-সালেহ মতীন
‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা, সব দ্বার এর খোলা রবে চালা হাতুটি শাবল চালা’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোন্ বিক্ষুব্ধ উপলব্ধিতে কবিতার ঐ চরণ দু’টি লিখেছিলেন তা আমরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারি। কবি খুব কাছে থেকে মসজিদের এ অদ্ভুত আচরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমরা জানি, কবি মাঝে মাঝে ইমামতির দায়িত্বও পালন করতেন। সে সুবাদে মসজিদের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিশীল না হওয়ায় মসজিদের দরজা ব্যাপকভাবে বন্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। মসজিদের মর্যাদা এবং কর্মপরিধি যে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও গলা ছেড়ে জিকিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় কবি তা যথাযথ উপলব্ধি করেই তালাবদ্ধ মসজিদের প্রতি মনক্ষুণ্ন অনুভূতি কবিতা আকারে ব্যক্ত করেন।
বিদ্রোহী কবির সে সময়ের পর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর, বদলে গেছে অনেক কিছু, কিন্তু মসজিদের সে আচরণ ঠিকই রয়ে গেছে বলেই মনে হয়।
সম্প্রতি বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ, বরেণ্য মনীষী, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব শাহ আব্দুল হান্নান এর একটি লেখা পড়ে তাঁর প্রতি আমাদেরও সমব্যাথার উদ্রেক হয়েছে। লেখকের রত্নগর্ভা মা বিশিষ্ট ইসলামী কবি আনোয়ারা বেগম গত ১৭ মে ইন্তেকাল করেন। দু:খজনক বিষয় হলো, মরহুমা কবির নামাজে জানাজার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল বাদ আসর। কিন্তু নামাজের মাত্র আধ ঘণ্টা আগে গিয়েও লেখক মসজিদকে তালাবদ্ধ দেখতে পান।
তিনি অপেক্ষা করতে থাকলে পৌনে পাঁচটার সময়ও তালা না খুললে তিনি স্বভাবতই অপ্রস্তুত অবস্থার শিকার হন। মাতৃবিয়োগে শোককাতর লেখকের বেদনার্ত বিড়ম্বনা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। ঘটনাটি রাজধানীর সিপাহীবাগ মসজিদের। কিন্তু পাঠক আমার সাথে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, এ চিত্র শুধু সেখানকার নয়, বরং রাজধানী ছাড়াও এর বাইরে অন্যান্য শহর এমনকি সারা বাংলাদেশেই মসজিদের এ দায়িত্বহীন ব্যবস্থাপনা লক্ষণীয়। এ অবস্থা কোন মুসলমানেরই কাম্য হতে পারে না।
আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটি সাধারণ মনে হলেও বাস্তবিক পক্ষে মোটেও তা সাধারণ নয়। মসজিদের দুয়ার বন্ধ করে মুসল্লীদের আগমন প্রবাহকে বিঘ্নিত করা ইসলামের মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং মসজিদের দরজা বন্ধ করে আগন্তুক মুসল্লীদের সাধারণ ইবাদাতে বাঁধা সৃষ্টি করা আদৌ জায়েজ কিনা তা গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
বিশ্বের আর কোথাও এমন নজির আছে কি না আমার জানা নেই যে, মসজিদে জামাতের নির্ধারিত সময়ের আগে পিছে কিছু সময় ব্যতীত বাকী সময়টা মসজিদ তালাবদ্ধ রাখা হয়। এমনকি আপনি কোন মসজিদে জামাতের নির্ধারিত সময়ের ১০/১৫ মিনিট পরে উপস্থিত হয়ে একাই ফরয পড়ে নিতে বাধ্য হলেন।
হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন নামাজের শেষের দিকে আপনার পাশে কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি সালাম ফিরায়ে নামাজ শেষ করতেই তিনি আপনাকে বলবেন, সুন্নাত বাইরে পড়–ন, মসজিদে তালা দিব। এ আচরণ রীতিমতো দৃষ্টিকটূ, অন্যায় এবং ইসলামী সংস্কৃতির পক্ষে আত্মঘাতী। মসজিদে তালা ঝুলিয়ে মুসল্লীদের স্বাভাবিক ইবাদাত কর্মকে ব্যাহত করা উচিত নয়। ঘর্মাক্ত কোন মুসল্লীকে মসজিদের ভিতরের ফ্যান সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে বাইরের বারান্দায় ফ্যান ছাড়াই নামাজ আদায়ে বাধ্য করা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
