সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
মসজিদের শহর ঢাকা
আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকার ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। প্রাচীন এই শহরজুড়ে শুধু রয়েছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। তাইতো ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। এই মসজিদের শহর ঢাকার উল্লেখযোগ্য কিছু মসজিদ নিয়ে আমার এবারের লেখা।
বায়তুল মুকাররম মসজিদ
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকাতে বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী। বিশিষ্ট স্থপতি টি. আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়।
পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিন দিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার।
আধুনিক স্থাপত্যে কম অলংকরণই একটি বৈশিষ্ট্য-যা এই মসজিদে লক্ষনীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হৃদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
বেগম বাজার মসজিদ
রাজধানীর পুরান ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় এই মসজিদ অবস্থিত। ১৭০১-১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান এই মজজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি সংযোজিত দোচালা অংশসহ একটি উঁচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে।
প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি কুয়া। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। সারকোফেগাসে মসজিদের প্রথম ইমামের নাম উৎকীর্ণ। প্লাটফর্মটির নিচে সারিবদ্ধভাবে একাধিক বর্গাকার ও আয়তাকার কক্ষ বিদ্যমান, প্লাটফর্মের পূর্ব দিকে নতুন করে নির্মিত সিঁড়ি সংবলিত একটি খিলানপথ রয়েছে। এ পথেই প্লাটফর্মের ওপর নির্মিত মসজিদে প্রবেশ করা যায়।
একটি কক্ষের মধ্য দিয়ে সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ বেয়ে নিচে নেমে এর পানি স্তরের নিকট পৌঁছা যায়। মূল মসজিদ ও এর সংযোজিত দোচালা অংশ ভল্টেড উঁচু চত্বরের পশ্চিমাংশের অর্ধেক জায়গা দখল করে আছে। ভবনটির অলংকরণে এর স্থাপত্যিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বিশেষ করে প্রবেশপথগুলোর পার্শ্ববর্তী অলংকৃত ক্ষুদ্র মিনার, মিহরাব, ছত্রী, ছোট গম্বুজ এবং পদ্ম ও কলস শোভিত ফিনিয়াল। প্রবেশপথ ও মিহরাবগুলো ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এবং এদের শীর্ষ মেরলোন শোভিত। প্যারাপেট ও গম্বুজ ড্রামের গায়েও রয়েছে উন্নত মেরলন মোটিফ।
গম্বুজগুলোর ভিতরের দিক পত্র নকশাকৃত এবং এদের শীর্ষবিন্দু বিশাল মেডালিয়নের মাঝে একটি রোসেট দ্বারা অলংকৃত। কেন্দ্রীয় খিলানপথটির অর্ধ-গম্বুজ ভল্ট মুকারনা নকশায় স্টুকো করা, যা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ছাড়া সমস্ত ভবনটি সাধারণ প্লাস্টার করা, যা কিনা বাংলায় মুঘল স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। মসজিদের বাওলি, যা একটি স্বতন্ত্র সৌধ হিসেবেই প্রতীয়মান, আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
খাজা আম্বর মসজিদ
রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে ময়মনসিংহ রোডের পূর্বদিকে অবস্থিত।
মুঘল সুবাদার মীরজুমলা উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অশ্বারোহী বাহিনীর যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তাটি নির্মাণ করেছিলেন। আলোচ্য মসজিদটি অনেক বার সংস্কার ও স¤প্রসারণ করা হয়েছে। ১৯৬০ দশকে এর আমূল সংস্কার করা হয়। তখন পূর্ব প্রান্তে তিন গম্বুজ আচ্ছাদিত একটি বারান্দা যোগ করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব প্রান্তে বহুতলবিশিষ্ট সমপ্রসারিত অংশ নির্মাণ করায় বর্তমানে ইমারতটি আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মসজিদটিতে দুটি শিলালিপি আছে। কেন্দ্রিয় মিহরাবের উপরে স্থাপিত প্রথম শিলালিপিতে রয়েছে কোরানের একটি আয়াত। আর কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপরে বাইরের দিকে স্থাপিত দ্বিতীয় শিলালিপিতে সুবাদার শায়েস্তা খানের প্রধান খোজা, খাজা আম্বর কর্তৃক ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ এবং একটি সেতু নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। তিন গম্বুজের এ মসজিদ ভূমি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু একটি উত্তোলিত মঞ্চের পশ্চিম অর্ধাংশজুড়ে অবস্থিত। এ ভিত্তিমঞ্চের শীর্ষে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম-পাপড়ি নকশার একটি সারি।
