কাক না ডাকা ভোরে কলির ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। নিত্যকার অভ্যাস। পুরো বাড়িতে দুটো মাত্র প্রানী -কলি আর তার পিসি, গত দশটা বছর ধরে যে মানুষটাকে সে নিয়মিত জ্বালাতন করে আসছে আর তিনি মুখ বুজে তার অত্যাচার সহ্য করছেন। অন্য সবার কাছে কলি একটা একাবোকা, পড়ুয়া, শান্ত, মা-মরা মেয়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার অনেক জেদ আর সব জেদ খাটে শুধু ঐ নরুন পেড়ে সাদা কাপড় পরা নিরীহ পিসির কাছে।
দুদিন ধরে তার সবচেয়ে কাছের এই মানুষটা তার সাথে কথা বলছে না। কেউই তার সাথে কথা বলছে না, সে মহাভারত কলুষিত করে ফেলেছে। কলির খুব মন খারাপ। রাতে অনেক কান্নাকাটির পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে, ঘুম ভেঙ্গেও মন খারাপের ভাবটা কাটেনি।
খালিপায়ে চুপিচুপি দরজা খুলে ছাদের সিঁড়িতে পা দিতেই বিকট শব্দে ফোনটা বেজে উঠল।
কলি দৌড়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে নিল। কোনো সাড়া নেই। ফোনটা রাখতে যাবে তখনই শুনতে পেল
-কলি, কৃষ্ণকলি কেমন আছিস?
কলি চুপ করে রইল। ছেলেটা তাদের প্রতিবেশী, বড়োলোকের বখাটে ছেলে আর কলির ছেলেবেলার বন্ধুও বটে। কিন্তু এখন যে আর ছেলেবেলা নেই, ছেলেবন্ধুও থাকতে নেই।
তাই বাবা আর পিসি মিশতে বারণ করে দিয়েছে। তাছাড়া রাশেদের স্বভাবটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। পাড়া-বেপাড়ায় মেয়ে দেখলেই শিষ বাজাবে, পরীক্ষায় ফেল করবে, কিছু হলেই মারামারি করবে! তাই কলিও ওকে এড়িয়ে চলে, যদিও ছেলেটা এখনো আগের মত মিশতে চায়।
-কলি আমি জানি তোর খুব মন খারাপ। তুই চিন্তা করিস না, আমি সব ঠিক করে দিব।
-আমার মন ভাল। তোকে ফোন করতে নিষেধ করেছিলাম না?
-জানিস, আমি তো ছিলাম না, পরে সব শুনেছি! এতকিছু হয়ে গেছে শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। তুই রাগ করিস না…
-তুই কী শুনেছিস? আর তুই করেছিস কী? দাদাকে তাহলে ওভাবে মেরেছিস তোরাই? ছি ছি
-ছ্যা ছ্যা করিস না তো। ও কেন এমন করল তোর সাথে? আর কীসের দাদা রে? তোকে একা পেয়ে তোর হাত ধরে, তোদের ধর্মে না ভাই-বোনে এসব হয় না!
-তোরা কিচ্ছু জানিস না। তার কোনো দোষ ছিল না।
আর তুই আমার কে? তোকে আমার চিন্তা করতে হবে না রাশেদ। শেষবারের মত বলে দিলাম।
-আমি সবই জানি। তোর ওই দাদা খুব বদ, তার নজর খারাপ।
-বাজে কথা কথা বলবি না।
সে খারাপ না। আমি খারাপ। আমিই তার হাত ধরেছিলাম, তাকে অনুনয় করে বলেছিলাম আমাকে ভাল না বাসতে পারলেও যেন ঘৃনা না করে।
-তুই মিথ্যা কথা বলছিস। তুই জানিস সে আমাকে কী বলেছে? সে বলেছে আমার মত খারাপ ছেলেই নাকি তোর যোগ্য!
-তুই আমার সাথে আর কক্ষনো কথা বলবি না।
-কলি আমি জানি তুই আমাকে দেখতে পারিস না, আমার মত বখাটে ছেলেকে ছোটবেলার বন্ধু বলেও পরিচয় দিস না কারো কাছে। কিন্তু আমি তোকে এখনো বন্ধু ভাবি, হাওয়াই মিঠাই দেখলেই এখনো তোর জন্য কিনতে ইচ্ছা করে!
