শ্রাবনী খুঁজছে ভাবনার পথ...
আজ একজন কৃষ্ণকলির গল্প বলব। শুরুটা হতে পারে এরকম-
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
কালো? তা সে যেমন কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখেলে কিনা চেয়ে,
আমিই জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। ।
এমনি ক'রে কালো কাজল মেঘ
জৈষ্ঠ্য মাসে আসে ঈষান কোণে।
এমনি ক'রে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি ক'রে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার 'পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। ।
কবিগুরু বোধ হয় কালো মেয়ের মনের কষ্টটি ঠিক দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তো এত সুন্দর করে বলেছেন 'কালো? তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। ' আজো মেয়েরা শুধু কালো হবার কষ্টেই বিলীন হচ্ছে প্রতিদিন প্রতি নিয়ত। তবু স্বপ্ন দেখি কালো মেয়ের হরিণ-কালো চোখ কেউ দেখবে, দেখবে মুগ্ধ হৃদয় নিয়ে ভেতরের মানুষটির সৌন্দর্য । জানবে ঐ মেয়েটির মাঝেও কত সম্ভাবনার আলো জ্বলে রয়েছে।
বেশি কথা না বাড়িয়ে মূল গল্পে চলে যাই-
১।
কি অদ্ভুদ সুন্দর একটা ভোর! হালকা কুয়াশায় আছন্ন প্রকৃতি। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পাখিদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠছে চারপাশ। দু’একজন ফিরছে নামাজ পড়ে। ভোরের বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে কেউ কেউ বেড়িয়েছে লেপের তলা থেকে।
এখনও তেমন জাকিয়ে বসেনি শীত। স্মরণী মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ভোরের আলোয় রাঙা প্রকৃতি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় ওকে। সারা সকালের কাজ এই ভোরেই সেরে রাখতে হয়। মায়ের ঘুম ভাঙ্গে দেরীতে।
তাই নাস্তা বানানো, উঠান ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে বাসন কোসন ধোয়া সব কাজ গুছিয়ে রেখে তবেই ও গোসলে যেতে পারে। কলেজ়ে যাবার অনুমতি ও এই শর্তে পেয়েছিল যে ভোরের কাজ সব করতে হবে প্রতিদিন। স্মরণীর ভীষন ভাল লাগে এই সময়টা। পুরো বাড়ী যখন ঘুমায় ও তখন চুপচাপ কাজ করে যায় যন্ত্রের মত। কাজ করতে ওর ভালই লাগে।
একা একা নিজের মনে গুনগুন করে গাইতে গাইতে নাস্তা বানায় আর মাঝে মাঝে প্রিয় আকাশের নানা রঙে রঙ্গিন হওয়া রুপ দেখে মুগ্ধ হয়।
কাল রাতে জমা মেঘ গুলো যেন মনের আকাশ থেকেও বিলীন হয়ে গেল কোন ফাঁকে। আজ যতই ঝড়বৃষ্টি ঝরুক ওর উপরে ওকে কলেজে যেতেই হবে। টিউটোরিয়াল শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষা ভাল দিতেই হবে।
এতদুর এগিয়ে এসে ওর আর পিছানোর উপায় নেই। স্মরনী দ্রুত হাত চালায়। হাতের কাজ শেষ করতে করতে তবুও সাতটা বেজে গেল। কোন রকমে গোসলটা সেরে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে লাগাল এক ছুট কলেজের দিকে। রিকশায় যেতে যেতে চুল আঁচড়ে নিল।
পুরোটা রাস্তা পড়তে পড়তে গেল। কাল রাতে বই খোলারই সময় পায়নি। কারো মাথা ব্যথা নেই ওর পরীক্ষা নিয়ে। নাহ! এই মুহুর্তে ও সব কিছু ভুলে থাকতে চায়। পরীক্ষাটা ভাল দিতে হবেই।
পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে দু’ঘন্টা সময় পেল। চোখের পলক না ফেলে পড়ে যাচ্ছিল একটানা। পরীক্ষার হল থেকে বের হবার পর যেন নিঃশ্বাস নিতে পারল মেয়েটা আর ক্ষিদেটাও মনে করিয়ে দিল যে সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। রিয়াকে তাই বলল স্মরণী ‘চল ক্যান্টিনে যাই। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
’
ক্যান্টিনের দিকে যেতে যেতে রিয়া জিজ্ঞেস করে ‘কাল কি হয়েছিল রে? অত কাঁদছিলি কেন?’
স্মরণী একটু থমকে যায়। তারপর জোর তাড়া লাগায় রিয়াকে ‘ তাড়াতাড়ি চল তো রিয়া। আর একটুপর অজ্ঞান হয়ে যাবো খেতে না পেলে। ’
দুপুর হয়ে গেছে। রোদের তেজ বেড়েছে বেশ।
অনেকেই পরীক্ষা শেষে আড্ডা দিচ্ছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। বড় দীঘির পাড়ে বকুলতলায় এসে বসল ওরা। এটা ওদের প্রিয় জায়গা। শান বাঁধানো বকুলতলাটা শুধু ওদের নয় কলেজের সব ছেলেমেয়েরই প্রিয়। তাই জায়গাটা কখনই ফাঁকা থাকে না।
আজ কেমন করে যেন একদম ফাঁকাই পাওয়া গেল।
‘এখন বল কি হয়েছিল কাল রাতে’ রিয়া পুনরাবৃত্তি করে প্রশ্নটা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মরণী বলে ‘কালো মেয়ের কপালে শনি লেগেছে। ‘
‘মানে কি?!’