এর চারকোণে রয়েছে চারটি বিশাল আকৃতির পার্শ্ববুরুজ। অষ্টভুজাকৃতির বুরজগুলো ভিত্তিমঞ্চের চেয়ে সামান্য একটু উঁচু এবং এগুলোর শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ। পূর্ব প্রান্তে একটি সিঁড়ি পেরিয়ে পাথরের তৈরি ফ্রেমবিশিষ্ট খিলানযুক্ত একটি তোরণ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। এ সিঁড়িপথের ডান দিকে খাজা আম্বরের খননকৃত কূপটি ছিল, তবে বর্তমানে এটিকে মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভিত্তিমঞ্চের পূর্বদিকে রয়েছে খাজা আম্বরের সমাধি।
আদিতে এখানে শুধু পাথরের তৈরি কবর ফলক দৃশ্যমান ছিল। তবে বর্তমানে এর উপরে ইট দিয়ে একটি ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটি আয়তাকার। মসজিদের চার কোণকে মজবুত করতে নির্মিত অষ্টভুজ পার্শ্ববুরুজগুলো ছাদের সমান্তরাল ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। ইমারতটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে।
মসজিদের বড় কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি যথারীতি দেওয়াল থেকে প্রক্ষিপ্ত একটি আয়তকার ফ্রন্টনের মধ্যে স্থাপিত। ইমারতটির একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক হচ্ছে এর প্রবেশপথ, মিহরাব ও মিম্বারে কালো ব্যাসাল্ট পাথরের ব্যবহার। এ পাথরগুলো সংগৃহীত হয়েছিল রাজমহলের পাহাড়ি এলাকা থেকে। আর একটি অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর পূর্বদিকের প্রবেশ পথগুলোর প্রক্ষেপণের দুপ্রান্তে আলংকারিক মিনার নির্মাণ। এ মসজিদেই প্রথম এ বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়, তবে এরপর থেকে তা বাংলার মুঘল মসজিদ স্থাপত্যের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
চক মসজিদ
নগরীর পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় এই মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটি এত বার সংস্কার ও স¤প্রসারণ করা হয়েছে যে, বর্তমানে তার আদি পরিকল্পনা ও রূপ চিহ্নিত করা প্রায় অসমভব। মূল মসজিদের উত্তর দেয়াল অপসারণ করা হয়েছে ও পূর্ব দিকের সমপ্রসারিত অংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মূল আচ্ছাদন ভেঙে তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি তল এবং এর ছাদে তিনটি নতুন গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মাঝের গম্বুজটি করা হয়েছে অনেক বড়।
দেয়ালগুলোর পুরুত্ব হ্রাস করা হয়েছে, মিহরাব ও প্রবেশপথগুলোকে করা হয়েছে প্রশস্ত আর উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি এখনও অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির, তবে বাকী দুটি আয়তাকার। বর্তমানে এগুলো চকচকে টালি দিয়ে সাজানো। আর মিহরাবগুলোর আয়তাকার ফ্রেমের ওপর রয়েছে চিত্রিত শিখর নকশার একটি সারি। মসজিদের মেঝেতে বর্তমানে রয়েছে মার্বেল পাথর।
মসজিদের অভ্যন্তরভাগ তিনটি বে’তে বিভক্ত ছিল, যার মাঝেরটি ছিল বর্গাকার আর দুপার্শ্বস্থ দুটি আয়তাকার। তিনটি ‘বে’র উপরেই ছিল গম্বুজের আচ্ছাদন, যার মধ্যে মাঝেরটি ছিল অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। আদি প্রার্থনা কক্ষটির ঠিক উপরে নির্মিত দ্বিতীয় তলের ছাদ দেখে সেটা অনুমান করে নেওয়া যায়। এখানেও কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড় করে নির্মিত। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ওপর স্থাপিত একটি ফারসি শিলালিপিতে লেখা রয়েছে সুবাদার শায়েস্তা খান ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
চুড়িহাট্টা মসজিদ
পুরনো ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকায় এই মসজিদ অবস্থিত। বারবার পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে এটিকে একটি আধুনিক ইমারত বলে মনে হয়। মসজিদটির উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে প্রশস্ত বারান্দা সংযোজন করা হয়েছে। আদিতে নির্মিত চৌচালা ছাদের পরিবর্তে বর্তমানে রয়েছে একটি সমান্তরাল ছাদ এবং এর উপরে আরও দুইতলা নির্মাণ করা হয়েছে। মূল ইমারতটির ভূমি পরিকল্পনা আয়তাকার এবং এর বাইরের দিকে চার কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ নির্মাণের মাধ্যমে ইমারতটি মজবুত করা হয়েছিল।
