চিঠি লিখে এসছে! মির্জা ঢাকায় কিছু বন্ধু-কলিগের সাথে শেয়ার করা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে, জানে ওটা কলাবাগানে, কিন্তু কখনো যায়নি ওখানে! কাল রাতে ওদের ওঠার কথা ছিল দুরুমের এক ছোট্ট বাসায়! সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল মির্জা, জয়ার তাই দেখা হয়নি সেই বাসা। কোন এলাকায় জয়া সেটা জানে, কিন্তু এ্যাড্রেস জানা নেই। আর জানা থাকলেই কি... মির্জা তো কোন চাবি দিয়ে যায়নি জয়াকে! হাতব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে জয়া। নাহ...কোন মিসডকল নেই। আরেকবার কি ফোন করে দেখবে মির্জার নাম্বারে? ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে...মনে সাহস জাগে! জানে না কোথায় যাবে, তবু পা বাড়ায় জয়া! এতো বড় পৃথিবী, তার কয়েকশ’ কোটি মানুষ...কোথাও কি জায়গা হবে না তার! মির্জার শেষরাত... বিকেল প্রায় চারটা।

নাহ, এখুনি গোসলটা সেরে না নিলে কিছুতেই ছ’টার মধ্যে কাজী অফিসে পৌঁছানো যাবে না। শেষ বারের মত ঘরে একবার চোখ বুলায় মির্জা...সব ঠিক আছেতো! কিন্তু সব বলতে মির্জা কি বোঝাতে চাইছে ও সেটা নিজেই জানেনা। ঘরে আজ নতুন বউ আসছে ঠিক আছে কিন্তু বাড়তি আড়ম্বরতো কিছু নেই! সদ্য মিল্ক হোয়াইট রঙ করা দু’রুমের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে সদ্য কেনা কিছু প্রয়োজনীয় আসবাব,কফি রঙের পর্দা, আর ধবধবে সাদা নতুন কেনা চাদরের এককোনায় রাখা একগুচ্ছ লালগোলাপ। ল্যাপটপে সেট করে রেখেছে জয়ার পছন্দের কিছু গান। পাশের রুমে মির্জার মোবাইল বেজে ওঠে...এখন আবার কে ফোন করলো! যা ভেবেছে তাই, অহনা।

মির্জার একমাত্র প্রাণের বন্ধু। সেই ভার্সিটির শুরুর দিক থেকে ওরা বন্ধু, পৃথিবীর কতো কি বদলে গেল, বদলে গেল ওদের বন্ধুত্বও, শুরুতে যতোটা হলকা ছিল, এখন ঠিক ততোটাই গাঢ়। কিন্তু হলে কি হবে, জয়া যে অহনাকে পছন্দই করে না! অথচ এই অহনাই কিন্তু ওদের প্রথম আলাপ করিয়ে দেয়। “কিরে ফোন ধরতে এতক্ষণ? ড্রাইবার পৌঁছেছে?” মির্জাঃ এখনই? বললাম না পাঁচটা/ সোয়া পাঁচটায় বেরোব! “হ্যাঁ, জানি, কিন্তু নতুন বউ যে ঘরে আসছে, মাঝরাতে ক্ষুধা-তেষ্টা পেলে খাবে কি শুনি?” মির্জা নিরব, জানে অহনাই আবার শুরু করবে... “শোন, ড্রাইবারের সাথে বুয়া আছে, আমি কিছু মিষ্টি, শুকনো খাবার, ফলটল পাঠিয়েছি, বুয়া সব গুছিয়ে রাখবে ফ্রিজে, তারপর ড্রাইবার বুয়াকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তোকে পিক করে নেবে। ” মির্জাঃ কিন্তু অহনা, এতোকিছুর... কথা শেষ করতে দেয় না মির্জাকে অহনা, “আর শোন, ফার্মাসীতে গিয়েছিলিতো! দেখিস, প্রথম রাতেই আবার বাপ হয়ে যাসনি যেন” শব্দ করে হাসতে হাসতে ফোন কেটে দেয় অহনা।

মনটা কি একটু খারাপ হয়ে গেল মির্জার? তার এই এতো প্রিয় বন্ধুটা আজ বিয়েতে থাকছেনা! এইট মান্থসের প্রেগ্নেন্সিতে আছে। বছর দুয়েক আগে প্রথম বাচ্চাটা মিসকারেজ হওয়ায় এই বাড়তি সাবধানতা। এমনকি ওর হাসবেন্ড সাব্বিরও নেই দেশে...বাঙ্গালোরে আছে অফিসের কি একটা ট্রেনিং এ। অন্যমনস্কতা ভাঙ্গে মির্জার ডোর বেলের শব্দে। ড্রাইবার এলো নিশ্চয়ই।

শুক্রবারের দিন বলেই ট্রাফিকে পড়ল না, বিয়ে থেকে শুরু করে বন্ধুদের ডিনার শেষে চলে যাওয়া পর্যন্ত সব যেন চলছিল নিয়ম মেনে, নির্বিঘনে। সমস্যাটা শুরু হল তারপর। মোবাইল স্ক্রিনে অহনার নাম দেখে উঠে গিয়ে ফোন ধরে মির্জা। কিন্তু একি? অপ্রস্তুত হয়ে যায় মির্জা! দূর থেকে ভেসে আসে অহনার চিৎকার, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বুয়া যা বলে, তার সারমর্ম ভয়ঙ্কর। ডুপ্লেক্সের সিঁড়ি পিছলে পড়ে গেছে অহনা, কার্পেট ভেসে যাচ্ছে রক্তে...ড্রাইবার দশ’টার কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে, সাব্বির নেই, কি করবে বুঝতে না পেরে বুয়া ফোন দেয় মির্জাকে।