মসজিদ নামাজ ছাড়াও মুসলমানদের অনেক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ও অর্থবহ সম্মেলন স্থল। পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যা, উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতীয় কর্মকাণ্ডের আঞ্চলিক সমন্বয় সহ সব ধরণের হালাল কাজের ব্যাপারে মত বিনিময়ের জন্য মসজিদ একটি পবিত্র ও কার্যকর স্থান। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে খামখেয়ালীর বশে তালাবদ্ধ থাকবে এ উদ্ভট রীতি অবিলম্বে বিলুপ্ত হওয়া উচিত। মসজিদে থাকবে বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মুসলমানের অবারিত প্রবেশাধিকার তা সে যখনই মসজিদে আসুক না কেন।
আমি জানি, অনেকেই আমার এ লেখা পড়ে আমার উপর বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকতে পারেন।
ভাবছেন, যে দেশে মসজিদ থেকে মাইক, ঘড়ি, ফ্যান ইত্যাদি চুরি হয় সে দেশে মসজিদে তালা লাগানো থাকবে না তো কী থাকবে ? এ কথা ঠিক যে, মসজিদের মতো পবিত্র স্থান থেকেও দু:খজনক চুরির ঘটনা এ দেশে ঘটে থাকে। এটা নৈতিকতার চরম অধ:পতন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু না! চুরি প্রতিরোধে মসজিদ তালাবদ্ধ রাখা কোন ন্যায়সঙ্গত আচরণ হলো না। এটি মসজিদের মর্যাদার সাথে অবিচার করা। আমি মনে করি, প্রয়োজনে মসজিদে সার্বণিক সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করা যেতে পারে।
এতে বরং ২ লক্ষাধিক বেকার লোকের হালাল রুজির সংস্থানও হবে। মুসল্লীরাই সম্মিলিতভাবে এর ব্যায়ভার বহন করবে। এমনকি নিয়োজিত সিকিউরিটি গার্ডকে আযানের উপযুক্ত তা’লিম দিলে একই সাথে মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও তিনি পালন করতে পারেন। ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন ছাড়াও মসজিদের উন্নয়ন তো সাধারণত দানশীল মুসল্লীদের অর্থায়নেই সম্পাদিত হয়। আমাদের দেশের মুসলমানেরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মভীরু।
সে কারণে মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের যারপরনাই দুর্বলতা রয়েছে। মসজিদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক একজন সিকিউরিটি গার্ডের বেতন নির্বাহ করা মুসল্লীদের পক্ষে মোটেও কঠিন নয়।
মসজিদের দুয়ার বন্ধ রাখা ছাড়াও ‘মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা হারাম’ এমন অনেক নির্দেশনা আমরা খোদ মসজিদেই দেখতে পাই। এ সবই ইসলাম সম্পর্কে সীমাবদ্ধ জ্ঞানের পরিচায়ক। সত্যি কথা বলতে, মসজিদের কোন কোন ইমাম সাহেবের শরয়ী জ্ঞানের দৈন্য দেখে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত না হয়ে পারি না।
মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে দীর্ঘদিন থেকে দাবী উঠে আসছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ, দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থাপনা সরকারী প্রশাসন ও পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত সহায়ক চাবিকাঠি। ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে, রাসূল (স-র যুগে এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ বিদ্যমান। এমতেক্ষেত্রে সেই মসজিদ বন্ধ করে রাখার প্রবণতা ইসলামের সামাজিক কর্মপদ্ধতিকে আড়াল করার শামিল।
জাতীয় পর্যায়ে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী সম্মানিত দায়িত্বশীল উলামাবর্গকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ভাবনা করার দাবী জানাই।
বিশেষ করে জাতীয় মসজিদের মুহতারাম খতীব এবং বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। যদিও আমাদের দেশে জাতীয় মসজিদ ছাড়া কোন মসজিদই সরকারের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রাধীন নয়, তবু মসজিদে তালা সমস্যা নিয়ে সরকারেরও পদক্ষেপ নেয়া দরকার। মসজিদের তত্ত্বাবধান তথা সংরক্ষণের নামে এর দরজা বন্ধ নয় বরং উম্মুক্ত করে দিয়ে ইসলামের মহত্তম সুবাস সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া উচিত।
লেখক : পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail :
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।