তবে বর্তমানে এ বুরুজগুলো অপসারণ করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলানকৃত প্রবেশপথ ছিল। কিবলা দেওয়ালে ভেতরের অংশে তিনটি মিহরাব ছিল, তার মধ্যে কেবল কেন্দ্রীয় মিহরাবটিই বর্তমানে টিকে আছে। মিহরাবটি অষ্টভুজাকার এবং একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত। এ ফ্রেমের উপরের অংশে রয়েছে বদ্ধ-শিখর নকশার একটি সারি।
মসজিদটি কুঁড়ে ঘরের ন্যায় চৌচালা আকৃতির ছাদে আচ্ছাদিত ছিল, তবে বর্তমানে এর ছাদ সমান্তরাল। এর পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে আয়তাকার ও বর্গাকার খোপ নকশা এবং বপ্রে মেরলোনের নকশা ছিল। মসজিদে একটি ফারসি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সুবাহদার শাহ সুজার সময়ে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে জনৈক মুহমদ বেগ এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
তারা মসজিদ
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খয়রাত রোডে এই মসজিদ অবস্থিত। আদি তারা মসজিদের কোনো তারিখযুক্ত শিলালিপি নেই।
তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এস.এম তৈফুর ১৯৫৬ সালে এ মসজিদের নির্মাতা মির্জা গোলাম পীরের পূর্বপুরুষ ঢাকায় এসে ‘মহল্লা আলে আবু সাইয়েদ’ বা বর্তমান আরমানিটোলায় বসবাস শুরু করেন। তারা মসজিদটি মির্জা গোলাম পীর নির্মাণ করেছিলেন বলে মসজিদটি মির্জা সাহেবের মসজিদ বলেও অভিহিত হয়ে থাকে। মির্জা গোলাম পীরের মৃত্যু হয় ১৮৬০ সালে; তাই এ মসজিদের নির্মাণকাল উনিশ শতকের প্রারম্ভে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। তারা মসজিদ আদিতে ছিল দৈর্ঘ্যে ১০.০৬ মিটার এবং প্রস্থে ৪.০৪ মিটার। জুল্লার পূর্ব দেয়ালে ৩টি প্রবেশপথের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে পশ্চিম দেয়ালে ছিল তিনটি মিহরাব।
কেন্দ্রীয় মিহরাব দুপার্শ্বের মিহরাবদ্বয় অপেক্ষা বড়। মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজটিও ছিল দুপার্শ্বের দুটি গম্বুজ অপেক্ষা উঁচু এবং তুলনামূলকভাবে বড় আকৃতির। কেন্দ্রীয় গম্বুজ নির্মাণে বর্গকে বৃত্তে রূপান্তরের মাধ্যম হিসেবে খিলান ভিত্তিক ‘স্কুইঞ্চ’ পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। আদি তারা মসজিদ বর্তমান তারা মসজিদের ন্যায় নকশালংকারে সমৃদ্ধ ছিল না। পশ্চাতের ভগ্ন ও নগ্ন দেয়াল তার সাক্ষ্য বহন করছে।
মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা। এ গাত্রালংকারে চিনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাচের টুকরা ব্যবহƒত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরী’ বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের গাত্রনকশায় বিধৃত হয়েছে। এ মসজিদের অলংকরণ জুল্লার অভ্যন্তরে ফুলদানি থেকে উত্থিত ফুলগাছ, খিলান শীর্ষে পেন্ডেন্টিভের ওপর ও দেয়ালগাত্রে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে।
বারান্দায় গাত্রালংকারে জাপানের বিখ্যাত ‘ফুজিসান’-এর দৃশ্যসংবলিত গ্লাস টাইল উল্লেœখযোগ্য। ‘ফাসাদ’-এর কেন্দ্রে আরবি লিপি সংবলিত সূক্ষ্ম অর্ধচন্দ্র ও তারার অলংকরণ স্থান পেয়েছে। বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলোতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।
লালবাগ শাহী মসজিদ
এই মসজিদটি ঢাকার লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ তোরণ থেকে কয়েক গজ দূরে অবস্থিত।
এটি ফররুখ সিয়ার মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদটি বাংলায় বিদ্যমান মুঘল মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানে একসঙ্গে ১৫০০ মুসল্লির স্থান সংকুলান হয়। শাহজাদা ফররুখ সিয়ার যখন তাঁর পিতা সুবাহদার শাহজাদা আজিম-উস-শানের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় ছিলেন তখন ১৭০৩-০৬ সালের মধ্যে তিনি এ মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে কয়েক দফা মেরামত ও স¤প্রসারণের ফলে মসজিদটিকে বর্তমানে আধুনিক বলে মনে হয়।