কলি দুম করে ফোনটা রেখে দিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। গেইটের পাশে উঠোন জুড়ে একরাশ শিউলী ঝরে পড়ে আছে।
কলি কাঁদছে, ঝাপসা লাগছে সবকিছু…শিউলী গাছ, উঠোন, গেইট সবকিছুই ভেসে যাচ্ছে। এমনই সুন্দর একটা সকালে হাতে ব্যাগ নিয়ে তার এক গেঁয়ো কাকার ছেলে, পার্থ তাদের বাড়িতে এসে ঢুকেছিল। এরপর থেকে সবকটা দিন ছবির মত মনে আছে কলির। গ্রামের ছেলে, মফস্বলের কলেজে পড়তে এসেছে, অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়ের দয়ায় সে বাড়িতে তার ঠাঁই হল। থাকবে, খাবে আর তাদের স্কুল পড়ুয়া মেয়েটাকে অঙ্কটা ইংরেজিটা পড়িয়ে দেবে।
পার্থ বয়সে তার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। সে যেন এক উপন্যাসের চরিত্র, কলির নিস্তরঙ্গ জীবনে যে রীতিমত বিপ্লব বয়ে আনলো! ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে কলিকে পড়ায়, কলিও পরীক্ষায় বেশ ভাল করে। আর মাত্র কটা দিন, ম্যাট্রিকের রেজাল্ট হলেই সে শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে, তার পার্থদার কলেজে। কলির অপেক্ষা করে আছে, দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না। কিন্তু হঠাৎ করে সব বদলে গেল, কেউ যেন জলরঙে আঁকা ঝকঝকে ছবিটা একেবারে ধুয়ে মুছে দিল!
দুদিন আগে যখন পার্থ নিজের কিছু বই ফেরত নিতে কলির কাছে এল, কলি সযত্নে র্যাএপিং করা একটা বই তার হাতে তুলে দিল।
কলির শত উপরোধ সত্ত্বেও ছেলেটা তখনই খুলে দেখল বইটা। প্রথম পাতা খুলতেই থমথমে হয়ে গেল মুখখানা। কলি নিমেষেই বুঝে নিল সবকিছু। সাথে সাথে পার্থর হাত ধরে ফেলে বলল
-দাদা মাফ করে দাও, রাগ কোরো না। প্লিজ!
-এমন জানলে তোর সাথে কখনো মিশতামই না, ছি ছি কৃষ্ণ !! তুই এত খারাপ? তোকে নিজের বোন বলে ভাবতাম।
ছি!
-আমাকে ঘেন্না করবে তাই বলে? এমন কোরো না, আমি খুব একা…আমি জানি না তোমাকে কেন এত ভাল লাগে, মন কেন এমন করে…এরকম তো হয় নি আগে কখনো! একটু বুঝিয়ে বলবে না আমাকে?
বলতে বলতে কলি কেঁদে ফেলল! খেয়ালই করল না কখন পিসি ঘরে এসে ঢুকেছে! পার্থ অপরাধীর মত মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর দুদিন পার হয়ে গেছে, তাকে কলি আর দেখতে পায় নি। চলে গেছে ছেলেটা, তাড়িয়ে দেবার আগেই। শুধু শুনতে পেয়েছিল গলির মুখে কারা যেন ওকে খুব মেরেছে! কলি শুনেও কিছু করতে পারেনি, শুধু কেঁদেছে অসহায়ের মত। আর নিজেকে শাপশাপান্ত করছে দিনরাত।
তার জন্যই এমন হয়েছে, সে খুব খারাপ মেয়ে, সে কেন বুঝল না যে তার সমাজে এসব চলে না!
গ্রামের বাড়িতে পুজো হচ্ছে, কলিকে তার পিসীর কাছে রেখে বাড়ির সবাই পুজোতে চলে গেছে। কৃষ্ণকলি এখন অচ্ছুৎ, তাকে নিয়ে কি আর পুজো-পার্বণে যাওয়া চলে?! বাবা যাবার সময় তাকে কিছু না বলেই চলে গেলেন। হয়তো ফিরে এসেও কথা বলবেন না।
পড়ন্ত বাদামি বিকেল। আনমনে ছাদে পায়চারি করছে কলি।
মিঠাইওয়ালার হাঁক শুনতে পেয়ে হঠাৎ করে কী যেন হয়ে গেল তার! খুব জেদ চেপে গেল! অস্থির পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে এল সে। তারপর গেট খুলে একেবারে রাস্তায়। ওপাশে রাশেদদের বাড়ি। উদ্ভট হলুদ রঙের বাড়িটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, এতদিন পর তার চোখে পড়ল! মিঠাইওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে কলি রাস্তা থেকেই রাশেদের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো! মিঠাইওয়ালাও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। রাশেদ গেট থেকে উঁকি দিতেই কলি বলে উঠলো-
-কি রে হাওয়াইমিঠাই খাওয়াবি না? কতদিন খাই না খেয়াল আছে?
রাশেদ সেই আগের মতই প্রথমে প্যান্টের পকেট দুটো হাতড়ে নিল, তারপর উস্কো খুস্কো চুলগুলো দ্রুত হাতে ঠিক করে নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল।
লেখকঃ গান্ধর্বী
nibeditaaich@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।