ফোন রেখে টেবিলে তাকায় মির্জা। নিজের মনে আইস্ক্রিম খাচ্ছে জয়া। কি নিষ্পাপ সরলতা সারা মুখ জুড়ে। কে বলবে এই মেয়ে আজ বাড়ি পালিয়েছে মির্জাকে বিয়ে করবে বলে! হঠাৎ করে খুব লাকি মনে হয় নিজেকে! টেবিলের দিকে এগোতে গিয়ে খুব দ্রুত চিন্তা করে মির্জা। মির্জাকে এখন যেতেই হবে।

অহনার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনোই মাফ করতে পারবে না মির্জা। কিন্তু জয়া কি মানবে মির্জার চলে যাওয়া? বাসরের স্বপ্নে বিভোর কোন মেয়েই মেনে নেবে না। কিন্তু এখন বোঝাতে গেলে, মানাতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে... অহনাকে হসপিটালে ভর্তি করেই জয়াকে ফোন দেবে মির্জা। গাড়ি পাঠিয়ে দেবে অহনার, জয়াকে নিয়ে যাবার জন্য। হোটেলের বাইরে বেরিয়েই মির্জা ফোন দেয় অহনার ড্রাইবারকে।

যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতে বলে অহনার বাড়ী। হোটেলের বাইরে থেমে থাকা ৩ সিএনজি দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় মির্জার। একটায় উঠে বসে টানতে বলে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে। ড্রাইবার বলে ত্রিশ টাকা বেশি চাইতেই চেঁচিয়ে উঠে মির্জা, ‘হ্যাঁ,হ্যাঁ দিব, তুমি তাড়াতাড়ি টানো’! সিএনজিতে বসেই একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে মির্জা। প্রথমে অহনার বড় ভাইকে, তারপর ওদের এক কমন ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে ‘মাদার কেয়ার ক্লিনিক’এর নাম্বারের জন্য, এরপর ওর শ্বশুরবাড়িতে... কিন্তু এরই মধ্যে ড্রাইবার যে কখন পান্থপথ থেকে সিএনজি ক্রিসেন্ট রোডে ঢুকিয়ে দিয়েছে খেয়াল করেনি মির্জা।

খেয়াল হল সিএনজি থামার পর। মির্জাঃ কি ব্যাপার, এখানে থামালেন কেন? গ্যাস ফুরিয়ে যায়নিতো? একি, এটা কোথায় এসছেন আপনি? ড্রাইবার তড়িঘড়ি নেমে যায়, মির্জার প্রশ্ন ফুরোবার আগেই। গায়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় মির্জার। প্রচন্ড চেষ্টায় দরজা খুলে বেরোতেই, দু’টো বাইক থেকে নেমে আসে ছয় যুবক। কিছু বলা বা প্রোটেষ্ট করার সময় পায় না মির্জা, এলপাথাড়ি ঘুষি পড়তে থাকে মির্জার চোখে, মুখে, পেটে, মাথায়।

কেড়ে নেয় মোবাইল, ওয়ালেট, ঘড়ি। মুখ আটকে দেয়া হয় মোটা টেপ দিয়ে। এরইমাঝে মির্জা নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে...এতে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে দু’এক জন। মাথা ঠুকে দেয় দেয়ালে, ল্যাম্পপোষ্টে...ভিজে ওঠে মাথার তলা...কিছু বোঝার আগেই অসাড় হয়ে যায় শরীর। আবছা শোনা যায়, শালা মইরা গেল নাকি...আরে রাখ অজ্ঞান হইয়া গেছে! অই, হোন্ডা তাড়াতাড়ি স্টার্ট দে...! ধোঁয়া ঊড়িয়ে চলে যায় হাইজ্যাকার যুবকের দল।

অবশেষে... সকাল সোয়া সাতটা পর বাস স্টপে এসে দাঁড়াতেই কাল রাতের সেই মেয়েটিকে দ্যাখে জামিল। মাথা একপাশে কাঁত কোরে বসে আছে এক কোণায়। দৃষ্টি দূরে কোথাও। কেন যেন কষ্ট হয় জামিলের! মেয়েটিতো ওর কেউ নয়! তবুও... বাস আসতেই দৌড়ে উঠে পড়ে জামিল। কলাবাগান আসতেই বাস ছেড়ে রিক্সা নেয়।

ক্রিসেন্ট রোডের যে গলিতে ওদের বাসা তার এক গলি আগেই রিক্সা ছেড়ে দিতে হলো আজ। এত ভিড় কেন গলিতে! বিশ/ ত্রিশ মানুষ ঠেলে সামনে এগোতেই দ্যাখে এক যুবকের লাশ (লাশই বা বলছে কী কোরে, বেঁচেওতো থাকতে পারে!) মুখে, গায়ে জখমের চিহ্ন। মাথার ওপর ভন ভন কোড়ছে কিছু মাছি, আর নিচে জমাট বাঁধা রক্ত! পুলিশ এসে গেছে! সবার মনে প্রশ্ন, লোকটা কী বেঁচে আছে! জামিলের জানতে ইচ্ছে করে না। বেঁচে থাকলে ভালো, কিন্তু না থাকলে? বাড়ীর দিকে পা বাড়ায় জামিল। সকালটাকে খুব কুৎসিত মনে হয় জামিলের! এদিকে বাড়ীতেও হইচই।

কিন্তু আনন্দে! আম্মার ছোট মামার মেয়ে অহনা, যার গতবার মিসকাড়েজ হয়েছিল, তার নাকি একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। আম্মা তার জন্য মহা উৎসাহে ‘অ’ দিয়ে নাম খুঁজে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত লাগে জামিলের!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।