১৮৭০ সালে খাজা আব্দুল গনির উদ্যোগে সর্বপ্রথম মসজিদটিতে সংস্কার কাজ করা হয়েছিল এবং এ সময় মসজিদের কাঠের তৈরি আদি ছাদের পরিবর্তে বর্তমানের চুন-সুরকির ঢালাই ছাদ দেওয়া হয়। এরপর পাকিস্তানি আমলে একটি নতুন মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে মসজিদটি স¤পূর্ণভাবে মেরামত করা হয় এবং পূর্ব দিকে সমতল চুন-সুরকির ঢালাই ছাদসহ বড় ধরনের স¤প্রসারণের কাজ করা হয়। মসজিদটির মূল পরিকল্পনা এখনও অবিকৃত। বাইরের চারকোণের বিশাল অষ্টভুজ বুরুজগুলো ছাদের অনুভূমিক বপ্র ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং আদিতে এগুলোর ওপর নিরেট ছত্রী ও ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ আচ্ছাদিত ছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রত্যেকটিতে তিনটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার রয়েছে, যা উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত তিনটি আইলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কিবলা দেওয়ালের কেন্দ্রস্থলে একটি অর্ধ-অষ্টভুজ মিহরাব আছে। বর্তমানে এটিকে অনেক প্রশস্ত এবং স¤পূর্ণ আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। কেবলা দেওয়ালে মিহরাবের উভয় পার্শ্বে কিছু দূর পর পর সমদূরত্বে চারটি করে খিলানের চিহ্ন রয়েছে।
কেন্দ্রীয় মিহরাবসহ এসব খিলানের অবয়ব (সর্বমোট আটটি) বরাবর পূর্ব দেওয়ালে নয়টি প্রবেশপথ রয়েছে। ভেতরের দেওয়াল আধুনিক স্প্যানিশ ধাঁচের টাইলস দ্বারা আবৃত। নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে মসজিদটির তেমন স্থাপত্যিক গুরুত্ব নেই, তবে তা সত্ত্বেও এর ভূমি নকশা এবং ছাদের নির্মাণকৌশল বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এটি বাংলায় তিন আইলবিশিষ্ট প্রার্থনাকক্ষ সংবলিত মুঘল মসজিদের একমাত্র নিদর্শন।
কাকরাইল মসজিদ
রাজধানীর রমনা পার্কের পাশে এই মসজিদ অবস্থিত।
দেশের তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মসজিদ এটি। এখান থেকেই সারা দেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেই সাথে প্রতিবছর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয় এই মসজিদের মাধ্যমেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তাানসহ বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এই মসজিদ অনেক শ্রদ্ধার।
সাতগম্বুজ মসজিদ
নগরীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ঐতিহ্যবাহী সাতগম্বুজ মসজিদ।
এই মসজিদে সাতটি গম্বুজ থাকার কারণে এর নাম হয়েছে সাতগম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদের তিনটি গম্বুজ মূল নামাজ কক্ষের ওপর এবং বাকি চারটি চার কোণের টাওয়ারের ওপর স্থাপিত। নামাজকক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলানপথ"তিনটি পূর্ব দেয়ালে এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে। পূর্ব দেয়ালের খিলানপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ-অষ্টভুজাকার মিহরাব কুলুঙ্গি। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে তিনধাপ বিশিষ্ট পাকা মিম্বার রয়েছে।
কেন্দ্রীয় মিহরাব ও খিলানপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণের খিলানপথগুলি সম্মুখভাগে অভিক্ষিপ্ত ফ্রন্টনের মাঝে ন্যস্ত। ফ্রন্টনগুলো পাশে অলংকৃত ছোট মিনার সমৃদ্ধ। মসজিদের অনুভূমিক প্যারাপেট এবং গম্বুজের ড্রাম সারিবদ্ধ মেরলোন নকশায় শোভিত। পূর্ব ফাসাদ প্রচলিত মুঘল রীতির প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। মিহরাবগুলোর সম্মুখভাগ মনোরমভাবে খাঁজকাটা।
কেন্দ্রীয় মিহরাবকে বেষ্টনকারী আয়তাকার ফ্রেমটির উপরের দিকে রয়েছে বদ্ধ শিখরসদৃশ ফ্রিজ। সবগুলো গম্বুজের চূড়ায় কলস ও পদ্ম শীর্ষ সংবলিত এবং এদের অভ্যন্তরভাগের ভিত্তি পত্র নকশায় সজ্জিত। কেন্দ্রীয় গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট অলংকৃত বিশাল মেডালিয়ন। মসজিদের শিলালিপি না থাকলের নির্মাণশৈলীর দিক থেকে বিবেচনা করলে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৬৮০ সালের কাছাকাছি সময় বলে মনে হয়।
(এই পোস্টে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত নেয়া হয়েছে ইতিহাসবিদ নাযির আহমেদ এর "ঢাকার ইতিকথা" বই থেকে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।