‘কাল ভাইয়া ভাবী একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। পাত্র বড় ব্যবসায়ী।
অনেক অনেক টাকার মালিক। গাড়ী বাড়ি সব কিছু আছে। পায়ের উপর পা তুলে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যাবে। শাড়ি গয়না যা চাই সব সব দেবে। ‘
‘ভালই তো।
তুই কি বললি?’
রিয়ার কথা শুনে বাঁধভাঙ্গা হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল স্মরণী।
‘এত হাসির কি হলো?!’ রিয়া অবাক হয়ে জানতে চায়।
হাসতে হাসতে কান্না পেয়ে যায় স্মরণীর। রিয়ার অগোচরে চোখ মুছে নিল মেয়েটা।
‘ঠিকই বলেছিস।
পাত্রের সবই ভাল শুধু তার বয়সটাই একটু যা বেশি। বাড়ীতে বড় বড় দুটি ছেলে রয়েছে। সম্প্রতি ছেলেদের মায়ের অকাল মৃত্যু ঘটায় লোকটি বড়ই বিপাকে পড়েছে। আর তাকে উদ্ধার করার জন্য আমার দয়াবতী ভাবি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখলেন না উপযুক্ত। ’
‘কি বলিস এই গুলা স্মরণী?!’ রিয়া এতক্ষণে বুঝতে পারল কেন অত কাঁদছিল ওর প্রিয় বন্ধুটা।
‘কালো মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভাল পাত্র আর পাওয়া যাবে না। ভাবী ভাইয়া আর মা’কে বুঝাচ্ছিল। আর তারাও তাতে রাজী। শুধু ছোট ভাইয়া প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু ওর কথার কি দাম! যে সংসারে একটা পয়সা দিতে পারে না।
তার কথা ওরা গুরুত্ব দিতে যাবে কেন বল?’
‘তুই কিছু বললি না?’
‘বারবার যে মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গে তার বলার কিছু থাকতে পারে না। ছোট ভাইয়া একাই ঝগড়া করল সারা বাড়ির লোকের সাথে। ভাবী চিৎকার করে ভাইয়াকে বলে দেখব কোথায় বিয়ে দাও এই কালীর। এরপর বাড়ীতে যেন নরক ভেঙ্গে পড়ল। ’
রিয়ার রাগে সারা গা জ্বলতে লাগল।
একটা মেয়ে কালো বলে তাকে এত অপমান সইতে হবে? গায়ের রঙই কি সব কিছু? স্মরণী ওদের ক্লাসে সবচেয়ে মেধাবী মেয়ে। কলেজের সবাই যাকে কৃষ্ণকলি বলেই চেনে যাকে নিয়ে স্যারদের কত স্বপ্ন! সারা কলেজ জানে স্মরণী অনার্সে ফার্স্টঁ ক্লাস ফার্স্ট হবে। অথচ ওর বাড়ীর লোকগুলি যেন উঠেপড়ে লেগেছে মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করার জন্য। গতবছর ওর ভাই আর ভাবী কলেজে এসেছিল নাম কাটিয়ে নিতে। পড়তে দেবে না।
তাদের বক্তব্য এমনিতেই কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না তার উপর যদি বেশি ডিগ্রী নিয়ে ফেলে তাহলে আরও ছেলে পাওয়া যাবে না। ডিপার্টমেন্টের হেডস্যার এত রেগে গিয়েছিলেন এসব শুনে যে তিনি সোজা চলে গেলেন প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে স্মরণীর পড়ার খরচ কলেজ দেবে এই আবেদন নিয়ে। প্রিন্সিপ্যাল স্যার সব শুনে অনুমোদন দিয়ে দেন। কলেজের সাথে না পেরে স্মরণীর ভাই ভাবী বাড়িতে এসে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়ালো ওর ভাবী।
এত বেশি বেশি কাজ করায় ওকে দিয়ে যাতে পড়ার সময় বের করতে না পারে। কলেজে যাওয়াও বন্ধ করতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের জন্য পারেনি। বাবা মারা যাবার পর থেকে বড় ভাই সংসার চালাচ্ছে। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দেখা শোনা করে। ছোট ভাইয়াটা বেশি দূর পড়াশোনা করল না।
বাউন্ডুলে জীবনযাপন করে। তবু এই ভাইটার জন্যই ওরা বেঁচে আছে।
স্মরণীর কান্না দেখে রিয়া বলে ‘কাঁদিস না। তুই এত মেধাবী একটা মেয়ে তোর মনে জোর কেন এত কম হবে? তারা যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে নাকি? তোর অমতে ওরা কিছু করতে পারবে না। তুই শুধু সাহস হারাস না।
প্লীজ়!’
রিয়াকে জড়িয়ে ভীষন কাঁদতে থাকে মেয়েটা।
(২য় পর্বে সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।